আমি তোমায় বুঝেছি সমগ্র বুঝহীনতার ভেতর দিয়ে।
আমি আগে না জানিয়া সখিরে কইরে পিরীতি আমার দুঃখে দুঃখে জীবন গেলো, সুখ হইলো না এক রতি...।
দিল ঠাণ্ডা করার জন্য অনেকে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির মাইজভান্ডার শরীফে যান। সেই মাইজভান্ডার শরীফের বার্ষিক ওরছে চট্টগ্রামের দাউদুল ইসলামের সাথে পরিচয় হয় নেত্রকোনার ছৈয়দ মিজানুর রহমানের । দুজনের মধ্যে কথাবার্তা বেশি দূর এগোয় নাই।
সেই সামান্য আলাপেই মিজান জানান তার বাড়ি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে। গীতিকবি উকিল মুন্সীর বাড়ির কাছাকাছি। মিজান উকিলের বাড়িতে বাড়িতে গিয়েছিলেন ২০১১ সালের বর্ষায়। বাড়ির উঠোনে উকিল মুন্সীর কবর। পাশেই বেতাই নদী।
নদীর কূল ভেঙ্গে কবর তলিয়ে যাবার অবস্থায় পৌছেছে। খবরটা দাউদের মনে দাগ কাটে। ঠিক করে উকিলের কবর দেখতে যাবে। মিজানের নাম্বার টুকে রাখে।
২০১২ সালের ফেব্রুয়ারী মাস।
কুষ্টিয়ায় লালন আখড়ার দোল পূর্ণিমার অনুষ্ঠান শেষে দাউদ ঢাকা আসে। উকিল মুন্সীর বাড়ি যাওয়া নিয়ে আগেই উঠে ছিলো। এবার সেটা পাকা হলো। হাতে সময় থাকলে সুসং-দুর্গাপুর, গারো পাহাড় ঘুরে আসব। সাথে নেত্রকোনার আদি গয়ানাথের আসল বালিশ মিষ্টি তো আছে।
উকিলের বাড়িতে যাবার পরিকল্পনার মূলকথা হলো তার কবর সংরক্ষণের জন্য কিছু করা যায় কিনা সেটা দেখা। কিন্তু এই বিষয়ে আমার মনে খুঁতখুঁত করছিল। দুইদিন পর তেইশ ফেব্রুয়ারী নেত্রকোনার মোহনগঞ্জগামী কাজী এন্টারপ্রাইজের জন্য অপেক্ষা করতে করতে জিজ্ঞেস করি, উকিল মুন্সীর ভাব-চিন্তা জানা ও বুঝার জন্য তার গানই তো যথেষ্ট। সেখানে কবর সংরক্ষণের দরকার কি? তার উত্তর, সাধক পুরুষদের রুহানী ক্ষমতা হয়তো কিছু মানুষ তাদের বাণী দিয়ে আর কিছু দ্বারা হৃদয়ঙ্গম করতে পারে। যদিও দুই ধরণের জানা সমার্থক নয়।
তা সত্ত্বেও, তাকে ভালোভাবে বুঝতে গেলে চোখে দেখা চিহ্ন দরকার। তাহলে ভাব মানে ইন্দ্রিয়াতীত নয়! চিহ্ন দিয়ে অতীতের বহমান ধারার সাথে সম্পর্ক তৈরী হয়। চিহ্ন না থাকলে আমরা কাকে জানতে চাই অথবা কি হারিয়েছি সেই প্রশ্ন তোলারও সুযোগ থাকে না। আরেকটা বিষয়- দাউদের ধারণা উকিল মুন্সী কোন সুফী সিলসিলার অনুসারী না হয়ে পারেন না। গুরুবাদী ধারায় না গিয়ে এই ধরণের গান লেখা যায় না।
আমি তার সাথে পুরোপুরি একমত হলাম না।
কিন্তু চিহ্ন কি দেয় এটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে থাকল। যদি বলি উকিল মুন্সীকে জানতে চাই- তার এক মানে হলো গানের বাণীর মর্ম উদ্ধার। কেন না, এই গান না হলেও তার অন্য কোন তাৎপর্য থাকত কিনা, সেই প্রশ্ন তুলে তো লাভ নাই। অচিন উকিল মুন্সীর দিকে যাত্রার শুরু তো গানকে সামনে রেখে।
সে অর্থে নিছক কবরের দেখার মধ্যে তাকে বুঝার সম্পর্ক নাই। এর বাইরে কি আছে সেটাও আমরা নিশ্চিত না। তাহলে কি শুধুমাত্র গানের বাণী দিয়ে বুঝা যাবে নাকি অন্য কিছু!
