মহাজোটের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে, তারা বিএনপিকে আগামী নির্বাচন বর্জনের অবস্থানে ফেলে দিতে বদ্ধপরিকর। খালেদা জিয়া ‘টেলিফোন-ঝগড়ায়’ রহস্যজনকভাবে প্রধানমন্ত্রীর সংলাপের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে ক্ষমতাসীনদের হাতে একতরফা নির্বাচনী প্রহসন মঞ্চস্থ করার সুযোগ তুলে দিয়েছেন। গত ২৭, ২৮ ও ২৯ অক্টোবরের ৬০ ঘণ্টা হরতাল প্রত্যাহার করে ২৮ অক্টোবরের ‘গণভবনের খানার দাওয়াত’ গ্রহণে তাঁর অপারগতার যত কথাই তিনি বলেছেন, সেগুলো জনগণের কাছে ‘খোঁড়া অজুহাত’ মনে হয়েছে। ২৫ অক্টোবরের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশের ভাষণে তিনি ৪৮ ঘণ্টার যে আলটিমেটাম দিয়েছিলেন, সেটা পার হওয়ার আগেই প্রধানমন্ত্রীর টেলিফোন কল পেয়েছেন তিনি, তাই হরতাল প্রত্যাহার করার ব্যাপারে তাঁর অসম্মতি ‘একগুঁয়েমি’ ছাড়া কিছু নয়।
খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোটে ক্যাডার শক্তিতে জামায়াত-শিবিরই বলীয়ান, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে তারা জনগণের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক।
তাদের এজেন্ডা দণ্ডিত নেতাদের জীবন রক্ষা। গত ২৫ অক্টোবরের ১৮-দলীয় সমাবেশেও তারা ব্যানার-বেলুন-ফেস্টুনসহকারে সেটি জানান দিয়েছে। হরতালের নামে গত ২৭, ২৮, ২৯ অক্টোবর ও ৪, ৫, ৬ নভেম্বর এবং ১০, ১১, ১২, ১৩ নভেম্বরের জ্বালাও-পোড়াও-বোমাবাজি-ভাঙচুরের ঘটনায়ও এই অপশক্তি নেতৃত্ব দিয়েছে।
অপরদিকে, প্রধানমন্ত্রী টেলিফোন-ঝগড়ায় স্বভাববিরুদ্ধ বাকসংযম দেখিয়ে বারবার সুচতুর খোঁচা মেরে খালেদা জিয়াকে উচ্চকণ্ঠে ঝগড়া চালিয়ে যেতে উসকানি দিয়েছেন। বিএনপি-জামায়াতপন্থী কয়েকটি পত্রিকা ওই ঝগড়ার অংশবিশেষ প্রকাশ করায় সরকারপক্ষীয় একটি টিভি চ্যানেল পুরো ঝগড়াটি ফাঁস করে দেওয়ার মওকা পেয়ে গেল এবং এর ফলে খালেদা জিয়ার ঝগড়াটে ইমেজটা দর্শক-শ্রোতা ও পাঠকের কাছে প্রকাশিত হলো।
কিন্তু এ টেলিফোন-ঝগড়ার রাজনৈতিক ফায়দা সাময়িকভাবে শেখ হাসিনার পক্ষে গেলেও তিনি এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন মহাজোট যদি মনে করে যে ১৮-দলীয় জোটের সমর্থন কমে গেছে, তাহলে সেটা ভুল হবে। ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা দ্য ডেইলি স্টার এবং এশিয়া ফাউন্ডেশনের জনমত জরিপে দেখা যায়, ৫৫ শতাংশ উত্তরদাতা ১৮-দলীয় জোটের পক্ষে রয়েছে। মহাজোটের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন ৩৫ শতাংশ উত্তরদাতা। ওই জরিপে উত্তরদাতারা বর্তমান সরকারের অনেক সাফল্য এবং সুকীর্তি রয়েছে বলে স্বীকার করা সত্ত্বেও আগামী নির্বাচনে মহাজোটকে ভোট দেবেন না বলে জানিয়েছেন।
মহাজোটের বিরুদ্ধে জনগণের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ দানা বাঁধার প্রক্রিয়াটি কিন্তু গত দুই বছরের নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া।
কেননা, জনগণ একটিবারের জন্যও দুর্নীতি ও লুটপাট থেকে মুক্ত কোনো সরকার পায়নি। এমনকি স্বাধীনতা-উত্তর বঙ্গবন্ধুর সরকারও দুর্নীতিমুক্ত ছিল বলা যাবে না। ব্যক্তি মুজিব দুর্নীতি না করলেও দলীয় নেতা-কর্মী, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানাগুলোর কর্তাব্যক্তিদের ব্যাপক দুর্নীতি ও লুটপাটের দায়ভার তাঁর ওপরই বর্তেছিল। তাঁর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কয়েক মাস পর মসনদ দখলকারী জিয়াউর রহমান তাঁর ক্ষমতার মেয়াদে আর্থিক দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিতেন না বলে ‘মিথ’ চালু থাকলেও বাংলাদেশে কেনাবেচার রাজনীতির প্রবর্তক তিনিই। জিয়া সুপরিকল্পিতভাবেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করে পুরো জাতিকে চোরাবালিতে প্রবিষ্ট করে গেছেন।
