আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রতারক ১ (ধারাবাহিক ওয়েস্টার্ন গল্প)

timursblog@yahoo.com

শকুনটাকে উড়তে দেখেই মিনিট দশেক আগে শোনা রাইফেলের গুলির আওয়াজটার কথা ভাবল উইন্টার । ঘটনাটা এখানে ঘটেনি তো ? ট্রেইলের বাঁকে এসে ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরল মার্শাল লী উইন্টার । একশো গজ সামনে ট্রেইলের ডানদিকের গালচ থেকে কালো পাখা ঝটপট করে পেছনের পাইন গাছগুলোর একটার ওপর বসল শকুনটা । আকাশে চক্কর দেয়া শকুন থেকে আশে পাশে কোন লাশ পড়েছে কিনা বোঝা যায়, আর কোন শকুন কে মাটি থেকে ওভাবে উঠতে দেখলে ধরে নেয়া যেতেই পারে যে ওটার আশে পাশেই কোন মৃতদেহ পড়ে আছে । ঠিক তাই, উপুড় হয়ে পড়ে থাকা লাশটা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হল উইন্টার, কয়েক মিনিট আগেই গুলি খেয়েছে লোকটা ।

মাথার পাশে বুলেটের গর্ত আর শকুনে ঠোকরানো বাদ দিলে অক্ষতই আছে দেহটা । ভাল ভাবে পকেট হাতড়েও কোন পরিচয়সুচক কিছু মিললনা ওর কাছ থেকে । বয়েসে তরুন, পঁচিশ বছরের বেশি হবে না কিছুতেই । ওর খুনী যেই হয়ে থাকুক, খুব বেশি দূর যায়নি নিশ্চয়ই । মাথা চুলকে ভাবল লী 'অনেক খুনখারাবি হচ্ছে এখানে, যার মাথা মুন্ডু কিছু বুঝতে পারছিনা আমি ।

' একটা কিছু নড়াচড়া টের পেয়ে নড়ে উঠল উঠল মার্শালের ঘোড়া ক্যাননবল (সার্থক নামকরন, পেটে স্পার দাবালে কামানের গোলার মতই ছুটতে পারে ও !) । ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সতর্ক করল মার্শাল উইন্টারকে, ধনুকের মত শরীরটা বাঁকিয়ে নীচু করল সে, পাশের বোল্ডারটার গায়ে টক্কর খেল একটা রাইফেলের বুলেট, চল্টা উঠিয়ে ছিটকে চলে গেল আরেকদিকে । তাড়া খাওয়া বেড়ালের মত একছুটে জিনে চাপল উইন্টার, রেকাবে পা গলানর আগেই ছুটতে শুরু করেছে ক্যাননবল । বাঁকের আড়ালে যাওয়ার আগে চকিতে মাথা ঘুরিয়ে চাইল পেছনে, ট্রেইলের একপাশে প্রায় ষাটফুট ওপরে উঠে গেছে একটা প্রায় খাড়া পাথরের দেয়াল, নিঃসন্দেহে ওটার ওপরে কোথাও চমৎকারে আড়ালের পেছনে পজিশন নিয়ে বসে আছে স্নাইপার । ওখানে গিয়ে ওকে খুঁজতে যাওয়া পাগলামি ছাড়া কিছু নয়, মার্শালের ব্যাজকে বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করবেনা অজ্ঞাত বন্দুকধারী ।

কুড়ি মাইল দূরের ফরলর্ন গ্যাপ শহরের দিকে ঘোড়ার মুখ ফেরাল মার্শাল লী উইন্টার । ফরলর্ন গ্যাপে ঢোকার মুখেই পড়ে ডক বোগাননের স্যালুন, ডাক্তার নয় তবু নাম তার 'ডক', অবশ্য 'বোগি' বলেও তাকে ডাকে অন্তরঙ্গরা । খনিশ্রমিক, কাউপাঞ্চার, জুয়াড়ি, ভবঘুরে, ভাগ্যাম্বেষী, অনেক ধরনের মানুষই পায়ের ধুলো দেয় ডকের স্যালুনে । বেশ কয়েকদিন হয়, ডক খেয়াল করছে নতুন আসা খদ্দেরদের চেহারাসুরত খুব ভাল ঠেকছেনা তার । স্যালুন মালিক হিসেবে মানুষের চেহারা দেখলেই স্বভাব চরিত্র বলে দিতে পারে ডক বোগানন ।

যদিও পেশায় স্যালুনকিপার ডক , জজ বা মন্ত্রী হলে বেমানান হতনা সে । এ পেশায় আসার আগে সমাজের তথাকথিত উপরতলার বাসিন্দা ছিল ডক বোগানন । পকেটঘড়ি দেখল ডক, প্রায় মাঝরাত, স্যালুন বন্ধ করার সময় এসে গেছে । কয়েকটা গ্লাস তুলে মুছে কাউন্টারের ওপর সাজিয়ে রেখে আড়চোখে চাইল বসে থাকা দুজন খদ্দেরের দিকে । একজনের বয়স বছর চল্লিশেক, মুখ হাঁড়ি করে কয়েকঘন্টা বসে আছে টেবিলে কারো সাথে কোন কথা না বলে ।

