আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিজেরা বসুন না হলে সিদ্ধান্ত আমরা নেব

তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও বন্দর জাতীয় সম্পদ রক্ষা কমিটিকে অভিনন্দন। স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ সচেতন জনগোষ্ঠীর সংগ্রামী নাগরিকরা প্রতিবার লোকবিরোধী সিদ্ধান্ত এবং পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে প্রতিবাদ-প্রতিরোধে সোচ্চার এবং দেশব্যাপী জনগণকে জাগ্রত করে চলেছে। আমাদের দেশের কর্তাব্যক্তি, বিশেষজ্ঞ নামের কতিপয় দোসর নির্লজ্জের মতো দেশীয় সম্পদ নিয়ে যে অপখেলা খেলছে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও বন্দর জাতীয় সম্পদ রক্ষা কমিটির সদস্যরা।

সরকার যখন জনগণের এবং গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, তখন দেশের মালিক সেই জনগণকে আস্থায় নিয়ে তাদের জন্য নিঃস্বার্থ আন্দোলনকারী প্রকৌশলী, অর্থনীতিবিদ, ভূতত্ত্ব বিশারদ, বিজ্ঞানী, নানা চক্রান্তে বিধ্বস্ত স্থানীয় জনগণের সত্যিকার প্রতিনিধিদের নিয়ে একবারও বসতে পারলেন না? সরকার কেন জনগণকে উপেক্ষা করে এক উপদেষ্টার 'অমূল্য' উপদেশে নেচে চলেছে, আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। নাইকোর পরিণতি মানুষ জানে।

ফুলবাড়ী ও কানসাটে প্রাণ দিয়ে রুখে দিয়েছিল স্থানীয় জনগণ। তবে কি সংখ্যাগরিষ্ঠতায় প্রবল সরকার ওই উপদেষ্টার উপদেশ মেনে আবারও প্রাণ হননের ফন্দি-ফিকির করছে? কিন্তু কার স্বার্থে?

সামনে জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক না অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাধ্যমে হবে, তা নিয়ে দুই প্রধান দলের তীব্র বাহাস চলছে। এরা বলছে, তত্ত্বাবধায়ক না হলে হাসিনার অধীনে নির্বাচন হবে না। হবে সরকার পতনের আন্দোলন।

খালেদা তো রাজপথের ডাকও দিয়েছেন। 'ভাড়াটিয়া' দিয়ে যে আন্দোলন হয় না, তা তো তারা বুঝেই গেছেন। না হলে মহাজোটের মেয়াদ তো শেষ কিন্তু একদফার আন্দোলন, সরকার পতনের সংগ্রাম তো দেখলাম না। এদের দাবির বিপরীতে বিরোধীদলীয় "যুক্তিতর্ক উপেক্ষা করে হাসিনা সরকার সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের কথা বলেই যাচ্ছেন। বিদেশি কতজন যে চেষ্টা করলেন এই 'লড়াই' থামিয়ে সন্ধির মাধ্যমে বিষয়টি ফয়সালা করতে।

কিছুতেই কিছু হলো না। কি জানি, দুই দলের কার জোর কার কৌশলে? জনগণকে যে কেউ তোয়াক্কা করছে না, এটা আমরা বুঝতে পারছি। তবুও সেই সাধারণ মানুষের কাঁধেই বন্দুক রেখে শিকার করতে চাইছে দুই দলই। না হলে খালেদা জিয়া এই তো সেদিন খুলনার জনসভায় ঘোষণা দিয়েছেন_ রামপালে তাপবিদ্যুৎ করতে দেওয়া হবে না। " কোন মানসিকতায় বললেন, বুঝলাম না।

এ কি তার 'নির্বাচনী স্টান্ট?' পাঠক নিশ্চয়ই ভুলে যাননি সেই ফুলবাড়ীর মেয়ে-মরদ, মজুর আর কিষান-কিষানীর প্রবল আন্দোলনের কথা। যে গণআন্দোলনে ফুলবাড়ী অঞ্চলে কয়লা উত্তোলন নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের ওপর এই খালেদা জিয়ার আমলেই ১০ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। হাতের রক্ত মুছে ফেলে নির্বাচনের আগে মানুষের কাছে এমন কথা বললেন কি করে, কার জোরে, তা জানি না। আবার বর্তমান সরকারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন যেহেতু সামনে, তখন তড়িঘড়ি সব প্রকল্প উদ্বোধন, অসমাপ্ত, অসম্পন্ন হলেও সেসবে উদ্বোধনী পাথরের গায়ে শেখ হাসিনা নামটা খোদাই করে যেতে। যেমনটি আগেরবার আওয়ামী সরকারের প্রায় শেষ প্রকল্পে খালেদা এসে সর্বত্র তার নামে ভিত্তিপ্রস্তর বসিয়ে দিয়েছিলেন।

এই যে নির্বাচনী লড়াইয়ের বাগ্যুদ্ধ কিংবা বচন-কুস্তি শুরু হয়েছে, তাতে জনগণ বস্তুতই বিভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। এই বিভ্রান্তির ফায়দা লুটতে চেষ্টা করছেন দুই নেত্রীই এবং তাদের দলও!

