বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাংসদ সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায়ের খসড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কম্পিউটার থেকে ফাঁস হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এমনটাই অনুমান করছেন ট্রাইব্যুনাল।
গতকাল বুধবার ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার ও মুখপাত্র এ কে এম নাসিরউদ্দিন মাহমুদ সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। ঘটনা উদ্ঘাটনে তদন্তের জন্য শাহবাগ থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে।
গত মঙ্গলবার ট্রাইব্যুনাল-১ মুক্তিযুদ্ধকালে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাকা চৌধুরীকে ফাঁসির দণ্ড দেন।
এরপর সাকা চৌধুরীর স্ত্রী ও পরিবারের অন্য সদস্যরা একটি নথি সাংবাদিকদের দেখিয়ে দাবি করেন, আগের রাত থেকেই বিভিন্ন ওয়েবসাইটে রায়ের অনুলিপি পাওয়া যাচ্ছে। সেটি আইন মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া গেছে বলে ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে।
গতকাল দুপুরে নিজ কার্যালয়ে নাসিরউদ্দিন মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, সার্বিক বিবেচনায় প্রাথমিকভাবে এটি অনুমান করা হচ্ছে, কথিত খসড়া রায় ট্রাইব্যুনালের কম্পিউটারে কম্পোজ করার পর কোনো না কোনোভাবে লিকড হয়েছে। বিষয়টি উদ্ঘাটনের জন্য ইতিমধ্যেই ট্রাইব্যুনালের নির্দেশক্রমে রেজিস্ট্রার থানায় জিডি করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করি, সত্য বেরিয়ে আসবে এবং এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে কারা জড়িত, তাদের চিহ্নিত করা যাবে।
ট্রাইব্যুনালে কর্মরত কেউ যদি এই অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত থাকেন, তবে তাঁর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’
এর আগে সকালে বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১-এর কার্যক্রম শুরু হলে রাষ্ট্রপক্ষ কথিত রায় ফাঁসের বিষয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালের নজরে আনে। এ সময় ট্রাইব্যুনাল একে ‘গভীর ষড়যন্ত্র’ উল্লেখ করে বলেন, ট্রাইব্যুনালকে বিতর্কিত করতে বিশাল অঙ্কের অর্থ ছড়ানো হয়েছে।
পরে ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে করা সংবাদ ব্রিফিংয়ে রেজিস্ট্রার বলেন, ট্রাইব্যুনালের আইন ও বিধি অনুসারে, রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তার সত্যায়িত অনুলিপি সব পক্ষকে দিতে হয়, যা অন্য আইনে নেই। এ জন্য পূর্ণাঙ্গ রায় চূড়ান্ত না করে ট্রাইব্যুনাল রায় দেন না।
পূর্ণাঙ্গ রায় মূলত ঘোষণার দু-এক দিন আগে চূড়ান্ত করা হয়। শুধু সাজাসংশ্লিষ্ট অংশটি রায়ের দিন বিচারকগণ একমত হয়ে চূড়ান্ত করেন।
নাসিরউদ্দিন মাহমুদ বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা আদালতের কর্মকর্তা। মঙ্গলবার রায় ঘোষণার জন্য বিচারকেরা আসন গ্রহণের পর আসামিপক্ষের আইনজীবীদের দায়িত্ব ছিল, কথিত রায় ওয়েবসাইটে আগের দিন রাতে পাওয়া যাওয়ার বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের নজরে আনা। কিন্তু আইনজীবীরা তা না করে আনুষ্ঠানিকভাবে রায় ঘোষণার পর কথিত রায়ের অনুলিপি গণমাধ্যমকে দেখিয়ে দাবি করেন, রায় আগেই ফাঁস হয়েছে এবং আইন মন্ত্রণালয়ের কম্পিউটার থেকে তা হয়েছে।
আসামিপক্ষের আইনজীবীর এ ধরনের উদ্দেশ্যমূলক আচরণ অসদাচরণের পর্যায়ে পড়ে। নিঃসন্দেহে রায় ঘোষণার পর এমন দাবি করা অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং ট্রাইব্যুনালকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চক্রান্তের অংশ।
ট্রাইব্যুনালের মুখপাত্র সাংবাদিকদের আরও বলেন, কথিত ফাঁস হওয়া রায়ের সঙ্গে মূল রায়ের মাত্র কয়েকটি স্থানে মিল আছে। কিন্তু তা আদৌ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার জন্য প্রস্তুত করা হয়নি। ট্রাইব্যুনালের ঘোষিত রায়ে অনুচ্ছেদ নম্বর উল্লেখ করা থাকলেও কথিত ফাঁস হওয়া রায়ে কোনো অনুচ্ছেদ নম্বর নেই।
স্পষ্টতই এটি একটি খসড়া, যা রায় ঘোষণার বেশ কয়েক দিন আগে কোনোভাবে ফাঁস করেছে দুষ্টচক্র। তারা আনুষ্ঠানিক রায় ঘোষণার ঠিক আগের রাতে খসড়াটি ওয়েবসাইটে দিয়েছে। এ থেকে এটি স্পষ্ট, একটি সংঘবদ্ধ চক্র যারা ট্রাইব্যুনাল ও এর বিচারিক কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চান এবং যারা এই অপকর্মের সুবিধাভোগী, তারাই এ কাজ করেছে।
