পেশায় তিনি চিকিৎসক। আশির দশকে চাকরিজীবনের শুরুর দিকে স্ত্রী, দুই সন্তানসহ বাস করতেন ঢাকায়। বেতন পেতেন সাত হাজার টাকা। দুই ছেলে-মেয়ে পড়ত ইংরেজি মাধ্যমের একটি স্কুলে। ওদের টিউশন ফি লাগত চার হাজার টাকা।
সংসার চালাতে গ্রামে বাবার কাছে হাত পাততে হয়েছে বারবার। লজ্জায় একসময় মনে সংকল্প জাগে। সুযোগ পেলে নিজের গ্রামে একটি উন্নত মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবেন, যেখানে পাড়াগাঁয়ের শিশুরা তুলনামূলক কম খরচে লেখাপড়ার সুযোগ পাবে। অর্থোপেডিক সার্জন মো. আমজাদ হোসেনের সেই সংকল্প বাস্তবে রূপ নেয় ২০০০ সালে। দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলায় নিজের এলাকা ঘুঘরাতলী মোড়ে এক একর জমি কেনেন।
মা আমেনা খাতুন ও বাবা প্রয়াত বাকী মণ্ডলের নাম অনুসারে প্রতিষ্ঠা করেন ‘এ বি ফাউন্ডেশন’। এই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয় ‘আমেনা-বাকী রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল’। এই স্কুলের শিক্ষার্থীদের বাইরে কোচিং করার প্রয়োজন হয় না। ছেলে-মেয়েদের হোস্টেলে রেখে বাড়তি চিন্তা করতে হয় না অভিভাবকদের। যাত্রা শুরুর মাত্র ১৩ বছরে মাথায় দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
ছায়াঘেরা ক্যাম্পাস: দিনাজপুর-পার্বতীপুর সড়ক দিয়ে ১৪ কিলোমিটার গেলে পাওয়া যাবে চিরিরবন্দর উপজেলার ঘুঘরাতলী মোড়। রাস্তার দক্ষিণ পাশে চোখে পড়বে পাকা প্রাচীরঘেরা আমেনা-বাকী রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের ক্যাম্পাস। স্কুলে ঢুকতেই দেখা যায় প্রধান ফটকসংলগ্ন চারতলা মেয়েদের হোস্টেল। নিচে আমেনা-বাকী ফাউন্ডেশনের কার্যালয়। এখান থেকে সামনে দুই সারি দেবদারুগাছের মাঝ দিয়ে ছোট পথ।
পথের বাঁ পাশে প্রশস্ত মাঠে রয়েছে শিশুদের বিনোদনের জন্য দোলনা, স্লিপার, ঢেঁকি ছাড়াও নানা কিছু। এর লাগোয়া পশ্চিমে স্কুলের ক্যাম্পাস। গাছের ছায়ার নিচে ইটের দেয়ালের ওপরে টিনের ছাউনি দিয়ে ঘেরা পাঁচটি বড় ভবন।
পূর্ব দিকের ভবনে স্কুলের অধ্যক্ষ ও শিক্ষকদের বসার কক্ষ ছাড়াও আছে প্রশিক্ষণকক্ষ, কম্পিউটার ল্যাব এবং দক্ষিণে বিজ্ঞানাগার, গ্রন্থাগার এবং স্কুল মিলনায়তন। এর পাশেই ছেলে ও মেয়েদের পৃথক খাবারের ঘর।
পশ্চিমের ভবনে আটটি এবং উত্তর দিকের ভবনে পাঁচটি শ্রেণীকক্ষ ছাড়াও শিশুদের জন্য একটি বিনোদনকক্ষ।
স্কুল ক্যাম্পাসের দক্ষিণ দিকে ফুটবল মাঠ। মাঠের পশ্চিমে লিচুবাগান। এর পশ্চিমে আরও দুটি খেলার মাঠ। মাঠের পূর্ব দিকে ছয়তলাবিশিষ্ট ছেলেদের আবাসিক হোস্টেল।
দক্ষিণ প্রান্তে শিক্ষকদের আবাস।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. মিজানুর রহমান পুরো স্কুল ক্যাম্পাস ঘুরিয়ে দেখালেন।
আমজাদ হোসেনের কেনা এক একর জমির ওপরে ২০০১ সালের ৫ জুলাই স্কুলটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। প্রথমে চালু হয় নার্সারি থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত। পরের বছর ষষ্ঠ এবং ২০০৪ সালে অষ্টম শ্রেণী চালু হয়।
২০০৯ সালে চালু হয় এসএসসি। টানা তিন বছর তৃতীয় শ্রেষ্ঠ স্কুল হওয়ার পর এ বছর স্কুলটি দিনাজপুর বোর্ডের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হওয়ার গৌরব অর্জন করে। এ বছর ৭৯ পরীক্ষার্থীর সবাই জিপিএ-৫ পেয়েছে।
বর্তমানে স্কুলের জমির পরিমাণ আট একর। দুই পালায় প্লে থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক হাজার ৪৭০ জন।
১৮ জন নারীসহ শিক্ষকসংখ্যা ৫৬। সম্প্রতি একাদশ শ্রেণী খোলার অনুমতি পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
নিয়মের মধ্যে: ১৩২ জন মেয়ে ও ২৬৫ জন ছেলে আবাসিক হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে। মেয়েদের জন্য চারজন নারী শিক্ষক ছাড়াও একজন আয়া সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করেন। ছেলেদের দেখভাল করেন ১৫ জন শিক্ষক।
