আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিশ্বাসঘাতক

আমি এমন এক সাধারন মানুষ হতে চাই যে অসাধারন হবার পেছনে দৌঁড়ায়না এবং বিনা প্রশ্নে কিছু গ্রহন করেনা ।

নেট প্র্যাকটিস সেরে মিনিট পাঁচেক ধরে নক করলো বিনয় । যেই ব্যাটটা আগামীকালকের ম্যাচে ব্যবহার করবে তাকে একটু ভালোভাবে পরখ করে দেখতে চায় বলে নক করা । ঠিকঠাক বল মিডল করতে পেরেছে নেটে আজকে । আগামীকালকের ম্যাচের জন্য চমৎকার প্রস্তুতি তাতে সন্দেহ সামান্যই ।

সূত্রাপুর ক্লাবের কোচ সালাউদ্দীন বেশ কয়েকদিন যাবত চিন্তিত বিনয়ের ফর্ম নিয়ে । ইদানিং প্রায়শই শ্যাফল করতে গিয়ে হয় লেগ বিফোর নয়তো মিস করে বোল্ড হচ্ছিলো বিনয় । শুধু মাঠেও নয় নেটেও । সমস্যাটা নিয়ে সালাউদ্দীন বিনয়কে সাথে নিয়েই কাজ করেছেন দিন চারেক । আজকে ফলাফল দেখতে পেলেন নেটে ।

শেষ বিকালের আগেই অন্য সবাই চলে গেছে । ক্লাবের টেন্টে সালাউদ্দীন আর বিনয় বসে আছে । সালাউদ্দীন ভেতরে ভেতরে নার্ভাস অনুভব করছেন । আগামীকালকের ম্যাচটা ডু অর ডাই ম্যাচ সূত্রাপুর ক্লাবের জন্য । জিতলে তবেই রেলিগেশন এড়ানো যাবে ।

নয়তো সেকেন্ড ডিভিশনে পঁচে মরতে হবে বছর তিনেক । এভাবে হলফ করে তিন বছর বলে দেওয়া যায় কারণ রেলিগেটেড দলগুলো তিন বছরের আগে দ্বিতীয়বার চ্যাম্পিয়নশীপে সুযোগ পায়না । দ্বিতীয় বিভাগের অন্য দলগুলোকে সুযোগ করে দিতে বাধ্যতামূলকভাবে কিছু ম্যাচ ছেড়ে দিতে হয় । বছর দুয়েক আগে তাদের সুযোগ করে দিতে আলোকিত সঙ্ঘকেও বেশ কিছু ম্যাচ ছেড়ে দিতে হয়েছিলো । এর সবই সিস্টেম যার কাছে দিনের শেষে সবাই নতজানু হয়ে থাকে ।

দুইজনে বিশেষ কথা বলছিলোনা । বিনয়ই প্রথমে নীরবতা ভেঙ্গে কথা বললো , “ আজকে ফ্রন্ট ফুট ঠিক জায়গাতে ছিলো তো সালাউদ্দীন দা ? ঠিক করেছি আগামীকাল লেগ স্ট্যাম্প গার্ড নিয়ে খেলবো । অফ সাইডের বাইরের বলগুলো কানেক্ট করতে সমস্যা হবেনা । আমি প্র্যাকটিস করে দেখেছি । রেঞ্জারের সেই ছয় ফুটের ফাস্ট বোলার শফিউলই কেবল ডেঞ্জার ।

ওকে রয়ে সয়ে খেলে হাতে উইকেট রাখতে পারলে আগে ব্যাট করে হোক কিংবা চেজ ম্যাচ বের করে নেওয়া যাবে । “ “ উহু অত কমপ্লেকেন্সি দেখাসনা । সবসময় মনে রাখবি যে জীবনের অন্য কোন জায়গাতে হোক না হোক খেলার মাঠে কমপ্লেসেন্ট হতে নেই । এরকম কোন এটিটিউড স্পোর্টসম্যানদের থাকলে চলবেনা । এই করে করে আমাদের কেউ স্পোর্টসম্যান হয়ে উঠতে পারেনা ।

দুই একদিনের মধ্যেই ফুটুশ হয়ে যায় । “ লম্বা দীর্ঘশ্বাস গোপন করবার চেষ্টা করলোনা সালাউদ্দীন । বিনয় প্রিয় সালাউদ্দীন দার ট্র্যাজেডি সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবেই ওয়াকিবহাল । মানুষটাকে ভালোবাসে অনেক । সেই কারণে চুপ করে রইলো কিছুক্ষণ ।

খেলোয়াড় আসে , খেলোয়াড় যায় । দর্শকের ভালোবাসা থেকে শুরু করে সমস্ত সুযোগ , সুবিধা কেবল খেলোয়াড়দেরই । সালাউদ্দীন দারা খেলোয়াড় তৈরী করে দেওয়ার যন্ত্র বিশেষ । তাদের দিকে চোখ যায়না কারো । বিনয় জীবনে খুব বেশী কিছু চায়নি ।

