আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রৌদ্র ছায়ার নিচে

গড়িয়ে গড়িয়ে চলে গেল দিনগুলো, রেখে গেল কিছু ঋণ আমার শয়নে-স্বপনে, ভেবেছি সব ঋণ শোধ হবে, হয় না, জানি না হবে কিনা কোনো দিন। কবিতাটি লিখেছিলেন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সেই কালরাত্রির কয়েক দিন পরে। দীর্ঘদিন পরে হঠাৎ দেখা পেলাম হারিয়ে যাওয়া কবিতাটির এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেলাম অতীত, সঙ্গে হাজার স্মৃতি, একদল মানুষের লম্ফ, রাজপথে প্রকাশ্য দিবালোকে বন্দুকের ঝনঝনানির আস্ফালন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীদের উচ্ছ্বাস, আনন্দ। দেশের বিভিন্ন জেল থেকে সগর্বে বেরিয়ে এলেন অনেকেই, যারা একদিন পাকিস্তান আর্মিকে সাহায্য-সহযোগিতাসহ এই জনপদের নিরীহ মানুষদের হত্যায় উৎসাহিত করেছিলেন, পাঞ্জাবি জুলমাত খানদের ওইসব খান হিন্দু, মুসলমানদের বাড়িঘর না চিনলেও চিনিয়ে দিতে সাহায্য করেছিলেন আমাদেরই স্বজনরা।

সেসব দিন-রাত্রি পোহানোর পরে এলেন সেই ভদ্রলোক, ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে পাকিস্তানি পাসপোর্টে, তৎকালীন সরকারের সদিচ্ছায়।

১৯৭৬ সালের কোনো এক মাহেন্দ্রক্ষণে অসুস্থ মাকে দেখার ছলে, যিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন মা-মাটির বিপক্ষে, যিনি পূর্ব পাকিস্তান উদ্ধার কমিটির হয়ে গিয়েছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের রাজা-বাদশার কাছে। '৭৬ পেরিয়ে '৭৭ সাল পর্যন্ত দোর্দণ্ড প্রতাপে কাটালেন তৎকালীন সামরিক শাসক, ইতোমধ্যে সামরিক শাসক হয় তো বুঝতে পেরেছিলেন একদলীয় শাসনব্যবস্থা না করে বরং দেশে গণতান্ত্রিক ধারার প্রচলন করাটাই সমীচীন। শাসক মহোদয় একটি নতুন দলও বানালেন। হয়তো বা বিদেশি মন্ত্রকদের সুবুদ্ধিতেই একটি জাতীয় ভোটের দিনও নির্ধারিত হয়েছিল, ১৯৭৮ সালের (৩/৬/৭৮) জুনের ৩ তারিখে, [শনিবার ১৯ জ্যেষ্ঠ ১৩৮৫ সাল]

মাত্র ৮ মাস পরে ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় ভোটের দিন নির্ধারিত করেছিল সরকার। ফেব্রুয়ারি '৭৯ সালের সেই ভোটে দাঁড়িয়েছেন 'হলি ডে' সম্পাদক এনায়েত উল্লা খান, 'প্রদীপ মার্কা' প্রতীক নিয়ে মালিবাগ, খিলগাঁও, শাহজাহানপুর এলাকা থেকে।

তাকে যারা ভোটযুদ্ধে নামিয়েছিলেন অনেকের ধারণা, ন্যাপ থেকে আগত এবং তৎকালীন সরকারের মন্ত্রী, আস্থাভাজন এবং মওলানা ভাসানীর বিশেষ স্নেহাস্পদ মশিউর রহমান যাদু মিয়া। যাদু মিয়া সম্পর্কে পল্টন ময়দানে মওলানা ভাসানীর দেওয়া একটি বক্তৃতার কথা আজো মনে আছে। ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৬৯ গণআন্দোলন এবং '৭০ সালের নির্বাচনের আগে পাকিস্তানি শাসকরা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি যে অন্যায়-অবিচার চালিয়েছিলেন, সেই অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদে মওলানা ভাসানী তার দল (ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি) ন্যাপের উদ্যোগে পল্টন ময়দানে বক্তৃতায়, ভাসানী সাহেব, পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্যের তুলনা দিতে গিয়ে জানালেন, পূর্ব পাকিস্তানের খাদ্য, শিক্ষাসহ অন্যান্য বৈষম্যমূলক বিভাজন, ভাসানী সাহেবের সম্ভবত বাম দিকেই ছিলেন মশিউর রহমান যাদু মিয়া, তাকে দেখিয়ে হুজুর (ভাসানী সাহেব) বললেন, 'আমি সবকিছুর দাম উভয় পাকিস্তানের তুলনামূলকভাবে কম-বেশি বললেও শুধু বলতে পারব না, 'মদের দাম' এ দেশে কত_ আর ওই দেশে কত, সেটা বলতে পারবে একমাত্র মশিউর রহমান যাদু মিয়া।