আবাসিক শিক্ষার্থীদের জন্য লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা ও সংস্কৃতিচর্চা বাধ্যতামূলক। ধর্ম পালনের জন্য হিন্দু ও মুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে পৃথক নামাজ ও উপাসনার স্থান।
‘স্কুলের পড়ালেখা-থাকা খাওয়া, খেলাধুলা—সবকিছুই নিয়মের মধ্যে। এই নিয়ম ভঙ্গ করার কোনো জো নেই। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, আয়া, কুক, দারোয়ান—কারোরই নিয়মের বাইরে যাওয়ার উপায় নেই।
’ বলল আবাসিক হোস্টেলে থাকা এসএসসি পরীক্ষার্থী মনিকা আকতার।
ভোর পৌনে পাঁচটায় আবাসিক শিক্ষার্থীদের ঘুম থেকে ওঠা বাধ্যতামূলক। এরপর নামাজ, প্রার্থনা ও শারীরিক ব্যায়াম শেষে সকালের নাশতা। নাশতায় থাকে পায়েস, নুডলস, চিড়ার বিরিয়ানি, চা-টোস্ট, সেমাই মুড়ি, পাউরুটি-দুধসহ নানা খাবার। নাশতা শেষে শ্রেণীকক্ষে গিয়ে লেখাপড়া।
সকাল আটটায় ফিরতে হয় হোস্টেলে। বই রেখে পুনরায় ডাইনিংয়ে ভাত খাওয়া। সকাল নয়টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত স্কুলে কোচিং ক্লাস। ক্লাস শেষে হোস্টেলে ফিরে আবার পৌনে ১১টায় অ্যাসেম্বলিতে যোগ দেওয়া। বেলা একটা ২০ মিনিট পর্যন্ত ক্লাস।
দুইটার মধ্যে খেয়ে নিতে হয় দুপুরের খাবার।
বিকেল চারটায় স্কুল ছুটির পর শিক্ষার্থীরা কেউ মাঠে খেলে, কেউ কম্পিউটার ল্যাবে, কেউবা নাচ-গান, আবৃত্তিতে অংশ নেয়।
দশম শ্রেণীর আবাসিক শিক্ষার্থী বেলাল জানাল, পঞ্চম, অষ্টম ও দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা বিকেলে মাঠে যায় না। বিকেল চারটা থেকে সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত কোচিং ক্লাসে যায়। ক্লাস শেষে আবাসিক শিক্ষার্থীরা হোস্টেলে এবং অনাবাসিক শিক্ষার্থীরা বাসায় চলে যায়।
রাত সাড়ে ১০টার মধ্যে আবাসিক শিক্ষার্থীদের ঘুমাতে যাওয়া বাধ্যতামূলক।
সহশিক্ষা কার্যক্রমেও সাফল্য আছে এখানকার শিক্ষার্থীদের। নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী বনশ্রী রায় জাতীয় নৃত্য প্রতিযোগিতায় বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ছেলেদের দল হ্যান্ডবলে রংপুর বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে রাজশাহীতে খেলতে গেছে।
বেতন: এই স্কুলে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ভর্তি ফি ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে।
আর ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত বেতন সাড়ে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে। হোস্টেলে থাকার জন্য রয়েছে আলাদা খরচ।
সাফল্যের নেপথ্যে: আমেনা-বাকী রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলে খুব ভালো শিক্ষক যে আছেন তা নয়। কঠোর অনুশাসন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিকে শ্রেষ্ঠত্ব এনে দিয়েছে। এ মত দিনাজপুর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আলাউদ্দিন মিয়ার।
আর এ বছর এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থী মুনতাহা সারোয়ারের কথা, ‘আমরা একে অপরের প্রতি ভীষণ সহযোগী ছিলাম। সব শিক্ষার্থীর মনোভাব ছিল, একা নয়, সবাইকে জিপিএ-৫ পেতে হবে। শিক্ষকেরা যা পড়াতেন, যেভাবে পড়তে বলতেন, সমানভাবে মিলে পড়তাম। মিলিত প্রয়াসেই আমাদের সাফল্য। ’
ভবিষ্যতের স্বপ্ন: স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আমজাদ হোসেন ১৯৭১ সালে দেশের জন্য যুদ্ধ করেন।
এবার তিনি শুরু করতে চান সুশিক্ষিত-সুনাগরিক গড়ে তোলার আন্দোলন। ভবিষ্যতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় করার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর। আমজাদ হোসেনের এই উদ্যোগ সফল হোক—এমন প্রত্যাশা সবার।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।