তিনি স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত, মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলামকে আবার রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছেন। উপরন্তু তিনি দলীয় নেতা-কর্মীদের সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি ব্যবসায়ী-পেশাজীবীদের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও কলকারখানাগুলোতে পুঁজি লুণ্ঠনের যে প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন করে গিয়েছিলেন, তাঁর পূর্বসূরি আওয়ামী লীগের দুর্নীতি তার তুলনায় অনেক কম।
দুর্নীতি ও লুটপাটকে এ দেশের রাজনীতিতে পরিপূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিকতা দেন আরেক অবৈধ শাসক এরশাদ। তাঁর পৌনে নয় বছরের শাসনামলে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার পরিবর্তে বাহাদুরিতে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক কূটকৌশলে বিশেষ পারদর্শী এই পতিত স্বৈরাচারী এখনো দেশে ‘কিং মেকার’ হওয়ার ক্ষমতা রাখেন।
১৯৯০ সালে তিন জোটের রূপরেখায় গণতান্ত্রিক ও মুক্তিযুদ্ধের ধারায় বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার থাকলেও ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপি তার বিপরীতে যাত্রা করে। এর ফলে ১৯৯৪ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন জোরদার হয়।
গত ২২ বছরের তিনটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে; ব্যবস্থাটি অসাংবিধানিক ঘোষিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সঠিকভাবেই রায় দিয়েছেন, অনির্বাচিত সরকারব্যবস্থা অসাংবিধানিক হওয়া সত্ত্বেও সংসদ চাইলে আরও দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার ব্যবস্থা করতে পারে। তবে বিচার বিভাগকে এর আওতামুক্ত রাখতে হবে।
ওই রায়টির আলোকে সংবিধান সংশোধন আবশ্যক ছিল না, কিন্তু পঞ্চম সংশোধনী ও সপ্তম সংশোধনী বাতিলের পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত সংসদীয় কমিটি প্রস্তাবিত সংশোধনীতে সুপ্রিম কোর্টের এতৎসম্পর্কীয় নির্দেশনা অনুসরণেরও প্রয়াস ছিল।
কমিটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মতৈক্য পোষণ করে সংশোধনী প্রস্তাবগুলো প্রধানমন্ত্রীর বিবেচনার জন্য প্রেরণ করল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর একক সিদ্ধান্তে প্রস্তাবের খোলনলচে বদলে ফেলা হলো। ১৯৭২ সালের সংবিধানই ‘নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর একনায়কত্ব’ প্রতিষ্ঠার দলিল হিসেবে বিবেচিত। রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর কাছে অর্পিত।
সংসদ, বিচার বিভাগ, রাষ্ট্রপতিসহ সবার ক্ষমতাই কার্যত প্রধানমন্ত্রীর হাতে ন্যস্ত। আর সে জন্যই ক্ষমতার পালাবদল নিয়ে এত খুনোখুনি ও সংঘাত।
১৯৯১-৯৬ মেয়াদের বিএনপি সরকারের সঙ্গে ২০০১-০৬ মেয়াদের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের তুলনা করলে দেখা যাবে, খালেদা জিয়া ও তাঁর ছেলে, আত্মীয়স্বজন-ইয়ার-বন্ধুদের কী ক্রমবর্ধমান ক্ষমতার দাপট, দুর্নীতি আর বেধড়ক লুটপাট! ১৯৯৬-০১ সালের শেখ হাসিনার সরকারের দুর্নীতি ও লুটপাটের রেকর্ডের তুলনায় বর্তমান ২০০৯-১৩ মেয়াদের সরকারের দুর্নীতির বদনাম অনেক বেশি। তাই মেয়াদের অর্ধেক পার হতে না-হতেই প্রতিটি ক্ষমতাসীন সরকার ব্যাপকভাবে অজনপ্রিয় হয়ে পড়ে। ২০০৬ সালের খালেদা জিয়ার সরকার যেভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে প্রভাবিত করেছিল এবং রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে দিয়ে একটি সাজানো তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার ন্যক্কারজনক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল, সেসবই এক-এগারোর ছদ্মবেশী সামরিক শাসনকে ডেকে আনে।
