আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জাতিকে বিভক্ত করেছে "ওরাই" সুদূর পরিকল্পনা নিয়।

আল্লাহ মহান, যাহা বলিব সত্য বলিব।
আগেও মাঝেমধ্যে অনেকবার শুনেছি, তবে ইদানীং বেশ ঘন ঘন শোনা যায়, দেশকে বিভক্ত করে ফেলা হচ্ছে। অর্থাৎ জনগণকে বিভক্ত করা হচ্ছে। দেশ ও জাতির অগ্রগতির প্রশ্নে যা খুবই ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক। রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে যখন এই বিভক্তির কথা বলা হয় তখন তার সাধারণ একটা অর্থ বোঝা যায়।

একে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাঁড় করিয়ে ফায়দা নেয়ার উদ্দেশ্যেই তা করা হয়। কিন্তু দেশের বিশিষ্টজনরা যখন ওই কথা বলে তাদের জ্ঞানের বহর প্রমাণ করে বাহাবা নেয়ার চেষ্টা করেন তখন মনে হয়, এরা হয় জ্ঞানপাপী নয়তো সুবিধাবাদী। একটু দূরদৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করলেই দেখা যাবে পৃথিবীর সব দেশ ও জাতির মধ্যেই বিভক্তি রয়েছে। চিন্তা, চেতনা, রাজনীতি, সংস্কৃতি, ভাষা প্রভৃতি ক্ষেত্রেই বিভক্তি রয়েছে। এক মহল যদি একভাবে চিন্তা করে তাহলে অন্য মহল চিন্তা করে ভিন্নভাবে।

পাকিস্তান আমলেই বাঙালি-পাকিস্তানি হিসেবে আমরা বিভক্ত ছিলাম। '৬৯, '৭০ ও '৭১ সালে এসে যখন বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করল পাকিস্তানিরা কোণঠাসা হয়ে পড়লেও বাঙালির সেই আন্দোলনের মাঝে অনেকেই আশ্রয় খুঁজে নেয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু থেকে বিজয় অর্জন পর্যন্ত বাঙালি পরিষ্কার দুই ভাগে বিভক্ত হয়। এক ভাগ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ধারক-বাহক অন্য একটি ক্ষুদ্র অংশ হলেও তারা ছিল মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে শক্তি। এই বিরুদ্ধ শক্তির দুটি অংশের একটি ছিল সরাসরি সশস্ত্রবিরোধী শক্তি অন্যটি ছিল চিন্তা, চেতনা ও বিশ্বাসে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে।

এই দ্বিতীয় অংশেই ছিল বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ ও বিশিষ্ট নাগরিকদের একটি বড় মহল। যারা তাদের জ্ঞানবুদ্ধি দিয়েই সুকৌশলে নানাভাবে নানা পরিচয়ে স্বাধীনতার মূল চেতনাকে নষ্ট করার কাজে লিপ্ত হয়েছিল। এরাই বিভিন্ন সময় বিশেষ করে ইদানীংকালে দেশ ও জনগণকে বিভক্ত করে ফেলা হচ্ছে, তাতে দেশের অগ্রগতি ব্যাহত হতে বাধ্য ইত্যাদি বলে সাধারণ দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করে ফায়দা নেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সব জাতির মধ্যেই চিন্তা-চেতনায় পার্থক্য থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাঙালির জীবনে বিভক্তি এসেছে অনিবার্য কারণে,যা ইতিহাসের বিষয়ে পরিণত।

ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তানের জন্ম, সে জন্ম স্বাভাবিক ছিল না। যার মূলে ছিল রাজনীতিকদের খেলা এবং সাম্প্রদায়িকতা। ফলে পাকিস্তানের সৃষ্টি মূলে ছিল সাম্প্রদায়িকতার বীজ। ব্যাপক অর্থে '৪৭-এ পশ্চিম পাকিস্তান সেই জন্ম মেনে নিলেও বাঙালিরা সেদিন তা স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়নি। তার প্রমাণ মেলে '৪৮-এর ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত থেকেই।

