আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভারত বিভাগের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের তৎকালীন নেতৃত্বের ভূমিকা

ভবিষ্যতের আবরণ উন্মোচিত হয় ধীরে ধীরে, অথচ মানুষকে কাজ করে যেতে হয় দিন থেকে দিনে

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক শিক্ষক আনন্দ বিকাশ চাকমার প্রকাশিত একটি লেখাকে কেন্দ্র করে ফেসবুকে যে আলোচনা চলছে তার সূত্র ধরেই আমি নিচের পয়েন্টগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেছি পাঠক মহলে। “ভারত বিভাগ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম” শিরোনামে আনন্দ বিকাশ চাকমার লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি পত্রিকা’র জুন, ২০১৩ সংখ্যায় একত্রিংশ খন্ডে। লেখায় লেখক ভারত বিভাগের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের নেতৃত্বেনর ভূমিকা নিয়ে পর্যালোচনা করেন। তার প্রবন্ধের প্রারম্ভিব বক্তব্যের সারসংক্ষেপ অশে বলা হয়েছে- আলোচ্য প্রবন্ধে ১৯৪৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পূর্ব বাংলার (বর্তমান বাংলাদশের) সঙ্গে রাখার অনুকূল ঐতিহাসিক, আর্থ-সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক প্রেক্ষাপট এবং পাহাড়ী নেতৃবৃন্দের অমুসলিম পরিচিতিকে ইস্যু করে ভারত ইউনিয়নে থাকার পক্ষে প্রদত্ত যুক্তিসমূহের যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। (সূত্র: ভারত বিভাগ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম, আনন্দ বিকাশ চাকমা, এশিয়াটিক সোসাইটি পত্রিকা, পৃ-৭৩) লেখায় লেখক আনন্দ বিকাশ চাকমা যে সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করেছেন সংক্ষেপে তা হলো- ক)চাকমা তথা পার্বত্য জনগনের পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলা বা বর্তমানে বাংলাদেশে “থাকার মত যথেষ্ট অনুকূল আর্থ-সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক পরিবেশ বিদ্যমান ছিল”।

খ) স্নেহকুমার দেওয়ান বা তদানিন্তন পার্বত্য নেতৃবৃন্দের ভারতে অন্তর্ভূক্তির জন্য যে প্রচেষ্টাকে ” যুক্তি ও বাস্তবতা থেকে উপজাতীয় গোঁয়ার প্রকৃতি অন্ধ করে দিয়েছিল” বলে উল্লেখ করেছেন। গ) এবং প্রবন্ধের শেষে কুমার কোকনাদক্ষ রায়ের ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি প্রবন্ধটির সমাপ্তি টানেন। কোকনাদক্ষ রায়ের উদ্ধৃতির মূল বক্তব্য হচ্ছে “… আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের ভাগ্য বাংলাদেশের সঙ্গেই স্থাপিত করব তাতে যদি আমাদের সমস্ত জাতি্ লুপ্ত হয়ে যায় তবুও ‘Excluded Area’ রূপ শাসনব্যবস্থা অপেক্ষা সুখে থাকব এবং বঙ্গদেশের শাসনব্যবস্থা আমাদের মঙ্গল হবে। ” আনন্দ বিকাশ চাকমার এই সকল সিদ্ধান্ত বিষয়ে আমি সংক্ষেপে পয়েন্ট আকারে কিছু বক্তব্য তুলে ধরছি- ##১.আনন্দ বিকাশ চাকমা শুধুমাত্র ধর্মকে উপজীব্য করে ভারতের সাথে না থেকে পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হবার পক্ষে মত দেবার চেষ্টা করেছেন। অথচ, ভারতের অন্তর্ভূক্ত হবার বিষয়টি শুধুমাত্র ধর্মের জন্য ছিলো না।

তাতে সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক অধিকারের বিষয়সমূহও অন্তর্ভূক্ত ছিলো, এবং সর্বোপরি ছিলো জীবনাচার বা সংস্কৃতিগত বিষয়। তাছাড়া, পাকিস্তানী শাসকশ্রেনী আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে হাজার মাইল দুরে, সংস্কৃতি-রাজনৈতিক-সামাজিক যে কোনো দিক থেকে তাদের সাথে আমাদের আত্মিক মিল ছিলো না। (এখানে বলা দরকার পূর্ব বাংলা কিন্তু পাকিস্তানী শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু ছিলো না। )। এ সকল বিষয় আনন্দ বিকাশ চাকমা সযত্নে এড়িয়ে গেছেন এবং ধর্মকেই প্রাধান্য দিয়ে পাকিস্তানে অন্তর্ভূক্তির পক্ষে অবস্থান রেখেছেন।

###২. স্নেহ কুমার চাকমা-ঘনশ্যাম দেওয়ান প্রমুখরা ভারতে অন্তর্ভূক্ত হবার জন্য আরেক কারণে চেষ্টা করেছিলেন- তা হলো, ভারত পাকিস্তান থেকে অধিকতর জনগণের অধিকার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এবং এমনকি সামন্ততন্ত্র বা রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বাতিল করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করার আশ্বাস বিভিন্ন অঞ্চলকে দিয়েছিল। (সংক্ষেপে বলছি। তাছাড়া, এখন আমার কাছে সূত্র উল্লেখের মতো বই হাতের কাছে নেই। অনেকদিন আগে এসব বই পড়েছি।

