আমরা এমন একটা পরিবেশ চাই, যেখানে শিশুরা তাদের পছন্দ-অপছন্দের ধাপগুলো সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নিয়ে বড় হবে।
===ফয়সল সাইফ===
অভিজিৎ তাঁর বইয়ের শুরুর দিকে একটি ঘটনা তুলে ধরেছেন। সেটা ঠিক এরকম:
বছর দুয়েক আগের কথা। একবার একটি বাংলাদেশী ই-ফোরামে এক ভদ্রলোকের সাথে দর্শনগত কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল।
ভদ্রলোক তাঁর জীবনের একটি ঘটনা গল্পচ্ছলে আমার কাছে বর্ণনা করলেন,
গতকাল আমি আমার এক বন্ধুর বাসায় যাচ্ছিলাম, পার্টিতে।
কিন্তু বেরুতে গিয়ে অযথাই আমার দেরী হয়ে গেল। কারণ বাড়ীর বাইরে পা দিয়েই দেখি প্রচন্ড বৃষ্টি। আমার বাড়ীর চারপাশটা বৃষ্টির পানি জমে এমনভাবে ভরাট হয়ে ছিল, যে বন্ধুর বাসায় শেষ পর্যন্ত যাওয়াটা মুশকিল হয়ে দাঁড়াল।
এমন সময় আমার বাড়ীর পাশের একটা গাছ হঠাৎ করে ভেঙে পড়ল। আর তারপর জমে থাকা পানির ওপর ভাসতে লাগল।
ভাসতে ভাসতে গাছের ডালপালা বিল্ডিং বিভিন্নখানে বাড়ি খেয়ে ভেঙে পড়ে যেতে লাগল। আর শেষ পর্যন্ত যা ঘটল তা এককথায় অবিশ্বাস্য। আমি চোখের সামনে দেখলাম বিশাল গাছটি একটা নৌকায় পরিণত হয়ে গেল। এই নৌকায় চেপে আমি অবশেষে আমার বন্ধুর বাসায় পৌঁছুতে পারলাম। অবাক ব্যাপার, তাই না?
নৌকাটি ছিল একদম নিখুঁত, গ্রাম বাংলার মাঝিরা যে নৌকাগুলোয় দাঁড় বায়, একদম সেইরকম।
‘যতসব ননসেন্স’ আপনি হয়তো ধৈর্য্য হারিয়ে বলে উঠবেন।
কিভাবে একটা নৌকা মানুষের প্রচেষ্টা ছাড়াই নিজে থেকে তৈরী হয়ে যেতে পারে?
তাহলে, অভিজিৎ সাহেব আমায় বলুন তো, একটা সাধারণ নৌকাই কারো ইচ্ছে ছাড়া নিজে থেকে তৈরী হয়ে পানিতে ভাসতে পারে না। সেখানে কিভাবে আমাদের দেহের মত জটিল সিস্টেম হুট করে কোনো কারণ ছাড়াই নিজে থেকে তৈরী হয়ে যেতে পারে?
কিংবা,
আমাদের এই মহাবিশ্ব কারো উদ্দেশ্য-পরিকল্পনা ছাড়াই নিজে থেকে তৈরী হয়ে যেতে পারে?
তারপর এই ঘটনা থেকে আগত প্রশ্নের সমাধানে তিনি যে যুক্তি তুলে ধরেছেন তা নিম্নরূপ:
নৌকা দেখে ভদ্রলোকের নৌকার কারিগরের কথা মনে হয়েছে। কিন্তু একটি নৌকা দেখে কি কারো মনে হতে পারে, একজন ঘড়ির কারিগর নৌকাটি বানিয়েছে? কখনোই না। আমাদের স্বভাবতই মনে আসে শুধু নৌকার কারিগরের কথা।
তেমনি আমরা আমাদের সমাজে দেখি, নৌকা বানায় নৌকার কারিগর, ঘড়ি বানায় ঘড়ির কারিগর। একই কারিগর তো সবকিছু বানাচ্ছে না।
একই যুক্তিতে, তাহলে আমাদের সৃষ্ট জীবনের জন্য দরকার একজন জীবনীকার, সূর্যের জন্য চাই একজন সূর্যকার (সূর্য তৈরীর কারিগর), চন্দ্রের জন্য চাই একজন চন্দ্রকার। কিন্তু ঘড়ির (নৌকার) কারিগরের জন্য ঘড়ির উপমা দিয়ে শুরু করলেও, বিশ্বাসীরা মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে প্রতিটি বস্তুর জন্য যুক্তিহীনভাবে মাত্র একজন সর্বশক্তিমান ইশ্বর কল্পনা করেন।
আমি এখনই এর উত্তর দিয়ে দিতে চাই না।
তবে, শুধু এটুকু বলে রাখি, ইশ্বর আর মানুষের কাজ এক হলে, তিনি আর ইশ্বর কেন?