ধীরে ধীরে সেই আন্দোলন নানাভাবে এবং নানা পরিচয়ে '৭১ এসে পৌঁছে। নিরীহ বাঙালি হয়ে ওঠে সশস্ত্র জাতি। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাঙালি স্বাধীন জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে গোটা জাতি সেদিন স্বাধীনতার মন্ত্রে ও ডাকে উদ্বুদ্ধ হয়ে যায় যা আছে তাই নিয়ে পাকি-শত্রুর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেও একটি মহল তা যে যত ক্ষুদ্রই হোক_ স্বাধীনতার বিরোধিতা করে এমনকি হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী হয়ে বাঙালি নিধন ও ধ্বংসযজ্ঞে মেতে ওঠে। অন্য একটি শিক্ষিত মহল তাদেরই সহযোগী হয়ে নানা উপায়ে মদত জোগায়। স্বাধীনতার পরে এদের সেই মুখোশ তারা পাল্টে ফেলে।

চিন্তা-চেতনায় তাদের কোনই পরিবর্তন হয়নি। '৭১-৭২-এ এদের সংখ্যা কম থাকলেও ৪২ বছর পর এসে তাদের সংখ্যা আর কম নেই। শিক্ষিতদের মধ্যেই এই মুখোশধারীর সংখ্যা বেশি। দেশের সাধারণ মানুষের চরিত্র এখন অনেক ভালো। তাদের মধ্যে যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন বা সাধ্যমতো সেই মহাসংগ্রামে শরিক হয়েছিলেন তারা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এখনও গর্ব করেন।

নাতিপুতিদের উজ্জীবিত করেন, ইতিহাস শোনান। '৭৫-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে মূলত স্বাধীনতাবিরোধী মুষ্টিমেয় শক্তি তাদের ডালপালা গজাতে শুরু করে। মোশতাক-জিয়া-এরশাদ-খালেদার হাত ধরে যে রাজনৈতিক শক্তি দেশে পুনর্বাসিত হয়েছে তারাই সুকৌশলে '৭১-এর চিন্তা, চেতনা, জাতীয় ঐক্য, আবেগ, জাত্যভিমান, সব কিছুকে পেছনে ফেলে অথবা পর্যুদস্ত করে মূলত পাক-আমলের দর্শন ও চেতনা দ্বারা জাতির ঐক্যকে বিভক্ত করেছে। তাদের সেই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা সম্পূর্ণ সফল না হলেও অনেকখানি সাফল্য নিয়ে আনতে পেরেছে। সমাজের একশ্রেণীর মতলববাজ বুদ্ধিজীবী যারা '৭৫ পরবর্তী শাসকদের ক্রোড়াশ্রয়ে প্রতিপালিত হয়েছে তারাই 'জনগণকে বিভক্ত' করার অভিযোগ আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী শক্তির ওপর।

তারা সজ্ঞানে ভুলে যেতে চায় '৭১-এর ক্ষুদ্র বিভক্তি যা অনিবার্য ছিল, সেটাই আজ বিশাল আকার ধারণ করেছে তাদের শাসন ও অন্যান্য প্রচেষ্টার মাধ্যমে। '৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীর সংখ্যা ছিল কম। '৬৯-৭০ সালে তারা ছিল ছায়া শক্তি। প্রকাশ্যে বিরোধিতা করার শক্তি ছিল না। '৭১-এ এসে সেই ক্ষুদ্র শক্তি পাকবাহিনীর মদতপুষ্ট হয়ে হায়েনা শক্তিতে পরিণত হয়।

যদিও তাদের সেদিনের শক্তিও স্বাধীনতাকামী গোটা বাঙালি জাতির তুলনায় ছিল নগণ্য। তবে সেদিন তারা যেসব অপরাধ করেছিল, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ গণ্য হয়ে তারই আজ বিশেষ আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিচার চলছে। কয়েকদিন আগে সাবেক ভাসানী ন্যাপ নেতা এবং বহু পথঘাট ঘুরে বর্তমানে জাতীয় পার্টির নেতা কাজী জাফর আহমদ এক টিভি চ্যানেলে বলেছিলেন, স্বাধীনতার পর ১৯৫ জন পাক সৈন্যকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। তাদের বিচার থেকে রেহাই দিয়ে এখন যাদের বিচার করা হচ্ছে তা কতখানি যুক্তিযুক্ত? কাজী জাফর আবার নিজেকে সেদিন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও দাবি করেছেন। তিনি কোথায় কোন সেক্টরে কোন কমান্ডারের অধীনে '৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন তা ইতিহাস খুঁজে বের করতে হবে।