) এতে চাকমা রাজন্য বা অন্য রাজাগণ পাকিস্তানে অন্তর্ভূক্ত হতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেননি। এ বিষয়ের সূত্র ধরে আরেকটি বিষয় এখানে বলা দরকার, ভারত নিখিল ভারত বা অখন্ড ভারতে বিভক্তি হয়েছিল হিন্দু মুসলিম দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে। অর্থাৎ, হিন্দু একজাতি এবং মুসলিম অন্য জাতি ধরে এই বিভক্তির সূত্রপাত। কিন্তু এই দ্বিজাতিতত্ত্ব বারেবারে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, বিশেষ করে ১৯৭১ সালে একই ধর্মাবলম্বী পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর নাগপাশ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ফলে দ্বিজাতিতত্ত্ব যে ভিত্তিবিহীন তা প্রথম প্রমাণিত হয় ঐতিহাসিকভাবে। এরপরে বর্তমানে পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশে যে, ব্যাপক সংঘর্ষ সংঘাত তার জন্যও ঐতিহাসিকগণ দ্বিজাতিতত্ত্বকে ভ্রান্ত বলে সিদ্ধান্তে আসার প্রয়াস নিয়েছেন।

কিন্তু আনন্দ বিকাশ তার লেখায় ঐ দ্বিজাতিতত্ত্বকে আবার তার লেখায় ফিরিয়ে এনে কী বার্তা দিতে চাচ্ছেন তা বোধগম্য নয়। #### ৩. আরেকটি বিষয়- সেটা হচ্ছে, তৎকালীন আমাদের সামাজিক-প্রতিষ্ঠিত এবং নতুন উঠতি নেতৃত্বের ভূমিকা কেমন ছিলো? সে ভূমিকা সঠিক ছিলো নাকি বেঠিক ছিলো? এ বিষয়ে আলোচনা অনেক বড় ক্যানভাসে করা দরকার বলে মনে করি। তবে দুয়েকটি পয়েন্ট উল্লেখ করছি। জুম্ম জনগণ বা আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের তৎকালীন নেতৃত্বকে আমরা মোটাদাগে তিনভাগে ভাগ করতে পারি। ক) রাজন্য নেতৃত্ব(এ অংশে রাজা নলিনাক্ষ রায় নেতৃত্বে রয়েছেন)।

খ) দেওয়ান নেতৃত্ব বা তৎকালীন সময়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি( এ অংশের নেতৃত্বে রয়েছেন কামিনী মোহন দেওয়ান) গ) নতুন উঠতি নেতৃত্ব( এ অংশে রয়েছেন স্নেহ কুমার চাকমা, ঘনশ্যাম দেওয়ান প্রমুখ) ###### ৪. তৎকালীন নেতৃত্বের ভূমিকা সংক্ষেপে উল্লেখ করছি- ১. রাজন্য নেতৃত্ব তৎকালীন সময়ে জনগনের কথা চিন্তা করেনি। তারা চিন্তা করেছেন নিজেদের গদি রক্ষা কিভাবে করা যায় তা নিয়ে। এবং তাই স্বাভাবিক ছিলো সে সময়ে। তাই তারা পরে পাকিস্তানেরই পক্ষ নিয়েছিলেন। কারণ এতে তাদের রাজশক্তি টিকবে।

ভারতের অন্তর্ভূক্ত হলে তারা রাজত্ব হারাবেন। ২. কামিনী মোহন দেওয়ানের নেতৃত্বাধীন অংশটির ভূমিকা তখন নেই বললেই চলে। এ অংশটি রাজন্য ও স্নেহকুমার দুই অংশকেই সমালোচনা করেছে। কিন্তু তাদের সক্রিয় কোনো ভূমিকা সে সময় ছিলোনা। তবে কামিনী মোহন দেওয়ান যদি তার ‘পার্বত্য চট্টলার এক দীন সেবকের কাহিনী’ যদি লিখে না যেতেন তবে হয়তো আমরা ইতিহাসের কানাগলিতে হাতড়াতাম! এ জন্যই মাত্র তাঁকে ধন্যবাদ দেওয়া যায়।

নেতৃত্বের ভুমিকা বিষয়ে তাঁর বা এ অংশের কোনো ভূমিকা নেই। তারা কথায় সিদ্ধ, কাজে বা বাস্তব ভূমিকায় নয়। ৩. শেষ অংশটির প্রতিনিধিত্বকারী হলেন, স্নেহ কুমার চাকমা, ঘনশ্যাম দেওয়ান প্রমুখরা। তাদের ভূমিকা কেমন ছিলো আরো কী হতে পারতো তা নিয়ে নানা আলোচনা চলতে পারে এবং এভাবে আলোচনা হলে বরং আমাদেরই সুবিধা হবে। আমরা ইতিহাস সচেতন হয়ে উঠবো।

তবে তাদের ভূমিকা জনগণের পক্ষে ছিলো। তারা জনগনেরই অধিকার চেয়েছেন। তাতে বা্ এই চাওয়ায় ভুল থাকতে পারে। কিন্তু তাদের আকাঙ্খাটাই তাদের সম্মানের জায়গা নির্দিষ্ট করে দেয়। আলোচনা চলতে থাকুক।

আমরা চোক মু ফুত্যে হয়ে উঠি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.