খালেদা যে 'রামপাল অভিযান'কে সমর্থন জানালেন, লোকে বলাবলি করছে, হাসিনা রামপালে তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের উদ্বোধন করায় আগামীতে ক্ষমতায় খালেদা সরকার যদি এসেই যায়, তবে আবার ১০ জন মানুষ মারার সুযোগ পেয়ে যাবেন। কারণ এখন বিরোধী দলে বলে সরকারের বিরোধিতায় এমন কথা বলছেন জনসভায়। কিন্তু এরা ক্ষমতায় এলে এই জনগণকে হত্যা করতে দ্বিধা করে না। সেই সঙ্গে কানসাটের হত্যাকাণ্ড মনে করলে গা শিউড়ে ওঠে।

খালেদাই হত্যা করেছিলেন সেখানকার ১০ জন লড়াকু নিম্নমাধ্যবিত্ত মানুষকে। কারণ উচ্চবিত্ত, আমলা এবং পরদেশি স্বার্থ সংরক্ষণ করতে হবে তো!

এসবের বিচারে 'রামপাল লংমার্চ' অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখতে হবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুনিয়াজুড়ে যে অশান্তি সৃষ্টির অপপ্রয়াসে কারও কারও ঘাড়ে চেপে অনাসৃষ্টির মওকা তৈরি করছে। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনকে ঠেকানোর জন্য ভারতকে কব্জা করে তাদের মাধ্যমে আমাদের শায়েস্তা করার নানাবিধ কৌশল আঁটছে। এ দুটি প্রধান দলকেই 'গুড হিউমার'-এ রাখার চেষ্টা করে নিজেদের 'লাভের গুড়' যেন পিঁপড়ে না খায়, তার দিকে সজাগ হয়েই এই দ্বিচারী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।

না হলে লন্ডনে মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তা কেন তারেকের সঙ্গে বৈঠক করতে যান? ওখানে হয়তো তারেক ফর্মুলার নতুন ধারার রাজনীতি সম্পর্কে শুনতে ও জানতে গেছেন মার্কিন মুলুকের চতুর কূটনীতিকরা! এদিকে সরকারের সঙ্গেও তো 'সুসম্পর্ক' বজায় রাখতেই হবে। ...এসব কারণেই রামপাল গুরুত্ব বহন করছে।

সুন্দরবন আমাদের গর্বের, ঐতিহ্যের জীববৈচিত্র্যময় বিশ্বখ্যাত বনাঞ্চল। এর খানিকটা ভারতে খানিকটা বাংলাদেশে। দুই দেশেরই স্বার্থ জড়িত এই সুন্দরবনে।

আমরা তো এই সুন্দরের গৌরবকে পৃথিবীর অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে অন্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে কতদিন থেকে লড়ে যাচ্ছি। সরকার এমন প্রচার-প্রচারণাও চালিয়েছে। জনগণ, নানা সংস্থা এই প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য ও সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থানটি শ্রেষ্ঠ আসনে বসানোর লড়াই থেকে বিরত হয়নি। অথচ এর মধ্যেই এমন এক 'প্রকল্প' নিয়ে সরকার শত মুখে বলছে, এতে কোনো ক্ষতি হবে না। অথচ স্থানীয় জনগণ তো ক্ষুব্ধ বটেই, এ ছাড়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বসতি ও জনগণের এমনকি জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হবে।

সরকারের এক উপদেষ্টা বলছেন, কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু অর্থমন্ত্রী তো নানান কথার মধ্যে স্বীকার করেছেন, কিছুটা ক্ষতি হবে। ... তবে মানুষের যে ক্ষতি হবেই এবং ইতোমধ্যে হয়েছে, তা তো তারাই বলছেন, সেখানে গিয়ে শুনুন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা। উপদেষ্টা মহাশয় নিশ্চয়ই গিয়েছিলেন, জানেন, সব কিছু। প্রকল্পের জন্য জমি দখল, তাদের মূল্য পরিশোধের কতটা তারতম্য।

সবচেয়ে বড় কথা, সুন্দরবন আমাদের গৌরব। সৌন্দর্যের লীলাভূমি, মরণ প্রতিরোধকারী বনাঞ্চল, জীবজন্তুর কি বিশাল প্রাকৃতিক অভয়ারণ্য। এ তো মনুষ্য জীবনের নানা প্রকৃতির বন্ধু। একে ধ্বংস করতে কেন এত অপচেষ্টা?