এবারও প্রধানমন্ত্রীর একক সিদ্ধান্তে সংবিধানের সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপের পেছনেও মহাজোটের জনপ্রিয়তায় ধস নামার বিষয়টিই মুখ্য কারণ বলে আমি বিশ্বাস করি। ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮-এর তিনটি নির্বাচনেই জনগণ ক্ষমতাসীন দল বা জোটকে প্রবলভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। অতএব, আগামী নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হলে মহাজোট সরকারের পরাজয় অবধারিত বলা চলে। সে জন্যই বর্তমান পর্যায়ে বিএনপিকে নির্বাচন বর্জনের অবস্থানে ঠেলে দিতে নানা চাণক্য-নীতি অবলম্বন করছেন ক্ষমতাসীনেরা।
কিন্তু দুঃখ হয় যে জনপ্রিয়তা দ্রুত কমে যাচ্ছে, সেটা বছর দুয়েক ধরে বোঝা গেলেও কারণগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করে সংশোধনের পথ গ্রহণের কোনো তাগিদ অনুভব করলেন না প্রধানমন্ত্রী।
সমালোচনা তিনি একেবারেই সহ্য করতে পারেন না জেনেও আমি তাঁর ভুলগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছি। কারণ, আমি নিজেকে এখনো আওয়ামী লীগের একজন ভোটার ও শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবেই পরিচয় দিয়ে থাকি। ২০০৯-১৩ মেয়াদের বর্তমান সরকারের সুকীর্তি ও সাফল্য অতীতের যেকোনো সরকারের চেয়ে বেশি। কৃষি খাতে, বিশেষত খাদ্যশস্য উৎপাদনে এ সরকারের সঠিক নীতিমালা এ দেশে একটি কৃষি বিপ্লবের সূচনা করেছে।
বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এলে আবারও তা বরবাদ করে দেবে।
সরকার ৪০ বছর পর একটি গ্রহণযোগ্য শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে বাস্তবায়ন শুরু করেছে, বিএনপি-জামায়াত এবং হেফাজতিরা সেটা নস্যাৎ করে দেবে। তা ছাড়া অনেকেই এমন ধারণা পোষণ করছেন যে, বিএনপি জোট ক্ষমতায় এলে দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যাবেন। হেফাজতকে খুশি করতে বিএনপি নারীর ক্ষমতায়ন-প্রক্রিয়াকেও বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের সুকীর্তির ও সাফল্য বিবেচনায় নিলে মহাজোটের আরেকবার ক্ষমতায় আসার খুব প্রয়োজন ছিল, কিন্তু তা বোধ হয় আর হওয়ার নয়। ভোটাররা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
সরকারের দুর্নীতি, লুটপাট, দলবাজি, স্বজনপ্রীতিই মানুষকে বিগড়ে দিয়েছে সবচেয়ে বেশি। আর এর সঙ্গে যোগ হয়ে গেছে ড. ইউনূস উপাখ্যান। সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় এ ইস্যুটি আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবির প্রধান কারণ হতে পারে বলে আমার ধারণা।
উপাখ্যানটির আদ্যোপান্ত জানা সত্ত্বেও পত্রপত্রিকায় তা খোলাসা করিনি কখনোই। তবে বারবার সাবধান করে দিয়েছি, সাধ্যমতো সমঝোতার চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়েছি।
তাই আগামী নির্বাচনে ভোটাররা ড. ইউনূসের প্রতি এই অবিচারের বদলা নিলে অবাক হব না।
এই পরিপ্রেক্ষিতে আমি মিনতি করছি, একতরফা নির্বাচনের যে আত্মঘাতী পথ মহাজোট বেছে নিয়েছে, তা পরিত্যাগ করুন। এটা আরও বড় ভুল হবে। জনগণের রায় মাথা পেতে নিন। গণতন্ত্রে আস্থা রাখুন।
ড. মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।