সে প্রশ্ন না তুলে বলা যায় কাজী জাফরের মতো যুদ্ধাপরাধের বিচারের ব্যাপারে এ ধরনের কথা বিএনপি-জামায়াত ও একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী নামক টকশো বিষারদরাও বহুবার বলেছেন। আন্তর্জাতিক কোন সমঝোতার মাধ্যমে যদি চরম বিদেশি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার থেকে রেহাই দিতেও সেদিন সরকার বাধ্য হয়ে থাকে তাহলে দেশীয় যুদ্ধাপরাধী কুলাঙ্গারদের বিচার করা যাবে না_ এটা কোন আইনের বা যুক্তির কথা? জাফর সাহেবরা জেনে বুঝে ও সময় বুঝেই এ ধরনের প্রশ্ন তুলে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন। মূলত এদের আসল মনের কথা হলো_ যুদ্ধাপরাধের বিচার না করা। মোশতাক-জিয়া-এরশাদের রাজনৈতিক দর্শনের যোগ্য উত্তরসূরি বেগম খালেদা জিয়া, বর্তমানে বিরোধীদলের নেতা। এতদিন মনের কথা চেপে রেখে 'যুদ্ধাপরাধের বিচার আমরাও চাই, তবে তা হতে হবে প্রকৃত অপরাধীদের এবং আন্তর্জাতিক মানের' মুখে যেসব কথা বলেছিলেন তা যে সত্যি নয় তা তিনি নিজেই প্রমাণ দিয়েছেন তার সাম্প্রতিককালের কিছু বক্তব্যে।

তিনি গ্রেফাতরকৃত বন্দীদের সরাসরি মুক্তি দাবি করেছেন, দেশি-বিদেশিরা যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার পর্যবেক্ষণ করে তা সঠিক পথেই এগোচ্ছে বলে মন্তব্য করেছে তখন তিনি বলেছেন_ যুদ্ধাপরাধের নিরপেক্ষ বিচার হচ্ছে না, প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করা হয়েছে ইত্যাদি। তার ওপর জামায়াতের সঙ্গে এক জোট হয়ে তিনি ও তার দল আন্দোলনের নামে যা করছে তা মূলত যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করারই নামান্তর। সর্বোপরি তিনি এমন কথাও শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে বলেছেন যে, '৭১-এ তো আপনারাও গণহত্যা চালিয়েছিলেন। ' আওয়ামী লীগ বা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনাবাহী শক্তির বিরুদ্ধে জামায়াত, সাম্প্রদায়িক দল, মৌলবাদী গোষ্ঠী এবং জঙ্গি শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে যিনি এখন বিরোধীদলের নেত্রী তিনিই বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। এহেন সমর্থিত শক্তির সঙ্গে কোনভাবেই আপস বা সমঝোতা হতে পারে না স্বাধীনতাকামী কোন রাজনৈতিক দল ও জোটের।

আর এই বৈপরীত্যের কারণে যদি জনগণের মধ্যে বিভক্তি হয়ে থাকে তাহলে সেটাই সঠিক ও অনিবার্য '৭১-এ এ বিভক্তি ছিল ক্ষুদ্র আকারে। তবু বৃহৎ শক্তিধর পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ করার পাশাপাশি দেশীয় সেসব রাজাকার, আলবদর, আলশামসের সঙ্গে যুদ্ধ করে সেদিন জাতিকে বিজয়ী হতে হয়েছে। সেদিনের ক্ষুদ্র ছায়া শত্রু '৭৫-এর পর জাতির সম্মুখ সারিতে আসতে শুরু করে তারাই আজ বিশাল আকার ধারণ করেছে। একজন মুক্তিকামী স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষের এ অবস্থায় কী করা উচিত? সে কি কেবল বাকযুদ্ধ আর ভোটাভুটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে নাকি সে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হবে? সেদিন '৭১-এর দখলদার পাকবাহিনীই তো আজ দেশীয় লেবাসে আবার দখলদার বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। এদের সমূলে উৎখাত করতে না পারলে বাঙালি কখনই যথার্থ স্বাধীনতা ও মুক্তির স্বাদ পাবে না।