আসলে কিছু চাইবার মতো বাস্তবতাই তার জীবনে এখনো তৈরী হয়নি । বিনয় প্রতিজ্ঞা করলো যেভাবেই হোক আগামীকাল সালাউদ্দীন দার মাথা সে উঁচু করবেই করবে । তারা কেউই অন্তর্যামী নয় । নাইলে বিনয় জানতে পারতো ঠিক সেই সময় সালাউদ্দীন দা ভাবছিলো একমাত্র বিনয়ের পক্ষেই সম্ভব আগামীকাল তাকে বাঁচিয়ে দিতে । ছেলেটাকে কি অসম্ভব ভালোবাসেন সেটা কখনো মুখ ফুটে বলেননি ।

জানতেও চাননি যে বিনয় এই তীব্র ভালোবাসা অনুভব করতে পারে কিনা । ঠিক এই সময়তে দুইজনে একে অপরের দিকে তাকায় । উভয়ের চোখের ভাষাতেই অনুক্ত বাক্যমালা সমূহ জ্বলজ্বল করতে থাকে । সন্ধ্যা পেরিয়ে প্রায় রাত হতে চললে দুইজনেই উঠে দাঁড়িয়ে যার যার বাড়ীর দিকে পথ ধরলো । বিনয়ের বাড়ীর অবস্থা আজকের তীব্র কাঠফাঁটা গরমের মতই অকৃপণ ।

হাইস্কুলের হেডমাস্টার বাবা সুধীর মিশ্র নিজের কাঁধে সংসারের জোয়াল বয়ে বেড়াতে বেড়াতে কাউকে কোন সুযোগ না দিয়ে হার্টস্ট্রোকে মারা গেলে জীবনকে প্রথম চিনতে শিখেছিলো বিনয় । তারপর মাস পাঁচেকের মধ্যে দাদা চাকরী পেয়ে গিয়েছিলো একটা । বরাবরই মনোযোগী , ভালো ছাত্র ছিলো । ঠিক বাবা তার সন্তানদের যেমনটা হতে দেখতে চাইতেন । বছর দুয়েক হলো দাদা বিয়ে করে বউদি নিয়ে আলাদা হয়ে গিয়েছে ।

এই নিয়ে বিনয়ের মা , বিনয় কারোই কোন অভিযোগ নেই । এই খুপড়ি ঘরের মতো বাড়ীতে কেন দাদা – বউদি কষ্ট করে পড়ে থাকবে ? তাছাড়া মাস শেষে দাদা বাড়ীতে যেই টাকা পাঠায় তাতে বিনয় , তার বৃদ্ধা মা এবং ছোট বোনটার মোটামুটি চলে যায় । বিনয়ের জীবনে শখ – আহ্লাদ বিশেষ নেই । কেবল ঘড়ির প্রতি মারাত্মক এক দুর্বলতা কাজ করে সেই ছোট থেকেই । একবার দাদার এক বন্ধুর হাতে রোলেক্স ঘড়ি দেখেছিলো ।

দৃশ্যটা আজও ভুলতে পারেনি বিনয় । সেই রোলেক্স ঘড়িটাও নয় । বাড়ীতে প্রবেশ করে পুরনো এসব কথা ভাবছিলো সে । তার মা সান্ধ্যকালীন স্নান সেরে বিনয়কে ডাকতে গেলে বাড়ীর দরজায় মৃদু শব্দে কেউ কড়া নাড়ে । বিনয় দরজা খুলতে এগিয়ে যায় ।

৬৮ রানে ৪ উইকেট নেই । ওভার চলছে ১৪ , বাকি ৩৬ ওভারে রান তুলতে হবে ১৭৮ । ঠিক এমন ইকুয়েশন মাথায় রেখে ফোর্থ ডাউনে ব্যাট করতে নামলো বিনয় । সালাউদ্দীন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাঠের দিকে । তার মাথা শূন্য ।

এই মুহূর্তে আগে পিছে কিছু ভাবতে চাইছেনা সে । দুইদিন আগে খবর পেয়েছিলো স্যাবোটেজ করবার জন্য তার দলের তিনটা প্লেয়ার গট আপ । দুইজনের পরিচয় জেনে গেছে । বছর আঠারো হলো মাঠের সাথে প্রণয় । বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে এসব ধরে ফেলতে সময় লাগেনা তার ।

কিন্তু এখন এই সম্পর্কে করনীয় নিয়ে কিছু ভাবছেনা সালাউদ্দীন । তার একমাত্র ভরসা বিনয় । কেবল বিনয়ই পারে তাকে বাঁচাতে । বিনয় পীচে প্রবেশ করে প্রথম তিনটি বল খেলেই বুঝতে পারলো উইকেট বেশ স্লো । সহজে বল ব্যাটে আসবেনা ।

সে রেঞ্জারের বোলারদের মধ্যে ছয় ফুটের শফিউলকেই থ্রেটনিং মনে করেছিলো । কিন্তু এখন মনে হচ্ছে স্পিনারেরাই আসল চ্যালেঞ্জ । প্রথম চল্লিশ বল পর্যন্ত যখন কোন রিস্ক না নিয়ে কেবল সিঙ্গেলসের উপর খেললো বিনয় ততক্ষণে আরো ২টি উইকেট পড়ে গেছে । আস্কিং রেট প্রায় পৌঁনে ছয়ের কাছাকাছি । বিনয় সিদ্ধান্ত নিলো আর ঠুকে , পীঠ বাঁচিয়ে খেলা নয় ।

