আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উকিল চাচা

মাঝে মাঝে বৃষ্টি দেখে হাত বাড়ানোর ইচ্ছে জাগে... ভেতর ভেতর যাই পুড়ে যাই, কেউ জানেনা আমার আগে...

উকিল চাচার এক পা ছোট। তাকে হাঁটতে হয় পা টেনে টেনে। তার পায়ের গোড়ালি জুড়ে শুকিয়ে যাওয়া কাদা। কাদার রঙ শুকিয়ে সাদা হয়ে গেছে। বিষয়টা অদ্ভুত, কুচকুচে কালো রঙের কাদাও শুকিয়ে গেলে সাদা রঙ ধারণ করে।

আব্বা উকিল চাচাকে ডাকলেন, 'উকিল, উকিল। ' উকিল চাচা গরুকে খইল-ভুষি-পানি খাওয়াচ্ছিলেন। তিনি তার কাঁধের গামছায় হাত মুছতে মুছতে আব্বার সামনে এসে দাঁড়ালেন, 'জ্বে ভাই, বলেন। ' - 'আমিতো বাড়িতে থাকি না। বাড়িতে আপনের ভাবী থাকে, আর থাকে দুইটা ছোট ছোট বাচ্চা।

এদের দেইখ্যা রাখনের জন্য উপরে আল্লাহ আছে, আর নিচে আছেন আফনে'। এই প্রশ্নের উত্তরে উকিল চাচা কিছু বলেন না। তার খালি গায়ে খৈল ভুষি লেগে আছে। তাতে আজদাহা সাইজের মাছি এসে বসছে। তিনি বা হাত নেড়ে মাছি তাড়ালেন।

- 'আর দেখছেনইতো কত কষ্ট কইরা একটু জমি জিরাত করছি, এখন তাতে মাইনসের শকুনের নজর পড়ছে। আমি থাকি ঢাকার শহর। এই গুলা লইয়া খালি চিন্তা। আফনে আছেন দেইখা একটু নিশ্চিন্ত থাকি'। উকিল চাচা এই কথারও কোন উত্তর দেন না।

ষাটোর্ধ বয়সের শক্ত শরীর। রোদে পোড়া কালো শরীরে বুকের ছাতি ইস্পাতের মত কঠিন। দুই বাহুর পেশীগুলো কিলবিল করে তাদের শক্তি জানান দিচ্ছে। উকিল চাচার চোখ জুড়ে ছানি পড়ছে। স্পষ্ট দেখতে পান না।

তিনি সেই আবছা চোখে মাটির দিকে তাকিয়ে আছেন। আব্বা উকিল চাচার কাঁধে হাত রাখেন, 'উকিল, যাই তাইলে। আবার কবে বাড়িত আসনের ছুটি ছাঁটা পাই হের ঠিক নাই। আফনে ভাই পশ্চিম মাথার জমিতে এইবার ইরি ধান কইরেন। মেশিনতো একটা কিন্নাই দিছি, আর চিন্তা কি! আর ওরা দুই ভাইতো আছেই।

ওরাও লাগলে হাত আলগোছি দিল। আপনে একলাতো আর সব পারবেন না'। আব্বা লঞ্চে ওঠেন। তিনি ঢাকায় ছোট চাকুরি করেন। সেই চাকুরীর বেতন সাড়ে তিন বা চার হাজার টাকা।

আজই ছুটি শেষ। কাল থেকে তার অফিস। বাড়িতে থাকি ১২-১৩ বছরের আমি, আমার ছোট ভাই, আম্মা, বু আর উকিল চাচা। উকিল চাচার বিষয়টা খোলাসা করি। তিনি আসলে কোর্টের উকিল জাতীয় কিছু না।

গ্রামে গঞ্জে অদ্ভুত অদ্ভুত সব বংশের নাম থাকে। সেইসব বংশের লোকজন জানেও না যে তাদের বংশের এই নাম হওয়ার কারণ কি! উকিল চাচার নাম ইয়াছিন। কিন্তু তার বংশের নাম উকিল। অদ্ভুতভাবে তার নাম থেকে ইয়াছিন উধাও হয়ে পার্মানেন্টলি উকিল গেড়ে বসেছে। তাকে এখন আর কেউ ইয়াছিন নামে চেনে না, চেনে উকিল নামে।

সেই উকিল আমাদের বাড়িতে কাজ করেন। আব্বা তাকে মাসে পাঁচশো টাকা মাইনে দেন। সাথে তিনবেলা খাবার। আব্বা যা বেতন পান, তাতে আমাদেরই চলে না। তারওপর উকিলের মত অতিরিক্ত একজনকে পোষা রীতিমত বিলাসিতা।