সেই যাদু মিয়া '৭৫-পরবর্তী সরকারের মন্ত্রী হয়েছিলেন এবং তিনি ১৯৭৯ সালের ১২ মার্চ মারা গেলে তার মৃত্যু উপলক্ষে তৎকালীন সরকার তিন দিন রাষ্ট্রীয় শোক পালন করল অফিস-আদালত বন্ধ রেখে। এর ঠিক সাত দিন পরে ২০ মার্চ ১৯৭৯ সালে (চৈত্র ১৩৮৫) একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটল উত্তরবঙ্গের প্রধান শহর শিক্ষা-দীক্ষার প্রাণকেন্দ্র রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গোলাগুলিতে ছাত্র-শিক্ষক মিলিয়ে নিহত হয়েছিলেন ১২ থেকে ১৫ জন।

আহতের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ।

দিন গড়িয়ে গড়িয়ে চলেছে, মাঝে আছি আমরা, আর আমাদের আগে এবং পেছনে আছে, শাসকের বেতনভোগী একদল, সম্মুখে আছে ১০ দল। সেই ১০ দল ৯ ফেব্রুয়ারি শনিবার ১৯৮০ সালে (২৫ মাঘ ১৪৮৬) দেশব্যাপী হরতাল ডেকেছিল। সেই দিনের সেই হরতালে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন ৫ জন মানুষ, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল বেশকিছু, তবে গাড়িতে যাত্রীদের পুড়িয়ে মারার কালচার তখনো শুরু হয়নি। গাড়ির টায়ারে আগুনের লেলিহানে কাউকে পুড়ে মরতে হয়নি, এমনকি প্রকাশ্য দিবালোকে ছিনতাই রাহাজানির হার, এখন যেমন বেড়েছে, তখনকার সময়ে দেশে জান্তার আইন থাকার সুবাদে হয়তো কেউ সাহসই পাননি অপকর্মের সঙ্গী হতে।

তবে খুন, রাহাজানি, সেই সম্রাট বাবরের সময় থেকে কিংবা তারও আগে থেকেই ভারতবর্ষে শুরু হলেও ব্রিটিশ শাসন ১৭৫৭ জুনের ২৩ তারিখের পর থেকে ভারতবর্ষে, গুম, জেল, হত্যা, অবিচার, ন্যায়নীতি ভুলে গিয়ে বিশেষত ভারতবর্ষের বঙ্গসমাজে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে শাসক ইংরেজ যে বীজ বপন করে গিয়েছিল, তারই ধারাবাহিকতা রক্ষা করলেন কতিপয় বিপথগামী উর্দিবাহক। উর্দিবাহকদের কুবুদ্ধি যিনি জুগিয়েছিলেন তিনি কুমিল্লার দাউদকান্দির খন্দকার মোশতাক আহমদ। কয়েক বছর আগে মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের কাবুল চৌধুরী ও নাসির আহমদের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল ভাগীরথী নদী পাড়ি দিয়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলার সমাধিস্থল দেখতে যাওয়ার এবং একই সঙ্গে বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর আলীর সমাধিস্থলটাকেও দেখব, সঙ্গে হাজার দুয়ারি এবং জাদুঘর, কাবুল চৌধুরী আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন সিরাজের সমাধিস্থলে, দেশি-বিদেশি অনেক পর্যটককে দেখলাম। কাবুল চৌধুরীকে যখন মীরজাফরের সমাধির কথা বললাম এবং যেতে চাইলাম, মনে হলো কাবুল যেতে অনিচ্ছুক, শেষ অবধি গিয়ে দেখি, বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরের সমাধিতে, পর্যটক তো দূরের কথা, যেসব পথিক যাতায়াত করছেন তারা প্রত্যেকেই সমাধিতে ফুল না দিয়ে দিচ্ছেন থুথু।