জাতির পিতার সেই স্বপ্ন কেবল স্বপ্নই থেকে যাবে। দেশের একটি শিক্ষিত মহল যাদের 'বুদ্ধিজীবী' 'সুশীল সমাজ' ইত্যাদি বলে অভিহিত করা হয় তাদের উল্লেখযোগ্য অংশই সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যমূলকভাবে 'জাতিকে বিভক্ত করা হচ্ছে' ধুয়া তুলে তারা মূলত '৭১-এর জঘন্য অপরাধীদের যেমন রক্ষা করতে চায় তেমনি যে রাজনৈতিক শক্তি ওই একই ধুয়া তুলে যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধ করতে চায় তাদেরও তারা কৃপাভাজন হওয়ার চেষ্টা করেন। এহেন বুদ্ধিজীবীরাই যথার্থ জ্ঞানপাপী। এরা জাতির কাছ থেকে শ্রদ্ধা আশা করতে পারে না। '৭১-এর ঐক্যবদ্ধ বাঙালির মধ্যে যে ক্ষুদ্র অংশ বিভাজন সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল তারা আজ ৩৭ বছরে বড় আকার ধারণ করেছে।

আর সেটা সম্ভব হয়েছে মোশতাক, জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়ার মদতে এবং স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির অনৈক্য ও অসংগঠিত অবস্থার সুযোগে। অর্থাৎ জাতিকে বিভক্ত যদি কেউ করে থাকে তাহলে সেটা করেছে ওই হায়েনা শক্তিই। এ অবস্থা অনির্দিষ্টকাল চলতে পারে না। বাঙালির অস্তিত্বের স্বার্থেই সর্বশক্তি নিয়ে আর একবার রুখে দাঁড়াতে হবে। আগেও মাঝেমধ্যে অনেকবার শুনেছি, তবে ইদানীং বেশ ঘন ঘন শোনা যায়_ দেশকে বিভক্ত করে ফেলা হচ্ছে।

অর্থাৎ জনগণকে বিভক্ত করা হচ্ছে। দেশ ও জাতির অগ্রগতির প্রশ্নে যা খুবই ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক। রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে যখন এই বিভক্তির কথা বলা হয় তখন তার সাধারণ একটা অর্থ বোঝা যায়। একে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাঁড় করিয়ে ফায়দা নেয়ার উদ্দেশ্যেই তা করা হয়। কিন্তু দেশের বিশিষ্টজনরা যখন ওই কথা বলে তাদের জ্ঞানের বহর প্রমাণ করে বাহাবা নেয়ার চেষ্টা করেন তখন মনে হয়_ এরা হয় জ্ঞানপাপী নয়তো সুবিধাবাদী।

একটু দূরদৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করলেই দেখা যাবে পৃথিবীর সব দেশ ও জাতির মধ্যেই বিভক্তি রয়েছে। চিন্তা, চেতনা, রাজনীতি, সংস্কৃতি, ভাষা প্রভৃতি ক্ষেত্রেই বিভক্তি রয়েছে। এক মহল যদি একভাবে চিন্তা করে তাহলে অন্য মহল চিন্তা করে ভিন্নভাবে। পাকিস্তান আমলেই বাঙালি-পাকিস্তানি হিসেবে আমরা বিভক্ত ছিলাম। '৬৯, '৭০ ও '৭১ সালে এসে যখন বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করল পাকিস্তানিরা কোণঠাসা হয়ে পড়লেও বাঙালির সেই আন্দোলনের মাঝে অনেকেই আশ্রয় খুঁজে নেয়।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু থেকে বিজয় অর্জন পর্যন্ত বাঙালি পরিষ্কার দুই ভাগে বিভক্ত হয়। এক ভাগ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ধারক-বাহক অন্য একটি ক্ষুদ্র অংশ হলেও তারা ছিল মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে শক্তি। এই বিরুদ্ধ শক্তির দুটি অংশের একটি ছিল সরাসরি সশস্ত্রবিরোধী শক্তি অন্যটি ছিল চিন্তা, চেতনা ও বিশ্বাসে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে। এই দ্বিতীয় অংশেই ছিল বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ ও বিশিষ্ট নাগরিকদের একটি বড় মহল। যারা তাদের জ্ঞানবুদ্ধি দিয়েই সুকৌশলে নানাভাবে নানা পরিচয়ে স্বাধীনতার মূল চেতনাকে নষ্ট করার কাজে লিপ্ত হয়েছিল।