অন্যজন তার ঠিক বিপরীত, ধোপদুরস্ত পোশাক আশাক, নিখুঁতভাবে কামান গাল, বছর পঁয়ত্রিশ হবে বয়স, দেখে মনে হয় দুনিয়ার সবার এবং সবকিছুর প্রতি সন্তুষ্ট এই চেহারার মালিক । এককথায় খোশমেজাজী । ডক তার খদ্দেরদের সম্বন্ধে কৌতুহলী হলে অনেক সময় ব্যক্তিগত প্রশ্ন সরাসরি জিগ্যেস করে বসে , স্যালুন মালিক বলে অন্যেরা কিছু মনে করেনা তার কথায়, সুবেশী আগন্তুককে তাই প্রশ্ন করতে বাঁধলোনা তার, 'হাউডি স্ট্রেঞ্জার, তোমাকে কখন এদিকে দেখেছি বলেতো মনে পড়ছে না । ' হাসল লোকটা, হাসির সাথে বেরিয়ে পড়ল ঝকঝকে শাদা দাঁত আর অহংকার । 'না মি. বোগানন, আমার মনে হয় সে সৌভাগ্য হয়নি, আমার নাম কনরাড পেইটন, বোস্টনের বিখ্যাত পেইটন পরিবারের একজন, যদি বংশ পরিচয় নিয়ে একটু গর্ব করতে পারি আমি ।

' নিশ্চয়ই' হাত বাড়াল ডক, 'বোস্টনের পরিচয়ে যে কেউ গর্ব করতে পারে । ' 'ধন্যবাদ মি. বোগানন, আমি নিজেকে সবদিক থেকেই ভাগ্যবান ও সুখী মানুষ মনে করি । ' 'সুখী মানুষ?' চোখ কপালে তুলল ডক, 'তাহলে ভায়া, তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে বিরল প্রজাতির চিড়িয়াদের একজন । সুখী মানুষ? হাঃ হাঃ হাঃ সব মানুষের একটা না একটা চুলকানি আছেই, প্রসপেক্টিং করে সোনার ঢিবি বানিয়েছে কেউ, তারপর বোকার মত জুয়া খেলে উড়িয়ে দিচ্ছে এক সন্ধ্যায়, রাতে মাতাল হয়ে মারপিট করছে পিস্তল নিয়ে, পরদিন সকালে ঝুলিয়ে দেয়া হচ্ছে তাকে শিমুল গাছের মগডাল থেকে ফাঁসির দড়িতে । এই তো জীবন, সুখী হবার অবকাশ কোথায় মানুষের?' 'তা ঠিক' মাথা নাড়ল কনরাড ।

' কিন্তু অভিযোগ করার মত সত্যি কিছু নেই আমার জীবনে । ' 'তাহলে তুমি অসাধারন মানুষ কনরাড' আর কী সব বলতে যাচ্ছিল ডক, বলা হলনা, ব্যাটউইং ঠেলে স্যালুনে ঢুকল মার্শাল লী উইন্টার । হ্যাট খুলে ফরমাশ দিল মার্শাল, 'হাই ডক, একটা ওয়াইন লাগাও টেবিলে । ' 'এখনই পাবে তুমি' শেলফ থেকে বোতল নামিয়ে বলল বোগানন 'কিন্তু তুমিতো আগে হুইস্কি পছন্দ করতে বেশি, হঠাৎ কী ঘটল ?' ডকের খোঁচাটা গায়ে না মেখে চুপচাপ গ্লাসে চুমুক দিল উইন্টার । কয়েক মিনিট বাদে মুখ খুলল সে 'ডক, আমি ভীষন রেগে আছি, রাগটা আমার নিজের ওপরই, আচ্ছা বলতে পার, সাধারন বুদ্ধি আছে এমন কোন লোক কেন মার্শাল পদের জন্য দৌড়াবে ?' দাঁত বের করে হাসল ডক বোগানন 'তুমি নিজেই গলা বাড়িয়ে ফাঁসটা পড়েছো উইন্টার, এখন আর আমাদের দোষ দিয়োনা ।