সরকারকে বলি, ভুল না শুধরে নির্বাচনকে উপজীব্য করে যে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য আবার নৌকায় ভোট দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী প্রতিটি সভা-সেমিনারে দেশে-বিদেশে জাতিসংঘে পর্যন্ত আবেদন জানিয়ে যাচ্ছেন, এই 'রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প' নিয়ে যে পরিস্থিতি ক্রমশ তৈরি হচ্ছে, তা কি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত। যদি কোনো কারণে পুনরায় নির্বাচিত হতে না পারে, তবে কি বিরোধী দলকেই সহায়তা করা হবে না? ওরা এখন রামপাল প্রকল্পের বিরুদ্ধে বলছে, ক্ষমতা যদি পেয়ে যায়, তাহলে তো কথাই নেই মহাজোট সরকারের রেখে যাওয়া প্রকল্প চালু করে নিজেরা কৃতিত্ব নিতে গিয়ে না জানি তখন কত মানুষকে আবার হত্যা করে।

তাই সরকারকে অনুরোধ, সত্যিই যদি জনগণে বিশ্বাস রাখেন, তাহলে খালেদা জিয়ার আজকের কপট চেহারা জনগণের সামনে খুলে দেওয়ার সুযোগ গ্রহণ করুন। জনগণ যা চায়, তাদের সঙ্গে থাকুন। তাতে নিজেদের দুর্বলতা প্রকাশ পাবে না। ... মনে রাখবেন, জনগণ কিন্তু আমাদের চেয়ে অনেক বুদ্ধিমান। তারা ভাবছেন, নির্বাচন সামনে নানা প্রকল্প শুরু বা শেষ করার আগেই উদ্বোধন করা হচ্ছে।

কারণ যদি ফিরে না আসতে পারেন, তাহলে যেন ক্রেডিটটা বিএনপি বা খালেদা নিতে না পারেন। আর যদি আসতে আবার পারেন তবে তো কথাই নেই শুরু করারটা শেষও করবেন এবং অসমাপ্তটিও সমাপ্ত করতে পারবেন পরবর্তী পাঁচ বছরে। তবে এ দেশের জনগণের নাড়ি হলো সরকারবিরোধী। সে ক্ষেত্রে বিগত মেয়াদে যত ভালো কাজ করে দেশের নানা ক্ষেত্রে উন্নয়ন সাধন করেছে এই সরকার, তা ঢাকা ফেলে দিয়েছে বিরোধী দল সরকারবিরাধী নানা মিথ্যাচার ও অপপ্রচারে। ফলে জনগণ প্রচণ্ড সরকারবিরোধী হয়ে উঠেছে।

এ কথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। অবশ্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, শাস্তির রায় মানুষকে ক্ষমতাসীনদের প্রতি একটা আস্থাভাব ফিরে পেয়েছে বলে মনে হয়। সুতরাং সে কথা মনে রেখে সরকার এবং বিরোধী দলকে চলতে হবে। বিএনপি এখন অনেকটা ছন্নছাড়া। জামায়াত হতাশাগ্রস্ত এবং মিত্রের ওপর ক্ষুব্ধ।

ফলে বিরোধী দলের হয়ে যে হুমকি দিচ্ছেন খালেদা, হাসিনা ক্ষমতাসীন হয়েও তাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন। এখানে কিন্তু অন্যদের পরামর্শে নয়, দুই জোট বা দল সমঝোতায় যদি সংলাপের পথ ধরেন তবে যে অকারণ শঙ্কায় ভুগছে দেশ, তা থেকে আমরা জনগণ মুক্তি পেতে পারি। কিন্তু দুই নেত্রী কি বসবেন? অনেকেই বলেন, কে বসবে কার সঙ্গে। ঘটকালির জন্য দেশের মানুষই দরকার। বলছেন তো অনেকেই।

তারা একত্রিত হয়ে কেন দুই নেত্রীর সঙ্গে দেখা করছেন না? বলছেন না, বসুন। দেশ আমাদের। আমরা বলছি, বসুুন আপনারা। না হয় আমরা জনগণ যে কোনো সিদ্ধান্ত নেব।

লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

 

 



সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.