অন্যায় এর প্রতিবাদ
বর্তমান প্রশাসনিক ও বিচার ব্যবস্থায় এবং প্রক্রিয়ায় ‘রিমান্ড’ কথাটির প্রয়োগ এক ব্যাপক ও সুপরিসর অর্থে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। অর্থাৎ যত্রতত্র তার ব্যবহার চলছে। রাজনৈতিক মামলায় ক্ষমতাসীনরা প্রতিপক্ষকে নাজেহাল করতে পুলিশকে রিমান্ডের ইঙ্গিত দেয়। প্রভাবশালীরাও বিভিন্ন লোককে শিক্ষা দিতে পুলিশের দ্বারস্ত হন। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে শুধু মামলা চাপানো নয় কেউ কেউ রিমান্ডে নিয়ে ধোলাই দেওয়ার কন্ট্রাক্ট করেন পুলিশের।
এমন কথাও শোনা যায়। রিমান্ডে নেওয়া না নেওয়া নিয়ে পুলিশের বাণিজ্যের কথা বহুদিন থেকেই শোনা যাচ্ছে। গ্রেফতারের পর স্বজনরা পুলিশের কাছে প্রথমেই ধরনা দেয় রিমান্ডে না নিতে। সাধারণ মানুষও ইতোমধ্যে এই জ্ঞানটুকু অর্জন করেছে যে, পুলিশ ইচ্ছে করলে রিমান্ডে নিতে পারে, না-ও নিতে পারে।
অর্থাৎ রিমান্ড প্রশ্নে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পুলিশেরই।
ম্যাজিস্ট্রেট কার্যত অসহায়। তবে প্রচলিত আইনের এ মারপ্যাঁচ না বোঝায় অনেকেই ম্যাজিস্ট্রেটদের দোষেন। ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশকে এক কাঁতারে পরিমাপ করেন। আরো উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে রিমান্ড একবার মঞ্জুর হয়ে গেলে তা আর রদ বা বাতিল করার ব্যবস্থা নেই। উচ্চ আদালতেরও এ ব্যাপারে করার কিছু নেই।
জানা মতে, রিমান্ড প্রশ্নে এখনো পর্যন্ত হাইকোর্ট থেকে দিক নির্দেশনামূলক কোনো রুলিং আসেনি। এছাড়া ম্যাজিস্ট্রেটদের মঞ্জুরকৃত রিমান্ড যৌক্তিক না অযৌক্তিক, আইনসম্মত না আইনবিরুদ্ধ তা নির্ণয়েরও কোনো সুযোগও নেই।
আইনের ১৬৭ ধারা অনুযায়ী গ্রেফতারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত শেষ করতে হবে। ন্যায় ও যুক্তিসঙ্গত কারণে তদন্তকার্য শেষ করা সম্ভব না হলে পুলিশ আটক ব্যক্তিকে সত্বর ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠাবে। ম্যাজিস্ট্রেট অবশ্য সর্বসাকুল্যে ১৫ দিনের জন্য আটকাদেশ দিতে পারেন।
কিন্তু হাজতে পুনঃ প্রেরণের নামে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে আসলে চালানো হয় অমানবিক ও পাশবিক অত্যাচার।
ফলে সাধারণত দরিদ্র ও নিরক্ষর আটক ব্যক্তি প্রায়ই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য প্রদান করে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পুলিশের হেফাজতে উক্ত আইনের ১৬৭ ধারা অনুযায়ী আটক ব্যক্তির আইনজীবী দেখা করতে পারেন এবং আত্মীয়-স্বজন খাবার-দাবার ও কাপড়-চোপড় প্রেরণ করতে পারেন। বাস্তব চিত্র বিপরীতধর্মী।
উক্ত আইনের ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য দানের ব্যবস্থা রয়েছে।
উক্ত ধারায় উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো নিম্নরূপ :
১) ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে তার তত্ত্বাবধানে স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য দিতে হবে।
২) ম্যাজিস্ট্রেট পরিষ্কার ভাষায় আটক ব্যক্তিকে বুঝিয়ে দেবেন যে, স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য দেয়া নিতান্তই স্বেচ্ছামূলক। কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
