টেন্ডার ছাড়াই একসঙ্গে চারটি উড়োজাহাজ লিজ নিচ্ছে বিমান। রাষ্ট্রীয় এই এয়ারলাইন্স সংস্থাটির ইতিহাসে এবারই প্রথম নজিরবিহীনভাবে অতি গোপনে উচ্চ দরে পাঁচ বছরের জন্য লিজ নেওয়ার সব প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করেছে। শক্তিশালী লিজ সিন্ডিকেটের একের পর এক দুর্নীতি আর অনিয়মের মধ্য দিয়ে এই লিজ প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত হওয়ায় বিমানে তোলপাড় শুরু হয়েছে।
জানা গেছে, লিজ সিন্ডিকেটের পছন্দের মিসরের ইজিপ্ট এয়ারলাইন্স থেকে দুটি বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর এবং যুক্তরাষ্ট্রের এটলাস ট্রান্সপোর্ট থেকে দুটি টার্বো প্রপ-উড়োজাহাজ লিজ নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যেই ইজিপ্ট এয়ারলাইন্সের দুটি এয়ারক্রাফটের পরিদর্শন কাজ শেষ হয়েছে।
ইজিপ্ট এয়ারের শীর্ষ ম্যানেজমেন্টকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে বিমান কর্তৃপক্ষ গত সপ্তাহে চিঠি পাঠিয়েছে মিসরে। টার্বো প্রপ-উড়োজাহাজ পরিদর্শনে আগামী ২-১ দিনের মধ্যে বিমানের একটি দল যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা করবে। পরপর দুই দফায় যারা লিজের জন্য নন রেসপন্সিভ হয়েছিল তাদেরই উচ্চ দরে এখন উড়োজাহাজ দেওয়ার জন্য চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের শেষ সময়ে বিমানে মহালুটপাটের আয়োজন করতেই পছন্দের দুটি কোম্পানি থেকে চারটি উড়োজাহাজ একসঙ্গে লিজ নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। আর এই কাজটি করতে গিয়ে একের পর এক কেলেঙ্কারির জন্ম দিয়েছে লিজ সিন্ডিকেট।
উচ্চমূল্যে এ চারটি উড়োজাহাজ লিজ নেওয়া হলে বিমানকে গচ্চা দিতে হবে দেড়শ কোটি টাকারও বেশি। বিমানের পরিচালক (ক্রয় ও সংরক্ষণ) মোসাদ্দেক আহমেদ জানান, বিমান তার এখতিয়ারের মধ্যে থেকেই বিষয়টি করেছে। ভালো কোনো কোম্পানি না পাওয়ায় সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে লিজ নেওয়া হচ্ছে। বিমান কর্তৃপক্ষ বলছে, দুই দফা দরপত্র আহ্বান করা হলেও ভালো কোনো কোম্পানি থেকে এ ব্যাপারে সাড়া পাওয়া যায়নি। সে কারণে সরাসরি কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে উড়োজাহাজ লিজ নেওয়া হচ্ছে।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা জানান, উড়োজাহাজ লিজ নেওয়ার ক্ষেত্রে বিমানের নিয়ম অনুযায়ী দরপত্র আহ্বান করতে হবে। পাশাপাশি পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপন ও নিজস্ব ওয়েবসাইটে তা প্রকাশ করতে হবে। কোনো কোম্পানি এতে অংশ না নিলে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে লিজ নেওয়ার এখতিয়ার রয়েছে বিমানের। বিমানের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, ৪টি উড়োজাহাজ লিজ নেওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলেও বিশ্বের অধিকাংশ নামিদামি উড়োজাহাজ কোম্পানি, আর্থিক খাত ও লিজিং প্রতিষ্ঠানকে রহস্যজনক কারণে জানানো হয়নি। ভালো কোম্পানি যেন আসতে না পারে সে জন্য সিন্ডিকেট দেশি-বিদেশি পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া দূরের কথা বিমানের ওয়েবসাইটে পর্যন্ত দেওয়া হয়নি।
