হলভর্তি দর্শক। অধীর আগ্রহের অবসান ঘটিয়ে এখন মঞ্চস্থ হবে শেক্সপিয়ারের নাটক হ্যামলেট। কিন্তু এ কী! নাটকের সব অভিনেতা-অভিনেত্রী একবারে এসে চেহারা দেখিয়ে চলে গেলেন। পর্দা নেমে গেল। মিনিট দুই পরে পর্দা উঠলে হ্যামলেট-এর শেষ দৃশ্যের মতো কিছু মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা গেল মঞ্চের এখানে-ওখানে।
তাহলে মাঝখানের অভিনয় কি উপভোগ করতে পারবে না দর্শক? না, পারবে না। পদার্থের মধ্যকার রাসায়নিক বিক্রিয়ার বেলায়ও ঠিক এমনিভাবে অনেক দিন ধরে হতবুদ্ধি হয়ে থাকতে হয়েছিল বিজ্ঞানীদের। বিক্রিয়ার আগে কে কে ছিল আর পরে কে কে এল—এ ব্যাপারটাই বড় বড় প্লাস্টিকের রংবেরঙের বল বানিয়ে বুঝতে হতো আমাদের। মাঝের অংশে তড়িৎগতিতে ঘটে যাওয়া বিক্রিয়াটি ঠিক কীভাবে হলো তা ছিল ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
১৯৭০-এর দশকে মার্টিন কারপ্লাস, মাইকেল লেভিট ও এরিখ ওয়ারশেলের তৈরি করা কম্পিউটার সিম্যুলেশনই বিক্রিয়ার মধ্যকার ঘটা সিনেমাটা দৃশ্যমান করেছে আমাদের সামনে।
আর এটাই বর্তমান ওষুধশিল্পের বিপ্লবের পেছনের মূল চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করে গেছে।
এবার দেখা যাক এই তিন বিজ্ঞানী আসলে কী করেছেন। সেটা দেখার আগে পদার্থবিজ্ঞানের একটা চিরচারিত দ্বন্দ্বের কথায় আসি। দ্বন্দ্বটা হলো নিউটনীয় পদার্থবিজ্ঞানের সঙ্গে নিলস বোরের পদার্থবিজ্ঞানের। আরও সহজভাবে বললে চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের সঙ্গে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার।
অপেক্ষাকৃত কম গতির বড় বস্তুর জন্য চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞান খাটে কিন্তু অতিক্ষুদ্র বস্তুর বেলায় চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের স্বল্প হিসাব আর কূল-কিনারা পায় না। সেখানে দরকার পড়ে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার। রাসায়নিক বিক্রিয়ায় সংঘটিত অণু, পরমাণু, ইলেকট্রনের নাচন এত দ্রুত সংঘটিত হয় যে সেখানে চিরায়ত পদার্থবিদ্যার স্বল্প হিসাব-নিকাশ হার মেনে যায়। দরকার পড়ে জটিল হিসাব-নিকাশময় কোয়ান্টাম বলবিদ্যার। কিন্তু কোয়ান্টাম বলবিদ্যার মাধ্যমে বিক্রিয়া মধ্যস্থ সেই বিশাল ঝক্কি-ঝামেলাময় হিসাব-নিকাশ করতে আমাদের এখনকার অতিশক্তিশালী কম্পিউটারগুলোও ব্যর্থ হয়।
তাহলে উপায়? হ্যাঁ, ঠিক এই জায়গাতেই আমাদের আলো দেখিয়েছেন এই তিন বিজ্ঞানী। চিরায়ত বলবিদ্যার কম হিসাব-নিকাশের সুবিধা আর কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সূক্ষ্মতার পরিমাপকে কাজে লাগিয়ে তারা রাসায়নিক বিক্রিয়ার চলচ্চিত্র তৈরি করতে সমর্থ হয়েছেন।
মনে করুন, আপনি একটা ওষুধ খেলেন। সেই ওষুধের অণু দেহের কোনো একটা প্রোটিনের সঙ্গে আবদ্ধ হয়। তো এত বড় প্রোটিন অণু তার সঙ্গে এই ওষুধ অণু বিক্রিয়া কীভাবে করবে তা পুরোটা হিসাব-নিকাশ না করে তাঁরা একটা মজার কাজ করলেন।
ওষুধ অণু প্রোটিনের যে যে পরমাণুতে পরিবর্তন আনবে, তাঁরা সেগুলোর হিসাব করলেন জটিল কোয়ান্টাম বলবিদ্যার মাধ্যমে। আর বাকি বিশাল প্রোটিন অণুর গতিবিধির হিসাব কষলেন নিউটনীয় চিরায়ত বলবিদ্যা দিয়ে। ব্যস, কাহিনি খতম। সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না। বাস্তবতার কৃত্রিম রূপ দেওয়ার জন্য তাঁরা তৈরি করলেন কম্পিউটার প্রোগ্রাম।
আর এই সিম্যুলেশন প্রোগ্রামে তৈরি হয়ে গেল রাসায়নিক বিক্রিয়ার চলচ্চিত্র।
সত্তরের দশকে এই অসাধারণ কাজটি করে এবারে অর্থাৎ ২০১৩ সালের রসায়নে নোবেল জিতে নিলেন এই তিনজন। ৯ অক্টোবর দি রয়েল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সসেস এ বছরের জন্য রসায়নে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এই তিনজনের নাম ঘোষণা করে।
অস্ট্রিয়ান বংশোদ্ভূত মার্কিন বিজ্ঞানী মার্টিন কারপ্লাসের জন্ম ১৯৩০ সাল অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায়। ১৯৫৩ সালে ক্যালটেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি অর্জন করা এ বিজ্ঞানী এখন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নের অধ্যাপক।
মাইকেল লেভিটের জন্ম ১৯৪৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায়। ১৯৭১ সালে পিএইচডি করেছেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বর্তমানে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব মেডিসিনের অধ্যাপক। ক্যানসার নিয়ে গবেষণা করছেন তিনি। আর ১৯৪০ সালে ইসরায়েলে জন্ম নেওয়া এরিখ ওয়ারশেল পিএইচডি করেছেন ১৯৬৯ সালে, উইজম্যান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স থেকে।
বর্তমানে তিনি ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ায় রসায়নের অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছেন।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।