এরাই বিভিন্ন সময় বিশেষ করে ইদানীংকালে দেশ ও জনগণকে বিভক্ত করে ফেলা হচ্ছে, তাতে দেশের অগ্রগতি ব্যাহত হতে বাধ্য ইত্যাদি বলে সাধারণ দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করে ফায়দা নেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সব জাতির মধ্যেই চিন্তা-চেতনায় পার্থক্য থাকবে_ এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাঙালির জীবনে বিভক্তি এসেছে অনিবার্য কারণে_ যা ইতিহাসের বিষয়ে পরিণত। ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তানের জন্ম, সে জন্ম স্বাভাবিক ছিল না। যার মূলে ছিল রাজনীতিকদের খেলা এবং সাম্প্রদায়িকতা।

ফলে পাকিস্তানের সৃষ্টি মূলে ছিল সাম্প্রদায়িকতার বীজ। ব্যাপক অর্থে '৪৭-এ পশ্চিম পাকিস্তান সেই জন্ম মেনে নিলেও বাঙালিরা সেদিন তা স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়নি। তার প্রমাণ মেলে '৪৮-এর ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত থেকেই। ধীরে ধীরে সেই আন্দোলন নানাভাবে এবং নানা পরিচয়ে '৭১ এসে পৌঁছে। নিরীহ বাঙালি হয়ে ওঠে সশস্ত্র জাতি।

এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাঙালি স্বাধীন জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে গোটা জাতি সেদিন স্বাধীনতার মন্ত্রে ও ডাকে উদ্বুদ্ধ হয়ে যায় যা আছে তাই নিয়ে পাকি-শত্রুর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেও একটি মহল তা যে যত ক্ষুদ্রই হোক_ স্বাধীনতার বিরোধিতা করে এমনকি হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী হয়ে বাঙালি নিধন ও ধ্বংসযজ্ঞে মেতে ওঠে। অন্য একটি শিক্ষিত মহল তাদেরই সহযোগী হয়ে নানা উপায়ে মদত জোগায়। স্বাধীনতার পরে এদের সেই মুখোশ তারা পাল্টে ফেলে। চিন্তা-চেতনায় তাদের কোনই পরিবর্তন হয়নি। '৭১-৭২-এ এদের সংখ্যা কম থাকলেও ৪২ বছর পর এসে তাদের সংখ্যা আর কম নেই।

শিক্ষিতদের মধ্যেই এই মুখোশধারীর সংখ্যা বেশি। দেশের সাধারণ মানুষের চরিত্র এখন অনেক ভালো। তাদের মধ্যে যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন বা সাধ্যমতো সেই মহাসংগ্রামে শরিক হয়েছিলেন তারা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এখনও গর্ব করেন। নাতিপুতিদের উজ্জীবিত করেন, ইতিহাস শোনান। '৭৫-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে মূলত স্বাধীনতাবিরোধী মুষ্টিমেয় শক্তি তাদের ডালপালা গজাতে শুরু করে।

