গুলশান পিংক সিটির অদূরে চালককে গুলি করে একটি প্রাইভেট কার ছিনিয়ে নেয় সন্ত্রাসীরা। পরে জড়িত সবাইকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেফতারের পর দেখা যায়, এরা উঠতি বয়সের একদল কিশোর। আন্ডারওয়ার্ল্ডের নতুন মুখ।
বাড্ডা এলাকায় স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে একটি মোবাইল ফোন কোম্পানির এক কর্মকর্তাকে গুলি করে সর্বস্ব ছিনিয়ে নেয় কয়েকজন সন্ত্রাসী। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ঘটনার সময় ব্যবহৃত দুটি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রসহ সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করে। এরাও বয়সে কিশোর।
অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীকে ধরতে মিরপুরে অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অস্ত্র ব্যবসায়ী হিসেবে সোহাগ নামে যাকে ধরা হয়, সে একটি কলেজের ছাত্র। তার কলেজ-ব্যাগে তল্লাশি চালিয়ে উদ্ধার করা হয় একটি ভারতীয় শুটারগান। তার কাছে পাওয়া অস্ত্রটি মিরপুরের সন্ত্রাসী সুমনের। ওই সন্ত্রাসী অস্ত্রটি বিক্রি করতে দিয়েছিল রিয়াজ নামে এক যুবককে। রিয়াজ আবার বিক্রির জন্য চুক্তি করে সোহাগের সঙ্গে।
এভাবেই প্রতিনিয়ত আন্ডারওয়ার্ল্ডের অপরাধীদের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে নতুন নাম, নতুন মুখ। গত তিন মাসে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে হত্যা, ছিনতাইসহ নানা অপরাধে জড়িত এমন শতাধিক কিশোরকে গ্রেফতার করে পুলিশ। নতুন মুখের এ অপরাধীরাই রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য বড় হুমকি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তবে এদের সঠিক সংখ্যা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে নেই।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করার মতো ভয়ানক সাড়ে পাঁচ শতাধিক উঠতি বয়সী অপরাধী রাজধানীতে রয়েছে। এদের অধিকাংশ বেড়ে উঠছে মাদক ব্যবসায়ী মহিলাদের আশ্রয়ে। মাত্র ৩০০ টাকার বিনিময়ে খুনখারাবির মতো রোমহর্ষক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছে এই অপরাধীরা।
গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, আন্ডারওয়ার্ল্ডে পা দেওয়া নতুন অপরাধীরা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর হয়ে থাকে। খুন, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধের সঙ্গে তারা জড়িত। এরাই এখন রাজধানীর অপরাধের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসীরা তাদের বিভিন্ন কাজ নতুন মুখের অপরাধীদের দিয়েই করিয়ে থাকে। অপরাধজগতে চেহারা অপরিচিত থাকায় তারা প্রতিপক্ষ গ্রুপে ঢুকে খুনখারাবির মতো ঘটনা ঘটিয়ে আবার ফিরেও আসতে পারে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (পূর্ব) জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর বলেন, 'আমাদের কার্যক্রমের অংশ হিসেবে অবৈধ অস্ত্র, চাঁদাবাজি ও মাদকের বিষয়ে অভিযান চালিয়ে আমরা উঠতি বা কিশোর বয়সী অপরাধীদের তথ্য পাই। উঠতি বয়সের অপরাধীরা অস্ত্র ও মাদক বহন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত- এমন তথ্য আমরা অনেক আগেই পেয়েছি।' তিনি বলেন, বিদেশে পালিয়ে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণেই ঢাকায় নতুন মুখের অপরাধীরা সক্রিয়। জিসান দুবাই থেকে টেলিফোনে চাঁদাবাজি করছে। তার হয়ে নতুন মুখের অপরাধীরা গ্রহণ করছে চাঁদা।