৩) স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য না দিলেও যে আইনের মূল মর্ম অনুযায়ী আটক ব্যক্তিকে পুনরায় পুলিশ হেফাজতে দেয়া হবে না, তাও পরিষ্কার করে ম্যাজিস্ট্রেট বুঝিয়ে দেবেন।
উপরোক্ত (১), (২) ও (৩) শর্তাবলী ম্যাজিস্ট্রেট পালন করেছেন কিনা সেই মর্মে তার একটি অঙ্গীকারনামাও দিতে হবে।
এছাড়া এই ধারা ১৬৪-এর সারমর্ম অনুযায়ী স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য প্রকাশ্য আদালতে দিনের বেলায় ধারণ করা এবং আটক ব্যক্তি যেন বুঝতে পারে যে সে সম্পূর্ণ পুলিশ প্রভাবমুক্ত ও কোনো ভয়ের কারণ নেই।
বাস্তবে প্রকাশ্য আদালতে বিবৃতি ধারণ করা হয় না, এমনকি পুলিশ উপস্থিত থাকে অথচ অনেক সময় ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিও সার্বক্ষণিক হয় না।
তদুপরি নিরক্ষর ও দরিদ্র আটক ব্যক্তির কাছে উল্লিখিত শর্তাবলী প্রায়ই সম্পূর্ণ বোধগম্য হয় না।
বলা বাহুল্য, ঔপনিবেশিক শতবর্ষের আইনটি আজও বহাল তবিয়তেই টিকে আছে। ফলে আইনের ব্যবহারে মানবতাবোধসম্পন্ন ন্যায়পরায়ণতার পূর্ণ অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু সভ্য বা গণতান্ত্রিক সমাজে একটি অকল্পনীয় বিষয়। অথচ এ ঘটনা আমাদের দেশে প্রায়ই ঘটছে।
দেশে গণতান্ত্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সরকার থাকা সত্ত্বেও পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো কোনো সদস্য স্বৈরাচারী মনোভাব থেকে কিছুতেই সরে আসতে পারছে না। সরকারের জন্যও বিড়ম্বনা সৃষ্টি করছে তাদের অনৈতিক ও গর্হিত কর্মকাণ্ড। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একশ্রেণীর সদস্যের মধ্যে তা মজ্জাগত অভ্যাসেও পরিণত হয়েছে।
যে কারণে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের পক্ষ থেকে হুঁশিয়ারি করে বলা হয়েছে, `এ ধরনের ঘটনা বরদাশত করা হবে না।
জড়িতরা যতই প্রভাবশালী হোক না কেন আদালত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেনই। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। `
পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু প্রতিরোধে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিচ ফর বাংলাদেশ-এর করা রিট পিটিশনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্টের বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও শেখ মো. জাকির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ বলেছেন, ভবিষ্যতে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু মানুষের কাছে শুধু ইতিহাস হয়ে থাকবে আমরা এমনটিই চাই। সম্প্রতি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে কয়েকটি মৃত্যুর প্রেক্ষিতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রতি আদালত চার দফা নির্দেশনাও দিয়েছেন।
পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু রোধে আদালতের কড়া মনোভাব এবং নির্দেশনা এ সময়ের একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বেপরোয়া এবং আইনবহির্ভূত কর্মকাণ্ডে বাদ সাধতে তা অবদান রাখবে বলে আশা করা যায়।
আদালতের বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়ে আমরাও চাইব পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ইতিহাসের বিষয় বস্তুতে পরিণত হওয়া উচিত। নিজেদের সভ্য সমাজের অংশ হিসেবে পরিচয় দিতে হলে এর কোনো ব্যত্যয় কাম্য নয়। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।