কিন্তু আব্বা এই বিলাসিতা করবেন-ই। তাকে এই বিলাসিতা থেকে ঠেকানোর সাধ্য কারো নাই। প্রয়োজনে আমরা না খেয়ে থাকবো, আব্বা তার থোরাই কেয়ার করেন। তিনি বাড়ি থাকবেন না, আমাদের ঘরে মাথার উপর ছনের চাল, কিন্তু বাড়িতে টিনের চালা দেয়া একটা গোয়াল ঘর থাকতেই হবে, সেই গোয়াল ঘরে তালপুকুরের মতন ঘন কালো গভীর চোখের একটা গাই থাকতেই হবে। সেই গাইয়ের পাশে তিরিংবিরিং করে লাফানো একটা বাছুর থাকতেই হবে।

আব্বার যেটুক জমি জিরেত আছে, তাতে লাঙল চাষে ফসল ফলাতেই হবে। সেই ফসল উঠোন জুড়ে শুকোতেই হবে। ঘর এবং উঠোনের বাতাস জুড়ে সেই ফসলের ম' ম' গন্ধে মাতাল হতেই হবে। এই অলিখিত সংবিধান বাস্তবায়ন করতেই উকিল চাচা আমাদের বাড়িতে। তিনি ঠিক মতো হাঁটতে পারেন না।

অথচ, নদীর পারের খাড়া ঢাল বেয়ে তিনি বালতি বালতি পানি তুলেন ইরি ধানের জমির জন্য, ছানি পড়া চোখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কোদাল হাতে লাঙল না পড়া মাটিগুলো কুপিয়ে ঝরঝরা করেন। আঁটির পর আঁটি ধান, পাঁট, কলাই কিংবা মশুরির ডাল মাথায় করে জমি থেকে বাড়ির উঠানে নিয়ে আসেন। আমাদের খেলতে দেখলেই কোদাল হাতে তেড়ে আসেন, 'তোগো বাপে ঢাকার শহর মাইনসের কামলা দেয়, আর তোরা এইখানে জমিদারি ফুটাস! আয়, আমার লগে আয়, জাঁক দেওয়া পাঁটগুলান উডাইতে হইব। একটা কামলার টাহাও যদি বাঁচাইতে পারি, তোর বাপে কত খাডা খাডনি কইরা, কত কষ্ট কইরা, খাইয়া না খাইয়া বাড়িতে টাহা পাডায়। তোরা যদি ইট্টু কামে হাত লাগাস তাইলেই কিন্তু টাহাডা একটু কম লাগবো! আর কত মাইনসের বাড়িতে চাহর (চাকর) খাটবো ব্যাডায়।

বাপের জন্য দিলের মইধ্যে একটু মায়া মহাব্বত থাকতে অয়। বাপ না থাকলে তহন বুঝবা! এহন কি'! উকিল চাচাও কিন্তু আমাদের বাড়িতে চাহর খাটেন। মাত্র পাঁচশ টাকায় মাসকাবারি চাহর! তার সাথে আমাদের কোন রক্তের সম্পর্ক নাই। কিন্তু তিনি কেমন কেমন করে যেন হয়ে ওঠেন আমার বাবার এইটুক সংসারের অলিখিত অভিভাবক। বাড়িতে মেহমান এসেছে।

উকিল চাচার মেজাজ জ্বলন্ত উনুনের মতন। ভাত খেতে বসে আম্মার সাথে গজগজ, 'ভাবিছাব, চাউলের কেজী এহন ষোল টাহা কইরা। এই যে এট্টা দানা মোহে (মুখে) দেই, কইলজাডা কাইপ্যা ওডে। ভাই যাওনের আগে একবস্তা চাউল কিন্যা দিয়া গেছিল। এহন যদি এমুন কইরা মেহমান খাওয়াইয়া আগেই শ্যাস কইর‍্যা হালান, কেমনে সামলাইব হেই ব্যাডায়? আফনেতো বাড়িডারে লঙ্গরখানা বানাই ফেলছেন ভাবিছাব।

যে কামাই করে হে বোঝে কামাই করার কি মজা! মহিলা মাইনসে বোঝে না। ' আম্মার সাথে উকিল চাচার তর্ক শুরু হয়। উকিল চাচা ভাত ছেড়ে উঠে যান। সাড়া দিন গজগজ করতে থাকেন, 'মাইয়া মানুষ নাকি বাড়ির লক্ষ্মী! কিয়ের লক্ষী!! এইরম মাইয়া মানুষ কাউর ঘরে থাকলে হেই ঘরের লক্ষীও পলাইব!' দুইদিন বাদে বাড়ির মেহমান চলে গেলে উকিল চাচার মাথা ঠাণ্ডা হয়। তিনি বাড়ির কলা গাছের কলা, পেপে গাছের পেঁপে, শিম মাচার শিম তুলে নিয়ে বাজারে যান।

সেগুলো বিক্রি করে টাকা এনে আম্মার হাতে দিতে দিতে বলেন, 'ভাবীছাব, আমার উপর রাগ কইরেন না। বাপ-মা'য় মরা দুইন্যায় অভাবের মইধ্যে লাথি গুঁতা খাইয়া বড় হইছি। মনডা তাই হেই 'ছোড' ছোডই রইয়া গ্যাছে। এই টাহা কয়ডা রাহেন, এই কয়দিন অতিথ-মেহমানের লাইগ্যাতো ম্যালা খরচ হইছে!' আম্মা হাত বাড়িয়ে নির্বিকারভাবে উকিলের হাত থেকে টাকাগুলো নিয়ে নেন। তার কাছে এটাকে বিশেষ কিছু মনে হয় না।