শ্রাব্য এবং অশ্রাব্য দুই-একটি শব্দও কানে এলো। দাউদকান্দির বিশ্বাসঘাতক খন্দকারের কবরে কেউ না কেউ থুথু না দিলেও বিশ্বাসঘাতকের নামের আগে নিশ্চয়ই খুনি শব্দটিকে ব্যবহার করে থাকেন।

১৯৮০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৬ তারিখের শনিবারে সূর্যগ্রহণের মাসেই নেমে এসেছিল প্রচণ্ড ধুলিঝড়, চারদিকে অন্ধকার। সেই অন্ধকার কাটতে না কাটতেই ৩১ মার্চ সোমবার সচিবালয়ের আশপাশসহ বায়তুল মোকাররমের আশপাশ দিয়ে পুলিশ ও জনতার মধ্যে খণ্ডযুদ্ধের কল্যাণে পেয়েছিলাম টিয়ার গ্যাস। টিয়ার গ্যাস প্রথম পেয়েছিলাম ১৯৬৬ সালে প্রেসক্লাবের সামনে ৬ দফা আন্দোলনের গোড়ার দিকে।

সেই বছরের ২৩ মে শুক্রবার বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে এক জনসভার আয়োজন করেছিল খুনি মোশতাকের লোকজন। সেসব লোকজনের হয়তো ইচ্ছা হয়েছিল বাংলাদেশকে পুনরায় পাকিস্তানের অংশ করা যায় কিনা। বক্তৃতা চলাকালে প্রচণ্ড গণ্ডগোল শুরু হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দুজন সাংবাদিকসহ নিহত হয়েছিলেন সাতজন। এ ছাড়া বহুলোক হতাহত হয়েছিলেন, আমার বিশিষ্ট বন্ধু ছড়াকার আবু সালেহ অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেও তাকে হতে হয়েছিল বধির। কে বা কারা নিক্ষেপ করেছিলেন গ্রেনেড।

হত্যার রাজনীতি অনেক আগেই শুরু হয়েছিল। '৭২ সালে কবি হুমায়ুন কবির নিহত হয়েছিলেন তারই এক বিশেষ তাত্তি্বক কবিবন্ধুর বিশ্বাসঘাতকতায়। পরবর্তী সময়ে চোরাগোপ্তা আরও কিছু হত্যাকাণ্ড ঘটলেও '৭৪ সালে সাভারে নিহত হয়েছিলেন সিরাজ শিকদার এবং '৭৫ সালে সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুসহ আরও অনেকেই নিহত হয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে।

গণতন্ত্রের জন্য যে লড়াই ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর থেকে শুরু হয়েছিল, তারই ধারাবাহিকতা থেকে কোনো দলই মুক্ত হতে পারেনি। দেশ এবং জাতির জন্য যা কাম্য নয়।

দুঃখজনক। তাই হয়তো তারুণ্যের আশ্রয়ে লিখেছিলাম সেই কবিতাটি_ যেটি উল্লেখ পূর্বাহ্নেই করেছি। বঙ্কিমচন্দ্র তার এক নিবন্ধে লিখেছিলেন 'সাহেবরা যদি পাখি মারিতে যায় তাহারও ইতিহাস লিখিত হয়, কিন্তু বাঙ্গালার ইতিহাস নাই_বাঙ্গালার ইতিহাস চাই। না হলে বাঙ্গালা কখনো মানুষ হইবে না'। বোধকরি বঙ্গিমচন্দ্র ঠিকই লিখেছিলেন_ 'আমরা একবিংশ শতাব্দীতে এসেও কেন যে পেছনের দিকে ফিরে যেতে চাচ্ছি_ এই প্রশ্নের উত্তর কে দেবেন, এখনো জানি না।

'

লেখক : কবি।

 

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।