মোশতাক-জিয়া-এরশাদ-খালেদার হাত ধরে যে রাজনৈতিক শক্তি দেশে পুনর্বাসিত হয়েছে তারাই সুকৌশলে '৭১-এর চিন্তা, চেতনা, জাতীয় ঐক্য, আবেগ, জাত্যভিমান, সব কিছুকে পেছনে ফেলে অথবা পর্যুদস্ত করে মূলত পাক-আমলের দর্শন ও চেতনা দ্বারা জাতির ঐক্যকে বিভক্ত করেছে। তাদের সেই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা সম্পূর্ণ সফল না হলেও অনেকখানি সাফল্য নিয়ে আনতে পেরেছে। সমাজের একশ্রেণীর মতলববাজ বুদ্ধিজীবী যারা '৭৫ পরবর্তী শাসকদের ক্রোড়াশ্রয়ে প্রতিপালিত হয়েছে তারাই 'জনগণকে বিভক্ত' করার অভিযোগ আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী শক্তির ওপর। তারা সজ্ঞানে ভুলে যেতে চায় '৭১-এর ক্ষুদ্র বিভক্তি যা অনিবার্য ছিল, সেটাই আজ বিশাল আকার ধারণ করেছে তাদের শাসন ও অন্যান্য প্রচেষ্টার মাধ্যমে। '৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীর সংখ্যা ছিল কম।

'৬৯-৭০ সালে তারা ছিল ছায়া শক্তি। প্রকাশ্যে বিরোধিতা করার শক্তি ছিল না। '৭১-এ এসে সেই ক্ষুদ্র শক্তি পাকবাহিনীর মদতপুষ্ট হয়ে হায়েনা শক্তিতে পরিণত হয়। যদিও তাদের সেদিনের শক্তিও স্বাধীনতাকামী গোটা বাঙালি জাতির তুলনায় ছিল নগণ্য। তবে সেদিন তারা যেসব অপরাধ করেছিল, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ গণ্য হয়ে তারই আজ বিশেষ আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিচার চলছে।

কয়েকদিন আগে সাবেক ভাসানী ন্যাপ নেতা এবং বহু পথঘাট ঘুরে বর্তমানে জাতীয় পার্টির নেতা কাজী জাফর আহমদ এক টিভি চ্যানেলে বলেছিলেন_ স্বাধীনতার পর ১৯৫ জন পাক সৈন্যকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। তাদের বিচার থেকে রেহাই দিয়ে এখন যাদের বিচার করা হচ্ছে তা কতখানি যুক্তিযুক্ত? কাজী জাফর আবার নিজেকে সেদিন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও দাবি করেছেন। তিনি কোথায় কোন সেক্টরে কোন কমান্ডারের অধীনে '৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন তা ইতিহাস খুঁজে বের করতে হবে। সে প্রশ্ন না তুলে বলা যায় কাজী জাফরের মতো যুদ্ধাপরাধের বিচারের ব্যাপারে এ ধরনের কথা বিএনপি-জামায়াত ও একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী নামক টকশো বিষারদরাও বহুবার বলেছেন। আন্তর্জাতিক কোন সমঝোতার মাধ্যমে যদি চরম বিদেশি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার থেকে রেহাই দিতেও সেদিন সরকার বাধ্য হয়ে থাকে তাহলে দেশীয় যুদ্ধাপরাধী কুলাঙ্গারদের বিচার করা যাবে না_ এটা কোন আইনের বা যুক্তির কথা? জাফর সাহেবরা জেনে বুঝে ও সময় বুঝেই এ ধরনের প্রশ্ন তুলে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন।

মূলত এদের আসল মনের কথা হলো_ যুদ্ধাপরাধের বিচার না করা। মোশতাক-জিয়া-এরশাদের রাজনৈতিক দর্শনের যোগ্য উত্তরসূরি বেগম খালেদা জিয়া, বর্তমানে বিরোধীদলের নেতা। এতদিন মনের কথা চেপে রেখে 'যুদ্ধাপরাধের বিচার আমরাও চাই, তবে তা হতে হবে প্রকৃত অপরাধীদের এবং আন্তর্জাতিক মানের' মুখে যেসব কথা বলেছিলেন তা যে সত্যি নয় তা তিনি নিজেই প্রমাণ দিয়েছেন তার সাম্প্রতিককালের কিছু বক্তব্যে। তিনি গ্রেফাতরকৃত বন্দীদের সরাসরি মুক্তি দাবি করেছেন, দেশি-বিদেশিরা যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার পর্যবেক্ষণ করে তা সঠিক পথেই এগোচ্ছে বলে মন্তব্য করেছে তখন তিনি বলেছেন_ যুদ্ধাপরাধের নিরপেক্ষ বিচার হচ্ছে না, প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করা হয়েছে ইত্যাদি। তার ওপর জামায়াতের সঙ্গে এক জোট হয়ে তিনি ও তার দল আন্দোলনের নামে যা করছে তা মূলত যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করারই নামান্তর।