জিডি: ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারের করা শাহবাগ থানার ৮৫ নম্বর সাধারণ ডায়েরিতে বলা হয়েছে, ১ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল-১-এ সাকা চৌধুরীর মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য ছিল। কিন্তু রায় ঘোষণার পরপরই আসামি সাকা চৌধুরীর পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রতিক্রিয়ায় জানান, ওই মামলার রায়ের অনুলিপি তাঁরা আগেই ইন্টারনেটে পেয়েছেন।
আদালত থেকে রায়ের অনুলিপি সরবরাহ করার আগেই আসামির স্ত্রী ফরহাত কাদের চৌধুরী ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ক্যামেরার সামনে একটি নথি দেখিয়ে বলেন, এই সেই ইন্টারনেট থেকে পাওয়া রায়ের কপি, যা তাঁরা রায় ঘোষণার আগেই পেয়েছেন এবং তা নিয়েই তাঁরা আদালতকক্ষে ঢুকেছেন। ফরহাত কাদের চৌধুরী আরও বলেন, আদালতের ঘোষিত রায় ও ইন্টারনেট থেকে পাওয়া রায়ের মধ্যে মিল রয়েছে।
জিডিতে বলা হয়, ট্রাইব্যুনাল ঘোষিত সব রায় ট্রাইব্যুনালেই প্রস্তুত করা হয়। রায় ঘোষণার আগে এর কোনো অংশের অনুলিপি অন্য কোনোভাবে প্রকাশের সুযোগ নেই। কিন্তু তার পরও কথিত খসড়া রায়ের অংশ কীভাবে ইন্টারনেটে প্রকাশিত হলো বা কীভাবে ট্রাইব্যুনাল থেকে খসড়া রায়ের অংশবিশেষ ফাঁস হলো, তা উদ্বেগের বিষয়।
www.tribunalleaks.be ওয়েবসাইটে কথিত খসড়া রায়ের অংশ দেখা যায়। বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতার জন্য হুমকি। এই অবস্থায় বিষয়টি তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
তদন্ত শুরু: আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ট্রাইব্যুনালের করা জিডির ভিত্তিতে ইতিমধ্যে তদন্ত শুরু হয়েছে। গোয়েন্দা পুলিশকে (ডিবি) তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
তিনি আশা প্রকাশ করেন, এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ পাবে এবং তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আইন মন্ত্রণালয় থেকে ট্রাইব্যুনালের রায় ফাঁসের সুযোগ নেই। যদি ফাঁস হয়েই থাকে, তবে তা ট্রাইব্যুনাল থেকে হয়েছে। তদন্তেই বিষয়টি বেরিয়ে আসবে।
তদন্ত দাবি আইনজীবী সমিতির: এ ঘটনায় সাবেক একজন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি।
গতকাল দুপুরে সমিতির দক্ষিণ হলে এক সভা থেকে এ দাবি জানানো হয়।
সভার সিদ্ধান্ত উপস্থাপন করেন সমিতির সম্পাদক মাহবুব উদ্দিন। এতে বলা হয়, রায় ফাঁসের ঘটনায় দেশে-বিদেশে উচ্চ আদালতসহ বিচারব্যবস্থার প্রতি জনমনে অশ্রদ্ধা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত যেকোনো উদ্যোগ নেওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেন রায়ের বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করায় তাঁর বিরুদ্ধে কয়েকজন প্রসিকিউটর এবং অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের কর্মকর্তারা ষড়যন্ত্রমূলক আচরণ করায় সমিতি তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।
প্রসঙ্গত, সাকা চৌধুরীর রায়ের পর খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছিলেন, এই বিচারের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, বাংলার মাটিতে তাঁদের সবার বিচার করা হবে।
জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম প্রথম আলোকে বলেন, খসড়া রায় ফাঁসের সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক না কেন, তাদের পেছনে যে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ট্রাইব্যুনাল-সংশ্লিষ্ট, নাকি বাইরের লোক খসড়া ফাঁসের সঙ্গে জড়িত, তা তদন্তে বের হয়ে আসবে।
কারা খসড়া রায় ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে—এ প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আমার মনে হয়, যাদের হাতে এ রায় প্রথমে দেখা গেছে, তারাই এর সঙ্গে জড়িত। না হলে, আর কেউ জানল না, আমরা পেলাম না, অথচ তাদের হাতে অনুলিপি চলে গেল কীভাবে?’
প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনালের তৎকালীন চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক ও বেলজিয়ামপ্রবাসী আইন বিশেষজ্ঞ আহমেদ জিয়াউদ্দিনের মধ্যে স্কাইপ কথোপকথন বিভিন্ন গণমাধ্যমে ফাঁস হয়।
ধারণা করা হয়, কম্পিউটারে কোনো রেকর্ডিং যন্ত্র বসিয়ে বা কম্পিউটার হ্যাক করে ওই তথ্য চুরি করা হয়েছিল। এর দুই দিন পর বিচারপতি নিজামুল হক পদত্যাগ করেন।
স্কাইপ কেলেঙ্কারির পর সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে এ বিষয়ে তদন্তের দাবি উঠেছিল। সরকারের পক্ষ থেকেও তদন্তের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে আর এই তদন্তের কোনো অগ্রগতি সরকার থেকে জানানো হয়নি।
ট্রাইব্যুনাল-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওই সময় স্কাইপ কেলেঙ্কারির তদন্ত করে দোষীদের ধরা গেলে এখন আবার রায়ের খসড়া ফাঁস হওয়ার মতো ঘটনা ঘটত না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।