না সাধারন বুদ্ধি নয়, আসলে অনেকের থেকে বেশিই বুদ্ধি আছে তোমার লী, নইলে এ পদে টিকে থাকতে পারতে না । ' চোখ গরম করে ডকের দিকে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে নিশ্চিত হল লী, ঠাট্টা করছে না স্যালুনের মালিক, তারপর ঘুরে কনরাড পেইটনের দিকে নজর ফেরাল । স্যালুনের বাইরের হিচ রেইলে একটা ক্লান্ত-অবসন্ন ঘোড়া বাঁধা রয়েছে দেখেছে, সে, বোধহয় এই ফুলবাবু ওটার মালিক । ডকের চোখে পড়েছে লী'র পর্যবেক্ষন, 'লী, পরিচয় করিয়ে দেই, এ হচ্ছে কনরাড পেইটন যে কিনা জীবনের সবচেয়ে বড় রহস্য ভেদ করে ফেলেছে, কনরাড এ হচ্ছে আমাদের মার্শাল লী উইন্টার । ' গ্লাসটা ছাড়লনা লী, অপরিচিত মানুষের সাথে করমর্দন করতে অপছন্দ করে লী ।

আজ যার হাতে হাত মেলাল, কালকেই হয়তো তাকে গুলি করে মারতে বাধ্য হবে সে । 'আমার মনে হয়না জীবনে সেরকম রহস্য আছে । ' 'কনরাডের নিজের ভাষায় সে সত্যিকারের একজন সুখী মানুষ, সুখের সন্ধান পাওয়াটা কী জীবনের সবচেয়ে রহস্য বলে মনে করনা মার্শাল ?' ঠাট্টা করেই যদিও বলেছিল কোন হাসি ফুটলনা উইন্টারের মুখে । খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সে আগন্তুককে, প্রায় উইন্টারের সমানই লম্বা, তবে অনেক হালকা-পাতলা, কাল চুল, লম্বাটে মুখ, হাসলে চোখ জ্বলজ্বল করে, নাহ নিজের দেখা কোন ওয়ান্টেড পোস্টারের সাথে মেলাতে পারলনা ওকে লী । 'হতে পারে তোমার আপেলে পোকা আছে?' কনরাডকে বলল সে ।

'পোকা?' বলল কনরাড । 'হ্যাঁ পোকা, কনরাড' গ্লাসে চুমুক দিল লী । 'সব আপেলেই পোকা থাকতে পারে, আজকে না থাকলেই কালকে থাকবে । ' গ্লাসটা শেষ করে কাউন্টারে নামিয়ে রাখল সে । 'রামগরুড়ের ছানাটা কে ডক?' মুখ কাল করে বসে থাকা অন্য খদ্দেরের দিকে চেয়ে ডককে জিগ্যেস করল লী ।

'হুইটবি, অন্তত ওনামেই ডাকতে শুনেছি ওকে, র‌্যান্স হুইটবি । ' 'এদিকে এসো বাবা র‌্যানসম হুইটবি, একঢোক গিলে যাও আমার পয়সায়, তোমাকেও বলছি কনরাড । ' দুটো কয়েন কাউন্টারের ওপর ফেলে দরজার দিকে এগোল লী, 'আজকের মত চলি আমি, গুডনাইট । ' ও বেরিয়ে যাবার পর মন্তব্য করল কনরাড 'মজার লোক, তাইনা ?'ঠোঁট কামড়াল ডক বোগানন 'আমি তা বলবোনা ঠিক, যারা ওর সাথে গায়ে পড়ে লেগেছে তারাই বুঝেছে, লী উইন্টারকে তার চেহারা বা কথা দিয়ে মাপা বিপজ্জনক । ' আবার দুলে উঠল স্যালুনের ব্যাটউইং ।

এবারে যে লোকটা ঢুকল যাকে একবার দেখলে অন্তত দু বার চেয়ে দেখবে যেকোন লোক । 'মানুষ বটে একটা !' মনে মনে বলল ডক । একদম ছবির বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসেছে যেন কোন রাজকুমার, কনরাড পেইটন ম্লান হয়ে যাবে এ লোকের পাশে । রোদেপোড়া ব্রোঞ্জ রং, দীর্ঘ একহারা গড়ন, পরনে চমৎকার করে ছাঁটা সোনার বোতাম লাগান কাল স্যুট আর কড়া মাড় দিয়ে ইস্ত্রি করা ধবধবে শাদা শার্ট, শার্টের হাতা আবার হীরের স্টাড দিয়ে কব্জিতে আটকান, মাথায় উঁচু সিল্কের টপহ্যাট আর মোম দিয়ে পাকানো মৌমাছির হুলের মত সরু হয়ে আসা চোখা গোঁফ । সবশেষে তার হাতের দিকে নজর গেল ডকের , মেয়েদের মতো পেলব আর কোমল হাতদুটো, তবে আঙ্গুলগুলো সবল, দীর্ঘ আর চঞ্চল ।

'পেশাদার জুয়াড়ি এ লোক, নইলে নিজের কান নিজেই কেটে ফেলব !' মনে মনে বলল ডক বোগানন । (ক্রমশ)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।