কিছুক্ষণ কাউন্টার এটাকিং খেলা চলুক । স্পিনারগুলোর বলের ফ্লাইট থেকে শুরু করে ভ্যারিয়েশন সবই ফিগার আউট করতে পেরেছে । বাঁহাতি যেই স্পিনার রাউন্ড দা উইকেটে বাতাসে বল ফ্লাইট করতে চাইলো তাকে ডাউন দা উইকেটে এসে সাইজ করে নিয়ে ছয় মারলো ৩৫ ওভারের প্রথম বলে । ব্যাটে লাগবার সাথে সাথেই বুঝেছিলো বল সীমানার বাইরে যেতে চলেছে । সেই ওভারে ষোল রান তুললো বিনয় এবং তার স্ট্রাইকিং পার্টনার ।

ছেলেটা এই প্রেশার ম্যাচে নার্ভাস ফিল করে কুঁকড়ে ছিলো এতক্ষণ । এভাবে আরো চার ওভারে তারা রান তুললো সাতচল্লিশ । আস্কিং রেট তখন মাত্র পৌঁনে পাঁচে নেমে গেছে । এমন সময় রেঞ্জারের ছয় ফুট লম্বা ফাস্ট বোলার শফিউল এলো তার দ্বিতীয় স্পেলে । ইকোয়েশন হলো দশ ওভারে ছিচল্লিশ রানের ।

বলটা অফ স্ট্যাম্প বরাবর পীচ করে সাঁই করে বেরিয়ে যাচ্ছিলো । পূর্বের প্ল্যান অনুযায়ী বিনয় লেগ স্ট্যাম্প গার্ড নিয়ে খেলছিলো এবং বল মিডল করতে কোন সমস্যা হচ্ছিলোনা তার । এই বলটাও মিডল করতে পারলো । ডিপ এক্সট্রা কভারে বল ঠেলে দিয়ে অনায়াসে দুই রান হয়ে যাবার কথা । এমন সময়েই অকল্পনীয় ঘটনাটি ঘটে গেলো ।

দ্বিতীয় রান নেওয়ার সময়ে শুকনো , খটখটে পিচে বিনয় আছাড় খেয়ে পড়ে গেলো । এতো তাড়াতাড়ি ঘটলো বিষয়টা যে মাঠের খেলোয়াড় সমেত মাঠের বাইরের দর্শকসমূহ প্রত্যেকেই অবাক হয়ে গেলো । বিনয় আছাড় খেয়ে দৌঁড়াতে শুরু করতেই হ্যামস্ট্রিঙে টান খেলে স্ট্রাইকিঙ এন্ডে পৌঁছানোর আগেই উইকেটকিপার গ্লাভসে বল নিয়ে বেইল ফেলে দিলো । বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়েরা মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি এমন অনুভূতিতে উল্লাসে মেতে উঠলো । এই প্রচন্ড গরমেও মাথা থেকে হেলমেট না খুলেই দর্শকদের তুমুল হইহইয়ের মাঝে বিনয় প্যাভিলিয়নে ফিরে আসছে ।

সে অনেক কষ্টে সালাউদ্দীনের দিকে একবার তাকাতে চেষ্টা করলো কিন্তু পারলোনা । এই মুহূর্তে বিনয়ের সেই সাহস আর অবশিষ্ট নেই । এক রোলেক্স ঘড়ির কাছে পরাজিত হয়ে চিরতরে সালাউদ্দীন দার সাথে সম্পর্কের সকল সুতা ছিঁড়ে ফেলেছে বিনয় । যেই সময়ে তার অনুশোচনা হতে শুরু করলো তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে । ছাব্বিশ রান দরকার কিন্তু হাতে আছে মাত্র এক উইকেট ।

বছর সাতেক পরের কথা । দেশের খ্যাতিমান ক্রিকেটার বিনয় মিশ্রের ম্যাচ ফিক্সিঙ কেলেঙ্কারীর ফাঁস হওয়া নিয়ে পত্রপত্রিকা সহ চারিদিকে হইচই । কেউ বুঝতেই পারছেনা বিনয় মিশ্র এমনটা করে থাকতে পারে । সেই সকালে উঠে প্রতিদিনের মতো অনেক কসরৎ করে ক্র্যাচ দুটো সরিয়ে রেখে পত্রিকাগুলো পড়তে শুরু করে অর্থাভাবে পঙ্গু হয়ে যাওয়া সালাউদ্দীন । সময়ের অতলে হারিয়ে যাওয়া সূত্রাপুর ক্রিকেট ক্লাবের কোচ ।

যদিও মানুষ ক্লাবটিকে মনে রেখেছে বিনয় মিশ্রের প্রথম ক্রিকেট ক্লাব বলে ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।