পছন্দের কয়েকটি কোম্পানির কাছে ই-মেইলে উড়োজাহাজ লিজের বিষয়ে জানানো হয়।
সূত্র জানায়, চারটি উড়োজাহাজ লিজ নেওয়ার ক্ষেত্রে নিয়মনীতি মানা হচ্ছে না। কোনো ধরনের ইডি (এঙ্িিকউটিভ ডাইরেক্টর) মিটিং করা হয়নি। এমনকি বোর্ড মিটিংয়ের অনুমোদন ছাড়াই মিসরের ইজিপ্ট এয়ারের কাছ থেকে দুটি বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর এয়ারক্রাফট লিজ নেওয়ার যাবতীয় কার্যক্রম চূড়ান্ত করা হয়। এ নিয়ে বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিলে গত ১৬ নভেম্বর তড়িঘড়ি করে বোর্ড মিটিং ডেকে লিজ কার্যক্রমের পোস্ট ফ্যাক্টো অ্যাপ্রুভাল নেওয়া হয়।
১৬ নভেম্বরের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন পরিচালনা পর্ষদের এমন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পর্যদের ওই বৈঠকে অধিকাংশ সদস্য এই পোস্ট ফ্যাক্টো অ্যাপ্রুভালে বাধা দেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তাদের সেই বাধা আমলেই নেওয়া হয়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিমানের ফাইন্যান্স বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, টার্বো প্রপ-উড়োজাহাজের জন্য গত বছর যে কোম্পানি দর দিয়েছিল মাসে ১ লাখ ৩০ হাজার ডলার, সেই কোম্পানি থেকেই এবার লিজ নেওয়া হচ্ছে এক লাখ ৪৫ হাজার ডলারে। টার্বো প্রপ-উড়োজাহাজের জন্যই ৫ বছর পর্যন্ত প্রতি মাসে লোকসান গুনতে হবে ৩০ হাজার ডলার করে। একইভাবে ইজিপ্ট এয়ার থেকে দুটি বোয়িং ৭৭৭ উমড়াজাহাজ নেওয়ার জন্য প্রতি মাসে লোকসান দিতে হবে এক লাখ ১০ হাজার ডলার।
ওই কর্মকর্তা জানান, গত মাসে বিমানের বিশেষজ্ঞ টেকনো কমিটি টেন্ডারের মাধ্যমে একটি বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর উড়োজাহাজ মাত্র ৫ লাখ ৭৫ হাজার মার্কিন ডলার দরে পেয়েছিলেন। কিন্তু ওই প্রস্তাবটি বোর্ডে পর্যন্ত যেতে দেওয়া হয়নি। ৬ লাখ ৩০ হাজার ডলারে ইজিপ্ট এয়ার থেকে উড়োজাহাজ নেওয়ার জন্য আগের কোম্পানির আরএফপি বাতিল করে দেওয়া হয়। যার কারণে বিমানকে এখন প্রতিটি উড়োজাহাজের জন্য মাসে ৫৫ হাজার মার্কিন ডলার বেশি দিতে হবে।
এ ছাড়া ইজিপ্ট এয়ারের উড়োজাহাজ দুটির জন্য ৫ বছর শেষে কমপক্ষে ৮০ কোটি থেকে ১০০ কোটি টাকা খরচ করে উড়োজাহাজাজ দুটিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে হবে বিমানকে।
সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের এটলাস ট্রান্সমপার্ট থেকে টার্বো প্রপ-উড়োজাহাজ লিজ নিতে গিয়ে বড় ধরনের কেলেঙ্কারির আশ্রয় নিতে হয়েছে বিমানকে। টার্বো প্রপ-উড়োজাহাজ দিতে সিঙ্গাপুরের একটি কোম্পানি দুটি দরপত্র জমা দেয় বিমানের নির্ধারিত ই-মেইলে। কিন্তু বিমানের ওই সিন্ডিকেট সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে দরপত্র থেকে সরিয়ে দিতে ই-মেইল থেকে তাদের একটি দর ফেলে দেয়। সংশ্লিষ্ট কোম্পানি বিমান কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানিয়েছে, তারা ই- মেইলে দুটি দরপত্র জমা দিয়েছে। কিন্তু বিমানের সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেট ওই দরটি গ্রহণ করেনি।
এ অবস্থায় ক্ষুব্ধ ওই বিদেশি কোম্পানি তাদের প্রথম দরটিও প্রত্যাহার করে নেয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।