পবিত্র কোরআনে এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, সেটার উল্লেখ আছে, সুরা ইখলাস, আয়াত ৪: ‘এবং তার সমতুল্য কেউ নেই’। মানে সর্বশক্তিমান আল্লাহর সমতুল্য বা তাঁর সাথে তুলনীয় কেউ নেই। তাই মানুষ একসাথে একটা কাজ পারে বলে আল্লাহ পারবেন না এটা অযৌক্তিক।
তারপর জনাব অভিজিৎ তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন গ্রীক দার্শনিক, সক্রেটিস ও প্লেটোর ধর্ম বিশ্বাসের কথা। তাঁরা দুজনেই বিশ্বাসী ছিলেন।
যাই হোক, এরপরেই তিনি উল্লেখ করেছেন ১৮০২ সালে প্রকাশিত ‘ন্যাচারাল থিওলজি’ নামক একটা বইয়ের উদ্ধিৃতি। যেটা লিখেছিলেন একজন ধর্মযাজক। তাঁর নাম উইলিয়াম প্যালি। উদ্ধিৃতিটা এরকম:
ধরা যাক, জঙ্গলে চলতে চলতে একজন মানুষ একটা ঘড়ি পড়ে থাকতে দেখলেন। উনি কি ভেবে নেবেন, যে ঘড়িটি নিজে থেকেই তৈরী হয়ে জঙ্গলে পড়ে ছিল- না কেউ একজন ঘড়িটি তৈরী করেছিল?
এটাকে একটা জোড়ালো যুক্তি হিসেবে মেনে নিয়ে, জনাব অভিজিৎ এর উত্তরে পাল্টা যুক্তি দিলেন:
ঘড়ির যেমন কারিগর থাকে, তেমনি সেই কারিগরের থাকে পিতা।
তাহলে ইশ্বর নামক কারিগরের পিতা কে? আর সেই পিতার পিতাই বা কে ছিলেন? এমনি ভাবে প্রশ্নের ধারা চলতেই থাকবে। এই প্রশ্ন আমাদের ঠেলে দেবে অন্তহীন অসীমত্বের দিকে। তবে, বিশ্বাসীরা এটা থেকে রেহাই পেতে সোচ্চারে ঘোষনা করেন, যে ইশ্বর সয়ম্ভু। তাঁর কোনো পিতা নেই। তাঁর উদ্ভবের কোনো কারণ নেই।
তিনি অনাদি- অসীম। এখন এটা শুনে যুক্তিবাদিরা অবশ্যই প্রশ্ন ছুঁড়বেন, ইশ্বর যে সয়ম্ভু তা আপনি জানলেন কী করে? কে আপনাকে জানাল? আর যে জানিয়েছে, সেটাই যে সঠিক এ ব্যাপারে প্রমাণ কী? আর যে যুক্তিতে ইশ্বর সয়ম্ভু বলছেন, সেই একই যুক্তিতে স্রষ্টা ছাড়া বিশ্বভ্রহ্মান্ডের সৃষ্টি; ভাবতে অসুবিধা কোথায়? এখানে আমরা দুটো প্রশ্ন পেলাম।
(১) ইশ্বরের পিতা কে? এই অন্তহীন প্রশ্নের ধারা।
(২) ইশ্বর যদি নিজে থেকেই সৃষ্টি হতে পারেন, তাহলে একই যুক্তিতে মহাবিশ্বের সৃষ্টি ভাবতে অসুবিধা কোথায়?
ইশ্বরের পিতা কে:
এই প্রশ্নের উত্তরে একটা ভূমিকা দিয়ে নেই। মনে হতে পারে সেটা অপ্রাসঙ্গিক।
তবে, আমি মনে করি সেটার দরকার আছে।
ধরা যাক, আপনি একটা মাটির দলা হাতে নিলেন। সেটা যত বড় ইচ্ছা নিতে পারেন। এখন আপনাকে জিগ্যেস করা হল, এই মাটির দলাটি কী দিয়ে তৈরী?
