শেষ মঞ্চে তিনি যা দেখালেন তাতে দুই যুগ ধরে গড়ে ওঠা শচীন রমেশ টেন্ডুলকারের পুরো ভাবমূর্তিটাই মূর্তিমান হয়ে উঠেছিল। দর্শনানন্দ শ্রবণানন্দের পরিপূর্ণ মাত্রায় ডুবে পুলকিত শ্রদ্ধায় ক্রিকেট-বিশ্ব বিদায় অভিবাদন জানাল খেলাটির মহা-মহানায়ককে। ১৬ নভেম্বর ২০১৩ ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের অশ্রুসিক্ত সবুজে চিহ্ন আঁকা রইল ক্রিকেটের নান্দনিক-পেশাদারি চেতনার। নান্দনিক ও পেশাদারি শব্দ দুটি একসঙ্গে ব্যবহার করলাম। কারণ তিনিও দুটিকে মিলিয়েছেন তাঁর ক্রিকেট দিয়ে।
শাব্দিক অর্থ এবং চেতনার মিশেলে ওই শব্দযুগল ধরা ছিল তাঁর ব্যাটে ও আচরণে। তাঁর ক্রিকেট সাধনায় শুধুই আলোর মেলা, ক্রিকেটজীবনের সামগ্রিকতায় কোনো মানুষি দুর্বলতার কালিমা ছায়া ফেলেনি কখনো। তাই তো ওয়াংখেড়ের ওই ‘শচীন, শচীন’ ধ্বনির ঐকতান মুম্বাই তথা ভারতবর্ষের সীমানা ছাড়িয়ে সেদিন আপ্লুত করেছিল পুরো পৃথিবীকে। শচীন নিজেকে নয়, ক্রিকেট খেলাটিকেই তাঁর অবসর দিয়ে পৌঁছে দিলেন মানবিক বিনোদনের উচ্চতর মাত্রায়। সেই মাত্রা স্পর্শ করার সাধনায় পথ চলবে আগামী দিনের ক্রিকেট।
বিদায়বেলায় বীরশ্রেষ্ঠের কীর্তির সপ্রমাণ দলিল হিসেবে রেখে গেলেন ৭৪ রানের হীরার ফ্রেমে বাঁধানো ইনিংস আর তাঁর কালজয়ী, আবেগসংযমী, মানবিক বোধ সুরভিত বিদায়ী ভাষণ, দুটিই ভবিষ্যতের ক্রিকেট ইতিহাস চর্চার উজ্জ্বল উপকরণ হয়ে থাকবে। পড়ন্ত বেলায় কোনো স্নায়ু থরথর ভাব ছিল না সে ইনিংসে। প্রতিভার বরপুত্র কোনো তরুণ অভিষেকে ও রকম ইনিংস খেললে হইচই ফেলে দিত। শচীন তাঁর ব্যাটিং-দর্শন নিয়ে যে বলতেন ভিভ রিচার্ডসের আক্রমণাত্মক নিশ্ছিদ্রতা আর গাভাস্কারের ধৈর্যশীল মনঃসংযোগময় স্কিলের কথা, সেই দর্শনের কাব্যিক প্রয়োগ আমরা দেখেছি তাঁর শেষ পালার ব্যাটিং মহিমায়। তৃষ্ণার্ত করে রেখে গেলেন তিনি আমাদের।
বেচারা টিনো বেস্ট! কী প্রাণান্ত চেষ্টাই না তাঁর ছিল শচীনের উইকেটটির জন্য। গতির আগ্নেয় দাপট কেবল শ্রদ্ধাই নিবেদন করে গেল, তার নিজস্ব ধারায়। শচীন জিতলেন সেই শিল্পিত দ্বৈরথ। টিনো বেস্টের পূর্বসূরিরা এমন দ্বৈরথের অনুশীলন বহুবার করিয়ে গেছেন শচীনকে। নভজ্যোত সিধু গল্প করছিলেন টিভিতে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে ভারতের খেলা শারজায়। ভেজা উইকেটে টসে হেরে ভারত ব্যাটিং করছে। সিধু স্ট্রাইকে। অপর প্রান্তে শচীন। প্রথম ওভারে ১ রান এল নো বল থেকে।
বাকি ছয়টিতে সিধু ব্যাট ছোঁয়াতে পারলেন না। বোলারের নাম করেননি বক্তা। ওভার শেষ হলে পার্টনারকে সিধু জানালেন বল পড়ে শয়তানি করছে। পরের ওভারে বিশপের মুখোমুখি শচীন। সিধু বস্ফািরিত চোখে দেখলেন বোলারের সঙ্গে শেষ মুহূর্তে অগ্রসরমাণ শচীন প্রায় মাঝ পিচে মাটিতে বল পড়তে না দিয়ে বিশপকে মাথার ওপর দিয়ে সোজা ছয়।
সিধু গ্লাভস ঠোকাঠুকি করতে জিজ্ঞাসা করলেন, এ কেমন হলো? শচীনের উত্তর, ‘তুমিই তো বললে বল মাটিতে পড়ে বাজে ব্যবহার করে, তাই মাটিতে পড়তে দিলাম না। ’ এই হচ্ছেন শচীন। কৌশলী হতে সময় নেন না। টিনো বেস্ট কী করে তাঁকে ঠেকান।
আর শচীনের সেই বিদায়ী ভাষণ তো ছিল প্রত্যাশার চেয়ে অধিক কিছু।
২০ মিনিটের অধিককালের সেই ভাষণের রেশ চলবে বহুদিন। এই তিন দিনে সে ভাষণের প্রতিটি শব্দ এখন ক্রিকেট-বিশ্বের ঘরে ঘরে। আর সে ভাষণের অনুচ্চারিত বক্তব্য অনুপ্রাণিত করে চলবে ক্রিকেটের চলমান ধারাকে। এর চেয়ে অধিক আর কীই-বা দিতে পারতেন শচীন। রমাকান্ত আচরেকার পৃথিবীর সবচেয়ে সফল কোচ।
ক্রিকেটের আর কোনো মহাতারকা তাঁর হাতেখড়ির গুরুকে এমন শ্রদ্ধার্ঘ্য দিয়েছেন বলে ক্রিকেট-বিশ্ব দেখেনি-শোনেনি। শচীনের বিদায়ী ভাষণ শুনতে শুনতে মহাভারতের সেই কথা মনে পড়ে, বৈকুণ্ঠে যুধিষ্ঠিরই পৌঁছান, কারণ তিনি ঘৃণ্য বলে, তুচ্ছ বলে পথের সাথি কুকুরকেও ছাড়েন না।
শচীন ভারতরত্ন খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে তিনি বিশ্বরত্ন। তিনি প্রমাণ করেছেন খেলোয়াড়ি অর্জন, খেলোয়াড়ি চেতনা ও মনোভাব সভ্যতা বিকাশের অনিন্দ্যসুন্দর উপাদান।
আপনাকে অভিবাদন শচীন রমেশ টেন্ডুলকার!
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।