আমরা যেখানে যাচ্ছি সেই স্থানের তার সাথে উকিলের বেড়ে উঠার যোগ আছে। যদিও, স্থান ইতিহাস নিরপেক্ষ বিষয়। তার ভূগোলের আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে।
নানাভাবে সে সময়ের সাথে পাল্টেও যায়। কিন্তু সেই স্থানের অতীত বর্তমানের সম্পর্কের রেশ ধরে ঐতিহাসিক উকিল মুন্সীকে নিয়ে নিদেনপক্ষে কিছু অনুমান তো করা যাবে। এর বাইরে মহাপুরুষদের অনুসন্ধানের সাথে সাধারণ মানুষ আত্মিক সম্পর্ক অনুভব করে, যাকে এক অর্থে চিরায়ত নামে ডাকা যায়। তারা যেভাবে ডাকতে গিয়ে ডাকতে পারেন না- সেই অসম্ভব কি উকিল সম্ভব করেন নাই! যদি করে থাকেন, সেটা কি? শুধুমাত্র বাণীই কি সেই চিরায়ত হৃদয়ঙ্গমের খোরাক যোগাতে পারে? এর সাথে দার্শনিক, ধর্মতাত্ত্বিক এবং রাজনৈতিক জিজ্ঞাসাও জড়িত। আপাতত এইসব প্রশ্ন নিয়েই আমাদের যাত্রা।
উত্তর তো দূর কি বাত, আমরা নিশ্চিত না এই প্রশ্ন বা ভাবনার পরিচ্ছন্ন রূপ আমাদের সামনে হাজির হবে কিনা। দেখা যাক কি হয়। এলাহি ভরসা।
মহাখালি বাস টার্মিনাল থেকে বরাবর সকাল এগারোটায় বাস ছাড়ল। এর আগে কাউন্টারে খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছিলো বিকেল চারটার মধ্যে পৌছে যাবো।
কিন্তু সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় নামলাম মোহনগঞ্জ। এই অঞ্চলের মোহনগঞ্জ, ঠাকুরকোনা, সুসং-দুর্গাপুর সব জায়গায় একটা মজার বিষয় লক্ষ্য করেছি- গাড়ীতে টিকেট কেটে উঠতে হয়, সময় মতো ছাড়ে কিন্তু পথে কতক্ষণ থামবে তার কোন বাধা-ধরা নিয়ম নাই। একবার তো দুর্গাপুর থেকে শ্যামগঞ্জ যাওয়ার পথিমধ্যে পেছনের গাড়ীর জন্য এক ঘন্টা অপেক্ষা করল। ঢাকার বাইরে গেলে মনে হয় মানুষের হাতে অফুরন্ত সময়!
মোহনগঞ্জ উপজেলা সদরে নেমে দেখি বিদ্যুৎ নাই। মিজানকে মোবাইল করা হলো।
এই অবসরে রুটি আর পরোটা খেয়ে নিলাম। মিজান আসলেন তার বন্ধু ফয়সলকে নিয়ে। দুইজনেই স্থানীয় কলেজে প্রথম বর্ষে পড়ে। কুশল বিনিময় শেষে প্রথম কাজ হলো থাকার থাকার হোটেল ঠিক করা। মোহনগঞ্জ স্টেশনের পাশে শাপলা হোটেলে উঠলাম।
মোহনগঞ্জ স্টেশন চালু হয়েছে ব্রিটিশ আমলে। ঢাকার কমলাপুর স্টেশন থেকে মোহনগঞ্জগামী নিয়মিত ট্রেন আছে। এইখানকার মাছ বাজার বেশ বিখ্যাত। শাপলা হোটেলে থাকার ব্যবস্থা খারাপ না। বোর্ডারে ভর্তি।
মিজান জানিয়ে গেলেন পরদিন সকালে আমাদের নিয়ে উকিলের অঞ্চলে যাবেন। চিন্তার বিষয় হলো কিভাবে যাওয়া যায়। মিজান গিয়েছিলেন বর্ষার সময়। বর্ষাকালে পুরো অঞ্চল পানিতে ভেসে উঠে। ট্রলারে করে হাওর হয়ে একেবারে উকিলের ভিটায় উঠা যায়।
আমরা জিগেস করলাম- সেখানে এমন কারো সাথে কি দেখা হবে যিনি উকিল মুন্সীকে নিয়ে তথ্য দিবেন। তিনি জানালেন সেখানে দেখা হবে উকিল মুন্সীর মেয়ের সাথে। আমরা অবাক হলাম। উকিল মুন্সী যে সময়ের বলে জানি তাতে তার মেয়ে এতো বছর বেচে থাকার কথা না। হুমায়ুন আহমেদের মধ্যাহ্ন উপন্যাসে উকিল মুন্সীর যে তথ্য পেয়েছিলাম- তা ১৯২০ সালের দিকের কাহিনী।
সে বইয়ে তাকে নিঃসন্তান বলা হয়েছে। সে সময় তার স্ত্রীও মারা যান। কবি নির্ঝর নৈঃশব্দ্যকে মোবাইল করলে জানান, উকির মুন্সী মারা গেছেন একশ বছর আগে। সত্যি বলতে কি- উকিল মুন্সীকে নিয়ে যতটুকু জানা ছিলো সেই সামান্য জ্ঞানের উৎস হুমায়ুন আহমেদের মধ্যাহ্ন উপন্যাস ও বারী সিদ্দীকীর গাওয়া কয়েকটা গান। প্রসঙ্গত: এই উপন্যাস ছাড়া উকিলকে নিয়ে কোন লেখাজোখা চোখে পড়ে নাই- কেউ হদিসও দিতে পারেন নাই।
ইতিহাস আর ফিকশনের তফাত মানতেই হবে। এমনও হতে পারে সামনে আমরা যা কিছু আবিষ্কার করব তারও রূপ বিষয়ীগত চাহিদা দ্বারা নির্ধারিত হবে। তাই সত্য দাবির বদলে ন্যুনতম ভরসার আশা হয়তো আমরা করতে পারি- কিছু তথ্য তো জানা যাবে। সে যাই হোক, তখনকার অবস্থা নিয়েই বলি- অজ্ঞতা সংশয় আর উৎকন্ঠার পাখনা মেলে দিলো। আমরা কোন উকিল মুন্সীকে খুঁজতে এসেছি? দাউদকে বললাম, হয়তো নাতনীকে তারা মেয়ে বলছে।
সে বলল, হতে পারে।
> যাদের ধৈয্য এখনো পর্যন্ত টিকে আছে। বাকিটা পড়তে ক্লিক করুন: উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে ।
>ফটো: দাউদুল ইসলাম।
>আমার লেখার খাতা: ইচ্ছেশূন্য মানুষ ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।