জানা যায়, রাজধানীতে উঠতি বয়সী অপরাধীর সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে তাদের অপরাধের পরিধি। ছিনতাই, মাদক, চাঁদাবাজি ছাড়িয়ে ডাকাতি ও খুনের ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছে তারা।
গোয়েন্দা পুলিশের সূত্র জানায়, পুরস্কার-ঘোষিত ও বিদেশে পলাতক সন্ত্রাসী টোকাই সাগর, মোল্লা মাসুদ, শাহাদাৎ, কারাবন্দী তনাই মোল্লা, পলাতক তানভিরুল ইসলাম জয়, সুব্রত বাইন, জিসানের নিয়ন্ত্রণে আছে একাধিক পাড়া-মহল্লার উঠতি সন্ত্রাসী গ্রুপ। পলাতক সন্ত্রাসীরা ব্যবসায়ীদের কাছে ফোন করে চাঁদা দাবি করে। চাঁদা নিয়ে আসে উঠতি বয়সী সন্ত্রাসীরা। সূত্রমতে, ঢাকার নতুন অপরাধীরা তিন ক্যাটাগরিতে সক্রিয়। একটি গ্রুপ ব্যবসায়ীদের কাছে চাঁদাবাজি করে। কেউ চাঁদা না দিতে চাইলে তারা হুমকি দিয়ে আসে। আরেক গ্রুপ তাদের বসদের চাঁদার বিষয়ে অবহিত করে, চাঁদা সংগ্রহ করে। অন্য গ্রুপটি বসদের নির্দেশে হামলা ও কিলিং মিশনে অংশ নেয়। এসব উঠতি সন্ত্রাসী চাঁদা দাবি করে চিরকুট পেঁৗছে দিতে গিয়ে বাড়ির নিরাপত্তাকর্মীর পায়ে গুলি করে ভয় দেখাতেও পারদর্শী। গোটা রাজধানীতে কিশোর অপরাধী থাকলেও বস্তি এলাকাতেই অধিকাংশ তালিকাভুক্ত অপরাধী বসবাস করে।
সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়া কয়েকজন উঠতি সন্ত্রাসীর কাছে গোয়েন্দা পুলিশ চাঞ্চল্যকর আন্ডারওয়ার্ল্ড নেটওয়ার্কের তথ্য পায়। সূত্র জানায়, পুরান ঢাকার উঠতি সন্ত্রাসী রকিবুল হাসান রকি ও রুবেল পুলিশের জেরায় বলেছে, তাদের এক বছর আগে ডাকাত শহীদ বাহিনীর সদস্য লোকমান অপরাধজগতে নিয়ে এসেছে। তাদের সন্ত্রাসী বাহিনীতে ২৫-৩০ জন কিশোর আছে। এই কিশোরদের দিয়ে চাঁদাবাজি, ছিনতাই ও ডাকাতি করানো হয়। তেজগাঁও এলাকার টিনএজ সন্ত্রাসী বাবু। পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর জানায়, সালাম, পাখি ও রফিকের হয়ে কাজ করত সে। আগ্নেয়াস্ত্র সরবরাহ করত স্কুলের ব্যাগে। মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় কিশোর সন্ত্রাসীদের এ রকম অপরাধের তথ্য পায় গোয়েন্দা পুলিশ। মিরপুরের তালিকাভুক্ত টিনএজ সন্ত্রাসীদের মধ্যে আছে মুক্তার, মিন্টু, মন্টু, রেজু, শাহিন, বাহেন, পাইলট, বাচ্চু, এলিন, জাফর, লেংড়া তাজ, উঁচা বাবু, জনি, মতিন, মাইনুদ্দিন ও আলমাস। গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, কিশোর অপরাধীদের মধ্যে কেউ স্কুলছাত্র আবার কেউ পথশিশু। তবে বস্তি এলাকায় অরক্ষিতভাবে বেড়ে ওঠা কিশোররাই বেশি অপরাধমূলক তৎপরতায় জড়িয়ে পড়ছে। গুলিস্তানের ফুটপাতে, কমলাপুর রেলস্টেশনে, সব বাস টার্মিনাল ও সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালসহ অলিগলি, বস্তিতে অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে প্রায় অর্ধলক্ষাধিক শিশু-কিশোর বেড়ে উঠছে। এদের অধিকাংশই সংসারছাড়া, ছিন্নমূল। অনেকের জন্ম ফুটপাতে। অভিভাবকহীন এ পথশিশুরা অযত্ন-অবহেলায় বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেপরোয়া হয়ে উঠছে। সূত্রমতে, রাস্তায় বেড়ে ওঠা কিশোররা অর্থের জন্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। অভিজাত কিশোর অপরাধীরা বন্ধুদের সঙ্গে নিছক মজা করে অপরাধের পথে পা বাড়ায়। পরে নিজেদের মধ্যে গ্রুপিং, দ্বন্দ্ব আর স্বার্থের কারণে বড় ধরনের অপরাধ করে বসে।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।