সর্বোপরি তিনি এমন কথাও শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে বলেছেন যে, '৭১-এ তো আপনারাও গণহত্যা চালিয়েছিলেন। ' আওয়ামী লীগ বা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনাবাহী শক্তির বিরুদ্ধে জামায়াত, সাম্প্রদায়িক দল, মৌলবাদী গোষ্ঠী এবং জঙ্গি শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে যিনি এখন বিরোধীদলের নেত্রী তিনিই বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। এহেন সমর্থিত শক্তির সঙ্গে কোনভাবেই আপস বা সমঝোতা হতে পারে না স্বাধীনতাকামী কোন রাজনৈতিক দল ও জোটের। আর এই বৈপরীত্যের কারণে যদি জনগণের মধ্যে বিভক্তি হয়ে থাকে তাহলে সেটাই সঠিক ও অনিবার্য '৭১-এ এ বিভক্তি ছিল ক্ষুদ্র আকারে। তবু বৃহৎ শক্তিধর পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ করার পাশাপাশি দেশীয় সেসব রাজাকার, আলবদর, আলশামসের সঙ্গে যুদ্ধ করে সেদিন জাতিকে বিজয়ী হতে হয়েছে।

সেদিনের ক্ষুদ্র ছায়া শত্রু '৭৫-এর পর জাতির সম্মুখ সারিতে আসতে শুরু করে তারাই আজ বিশাল আকার ধারণ করেছে। একজন মুক্তিকামী স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষের এ অবস্থায় কী করা উচিত? সে কি কেবল বাকযুদ্ধ আর ভোটাভুটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে নাকি সে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হবে? সেদিন '৭১-এর দখলদার পাকবাহিনীই তো আজ দেশীয় লেবাসে আবার দখলদার বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। এদের সমূলে উৎখাত করতে না পারলে বাঙালি কখনই যথার্থ স্বাধীনতা ও মুক্তির স্বাদ পাবে না। জাতির পিতার সেই স্বপ্ন কেবল স্বপ্নই থেকে যাবে। দেশের একটি শিক্ষিত মহল যাদের 'বুদ্ধিজীবী' 'সুশীল সমাজ' ইত্যাদি বলে অভিহিত করা হয় তাদের উল্লেখযোগ্য অংশই সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যমূলকভাবে 'জাতিকে বিভক্ত করা হচ্ছে' ধুয়া তুলে তারা মূলত '৭১-এর জঘন্য অপরাধীদের যেমন রক্ষা করতে চায় তেমনি যে রাজনৈতিক শক্তি ওই একই ধুয়া তুলে যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধ করতে চায় তাদেরও তারা কৃপাভাজন হওয়ার চেষ্টা করেন।

এহেন বুদ্ধিজীবীরাই যথার্থ জ্ঞানপাপী। এরা জাতির কাছ থেকে শ্রদ্ধা আশা করতে পারে না। '৭১-এর ঐক্যবদ্ধ বাঙালির মধ্যে যে ক্ষুদ্র অংশ বিভাজন সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল তারা আজ ৩৭ বছরে বড় আকার ধারণ করেছে। আর সেটা সম্ভব হয়েছে মোশতাক, জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়ার মদতে এবং স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির অনৈক্য ও অসংগঠিত অবস্থার সুযোগে। অর্থাৎ জাতিকে বিভক্ত যদি কেউ করে থাকে তাহলে সেটা করেছে ওই হায়েনা শক্তিই।

এ অবস্থা অনির্দিষ্টকাল চলতে পারে না। বাঙালির অস্তিত্বের স্বার্থেই সর্বশক্তি নিয়ে আর একবার রুখে দাঁড়াতে হবে। সুত্র
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.