এটা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনার অংশবিশেষ। উকিল এমনই। এতে আহ্লাদিত হওয়ার মত কিছু নেই! দীর্ঘদিন উকিল চাচার সাথে কোন যোগাযোগ নেই। আমি চলে গেছি হোস্টেলে। শুনেছি উকিল চাচার ছেলে ঢাকায় কি কাজ পেয়েছে, সে এখন আর তার বাবাকে মানুষের বাড়িতে কাজ করতে দিবে না।

তাছাড়া উকিল চাচার বয়সও হয়েছে। তার বড় স্ত্রী মারা যাওয়ায় তিনি আবার বিয়ে করেছিলেন। বড় স্ত্রীর ঘরের তার ছেলেদের সাথে তার কোন যোগাযোগ নেই। অবশ্য তাদেরও অভাবের সংসার। উকিল চাচার ছোট স্ত্রীর ঘরে এক ছেলে আছে।

সেই ছেলে মৃত্যুর আগের বাকী কটা দিন বাবাকে একটু শান্তিতে রাখতে চায়। তাই উকিল চাচা কবে যেন আমাদের বাড়ী থেকে চলে গেলেন। আমার জীবন তখন নানাবিধ ঝড়ে টালমাটাল। উকিল চাচার কথা দিব্যি ভুলে গেছি। সেবার অনার্স থার্ড ইয়ার পরীক্ষার সময় বাড়ীতে গেছি।

আব্বা স্ট্রোক করে ডান দিকটা প্যারালাইজড। পুরো সংসার আমার ঘাড়ে। আমার পড়াশোনার খরচ। দুশ্চিন্তায় মাথা কোন কাজ করছে না। সেই অবস্থায় আবছা কানে আসলো, উকিল চাচার সেই ছোট ছেলে বিয়ে করেছে।

তাদের নতুন সংসার। ছেলের বউ উকিল চাচাকে কিছু একটা বলেছে। উকিল চাচা ততদিনে পুরপুরি অন্ধ। কিছুই চোখে দেখেন না। তিনি সেই অন্ধ চোখে, খোরা পায়ে তখুনি ঘর থেকে বেড়িয়ে এসেছেন।

উকিলের শরীরে আর শক্তি নেই, চোখে দৃষ্টি নেই, যে আবার কিলবিল করা বাহু, ইস্পাত শরীর আর আসমান সমান হৃদয় নিয়ে কারো বাড়িতে কাজ করতে যাবেন। তাই উকিল চাচার স্ত্রী-ই মানুষের বাড়ীতে ফুটফরমায়েস খাটেন। তাতে হয়তো কিছু ভাত, এঁটো তরকারি, পুরান কাপড়, দুটাকার খুচরা নোট, ক'খানা বাসী রুটি জোটে। জোটে জীবনের আরও কটা দিন। ------------------ অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শেষ।

বাড়ী যাবো। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল ভর্তি গিজগিজে মানুষ। আমি সেই মানুষের ভিড়ে নিজেকে কোনমতে সেধিয়ে দিয়ে দাড়িয়ে আছি। মানুষের চলমান স্রোতে ভেসে যাচ্ছি। লঞ্চের সামনে ভীর খানিকটা কম।

সেখানে দাড়িয়ে দেখছি, লঞ্চে পরিচিত কেউ আছেন কি না। হঠাৎ পেছন থেকে শার্টের নিচের অংশ ধরে কেউ একজন টানছেন। প্রবল বিরক্তি নিয়ে পিছু তাকালাম। - 'বাজান আমি অন্ধ মানুষ। চউক্ষে দেহি না।

ইট্টু সাহাইয্য করবেন বাজান?' যে বৃদ্ধ মানুষটি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তার চোখে মোটা ফ্রেমের কালো চশমা। হাতে লাঠি। শুকনো টিনটিনে শরীর। মুখভরতি যে ঘন সাদা চাপদাড়ি তার আড়াল থেকেও ভেঙে যাওয়া গালের হনু উঁচু হয়ে আছে স্পষ্ট। তার মুখ জুড়ে ক্লান্তি।

তার মুখ জুড়ে কান্না। তার মুখ জুড়ে লজ্জা! সংকোচ! জড়তা! ভয়! আর পরাজয়। আমি একদৃষ্টিতে মানুষটার দিকে তাকিয়ে থাকি। তাকিয়ে থাকি। এবং তাকিয়ে থাকি।

আচ্ছা, এই মানুষটাকে কি আমি চিনি? নাহ, চিনি না! ঈশ্বর আমাদের সবাইকে 'মানুষ' চেনার চেনার ক্ষমতা দেন নি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।