আপনি অবশ্যই বলবেন, অসংখ্যা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনু দিয়ে। এটা আমরা সবাই জানি, যে প্রকৃতিতে প্রতিটি বস্তু, সেটা যাই হোক না কেন; ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনু দিয়েই গঠিত হয়।
এখন আপনি অনুকে ভিত্তি ধরে জ্যামিতিক হিসেবে উক্ত মাটির দলাটির একটা কেন্দ্র বের করলেন। তখন কেউ এসে বলল, এটা আসল কেন্দ্র নয়। কেন্দ্র আরো গভীরে। তখন আপনি আর একটু কষ্ট করে পরমানুকে ভিত্তি ধরে জ্যামিতিক কেন্দ্র বের করলেন। তখন আর একজন এসে বলল, সেটাও মূল কেন্দ্র নয়।
মূল কেন্দ্র আরো গভীরে। সেক্ষেত্রে পরমানু কণাকে ভিত্তি ধরে জ্যামিতিক কেন্দ্র বের করলেন। এভাবে হতে পারে আরো কয়েকটি প্রচেষ্টা। বিজ্ঞান যদি কোনোদিন আরো ক্ষুদ্র কোনো কণা আবিষ্কার করতে পারে, তাহলে সেটাকে ভিত্তি ধরে কেন্দ্র মূল কেন্দ্র বের করা যাবে। তারপরও কিন্তু কেন্দ্রর নাম কেন্দ্রই রয়ে যাবে।
আর এই কেন্দ্র খোঁজাখুঁজির একটা শেষও থাকবে। পদার্থবিদ্যা এবং যুক্তি সেটাই বলে।
এখন আসা যাক মূল আলোচনায়। ইশ্বরের পিতা কে? ইশ্বর মানে উপাস্য। ইশ্বর মানে সৃষ্টিকর্তা।
আমাদের দেহের সিস্টেম যত জটিলই হোক না কেন, এর উপাদান এই মহাবিশ্বেই খুঁজে পাওয়া যায়। এই মহাবিশ্বের মধ্যে থাকা উপাদান থেকে আমাদের সৃষ্টি। তার মানে কেউ দাবী করল(আমি নই), মহাবিশ্বই আমাদের সৃষ্টিকর্তা (পিতা)। তাহলে এই মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা কে?
সর্বশক্তিমান ইশ্বর।
সর্বশক্তিমান ইশ্বরের সৃষ্টিকর্তা কে?
এখন আপনারা চলে যান শুরুর ভূমিকাতে।
যেহেতু একটি বস্তুর জ্যামিতিক কেন্দ্র একটা নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে শেষ হতে বাধ্য, সেহেতু এটাও দাবী করা যায়, যে সর্বশক্তিমান ইশ্বরে গিয়েই সৃষ্টির কেন্দ্র খুঁজে পাওয়া যায়।
আমি ধরে নিলাম তাঁর আর কোনো পিতা নেই। কেন্দ্রর মতোই, তিনিই শেষ জন। তাঁর মধ্যেই সব শেষ। যেখান থেকে সবকিছুর শুরু।
তাহলে পিতার পিতা কে? এটা কোনো অন্তহীন প্রশ্নের ধারা হতে পারে না। এটাকে অসীমত্ব বলাটা অযৌক্তিক। কারণ সবকিছুরই একটা স্টার্টিং পয়েন্ট থাকে। ইশ্বরই সবকিছুর স্টার্টিং পয়েন্ট।
বিঃদ্রঃ আমি এখানে বস্তুর ভর কেন্দ্র হিসেবের মধ্যে আনছি না।
বস্তুর সর্বস্থানের ঘনত্ব সমান না হলে ভর কেন্দ্র আর জ্যামিতিক কেন্দ্র ভিন্ন হতে পারে। তবে, এক্ষেত্রে জ্যামিতিক কেন্দ্র বিবেচনায় রাখাই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্রতিটি বস্তুর জ্যামিতিক কেন্দ্রের আনুপাতি হার সমান। যেখানে প্রতিটি বস্তুর ভর কেন্দ্রের আনুপাতিক হার সমান নয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।