১৮-দলীয় জোটের ডাকা ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচির প্রথম দিনে গতকাল মঙ্গলবার সারা দেশে সহিংসতায় আটজন মারা গেছেন। তাঁদের মধ্যে কুমিল্লায় অবরোধকারীদের পৃথক হামলায় বিজিবির এক সদস্যসহ দুজন মারা গেছেন। সাতক্ষীরায় যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের দুই নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ ছাড়া বগুড়ায় সংঘর্ষে বিএনপির এক নেতা এবং সিরাজগঞ্জ ও বরিশালের গৌরনদীতে দুজন পথচারী মারা গেছেন। ফেনীতে গত সন্ধ্যায় ককটেল বিস্ফোরণে আহত দুলাল মিয়া (৪০) নামের সিএনজিচালিত অটোরিকশার এক চালক রাত নয়টায় হাসপাতালে মারা গেছেন।
অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণার পরপরই গত সোমবার রাতে কুমিল্লায় সংঘর্ষে একজন মারা যান। এ নিয়ে অবরোধকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় গতকাল রাত ১০টা পর্যন্ত মোট নয়জন প্রাণ হারিয়েছেন।
রাজপথ, রেলপথ ও নৌপথের এই অবরোধ চলাকালে সাধারণ মানুষ ছিল চরম আতঙ্কিত। যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন থাকায় সারা দেশ কার্যত অচল ছিল। বিভিন্ন স্থানে রেললাইন উপড়ে ফেলায় ট্রেন যোগাযোগও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
আগুন দেওয়া হয় দুটি আন্তনগর ট্রেনে।
বগুড়া, ফেনী ও চুয়াডাঙ্গায় নির্বাচনী কার্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়েছে। অবরোধ চলাকালে ককটেলের হামলায় জয়পুরহাটে পুলিশের এক সদস্য তাঁর ডান চোখ হারাতে বসেছেন। রাজশাহীতে রাবার বুলেটে এক কিশোরের বাঁ চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে শত শত ককটেল হামলার ঘটনা ঘটেছে।
রাজধানীতে অবরোধ চলাকালে হরতালের মতোই চোরাগোপ্তা ককটেল বিস্ফোরণ, যানবাহনে অগ্নিসংযোগ আর পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে পিকেটারদের। নাশকতার আতঙ্কে রাজধানীর বেশির ভাগ দোকানপাট ও বিপণিবিতান বন্ধ ছিল। নগরের ভেতরে কিছু গণপরিবহন চলাচল করলেও দূরপাল্লার যান চলাচল একেবারেই বন্ধ ছিল। অনেক স্কুলেরই বার্ষিক পরীক্ষা হয়নি, তবে কিছু স্কুল পরীক্ষা নিয়েছে। এ ছাড়া আজকের প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা পিছিয়ে শুক্রবার নির্ধারণ করা হয়েছে।
এ ছাড়া খুলনা, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, পিরোজপুর, মাগুরা, গাজীপুরের কালীগঞ্জ ও টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অবরোধকারীদের সঙ্গে
পুলিশের সংঘর্ষ ও গাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কিশোরগঞ্জ, কুমিল্লা, গাইবান্ধাসহ বেশ কিছু জায়গায় সংবাদকর্মীদের ওপর হামলা হয়েছে। সর্বশেষ গত রাত আটটার দিকে ঢাকার নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ককটেল বিস্ফোরণে তিনজন দায়িত্বরত সাংবাদিক আহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে বাংলানিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক সাজেদা সুইটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
নির্বাচন কমিশন ৫ জানুয়ারি ভোটের দিন ধার্য করে দশম সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর এই ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচির ডাক দেয় বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোট।
বিএনপি দাবি করেছে, অবরোধ সার্থক করতে সারা দেশের মানুষ রাজপথে নেমে এসেছে।
অবরোধে নাশকতার দায় বিরোধীদলীয় নেতাকে নিতে হবে মন্তব্য করে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক বলেছেন, ‘রেললাইন উপড়ে ফেলা, নাশকতা, হত্যাসহ যেকোনো অপরাধে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তিনি যত বড় নেতাই হোন না কেন, তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে। ’ নাশকতাকারীদের চিহ্নিত করতে তিনি জনগণের সহযোগিতাও চেয়েছেন।
অবরোধ চলাকালে কুমিল্লার দক্ষিণ চর্থা এলাকায় জামায়াত-বিএনপির কর্মীরা একটি পিকআপ ভ্যানে আগুন ধরিয়ে দেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিজিবির সদস্যরা সেখানে এলে অবরোধকারীরা পুলিশ ও বিজিবির সদস্যদের ওপর হামলা চালান।
এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে রিপন (২৫) নামের বিজিবির একজন সদস্য নিহত হন। তিনি কুমিল্লা ১০ বিজিবি ব্যাটালিয়নের সদস্য।
গতকাল সকালে কুমিল্লার লাকসাম পৌর শহরের দৌলতগঞ্জ বাজারে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা বেশ কয়েকটি গাড়ি ও দোকান ভাঙচুর করেন। তাঁরা কয়েকটি ককটেলেরও বিস্ফোরণ ঘটান। বাধা দিলে তাঁরা পুলিশের ওপর হামলা চালান।
পরে পুলিশের অতিরিক্ত সদস্যরা এসে অবরোধকারীদের সরিয়ে দিতে ফাঁকা গুলি ছোড়েন। উভয় পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে রিকশাচালক বাচ্চু মিয়া (৩০) মারা যান। ওই সংঘর্ষে কমপক্ষে ৩০ জন আহত হন।
সাতক্ষীয়ায় জামায়াতের কর্মীদের হামলায় কলারোয়া উপজেলার দেয়াড়া ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হাসান ওরফে বাবু (৩২) নিহত হয়েছেন।
পরিবার জানিয়েছে, ছলিমপুরের বাড়ি থেকে মোটরসাইকেলে করে কলারোয়া শহরে নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার পথে জামায়াত-শিবিরের পিকেটাররা মাহমুদকে পথে আটকে পিটিয়ে হত্যা করেন।
এর সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা পর বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে একই জায়গায় একই ইউনিয়নের স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক রবিউল ইসলামকে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা কুপিয়ে হত্যা করেন।
বগুড়ার শাজাহানপুরের লিচুতলায় গতকাল বিকেলে অবরোধ চলাকালে বিএনপির কর্মী-সমর্থকেরা পিকেটিংয়ের চেষ্টা চালান। এ সময় পুলিশ বাধা দিলে বিএনপির কর্মী-সমর্থকেরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল ছুড়ে মারেন। তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশও রাবার বুলেট ও ফাঁকা গুলি ছোড়ে। এ সময় মোহাম্মদ ইউসুফ নামের একজন নিহত হন।
বিএনপি দাবি করেছে, ইউসুফ ২১ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। এই হত্যার প্রতিবাদে আজ বুধবার বগুড়ায় হরতাল ডেকেছে বিএনপি।
সিরাজগঞ্জে সকাল সাড়ে আটটার দিকে জগাই মোড়ে বিএনপির কর্মী-সমর্থকেরা গাড়ি ভাঙচুর করেন। সেখান থেকে পুলিশ জেলা বিএনপির এক নেতাকে আটক করলে অবরোধকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল ছোড়েন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট ও ফাঁকা গুলি ছোড়ে।
সাইকেল নিয়ে সেখান দিয়ে যাওয়ার পথে পথচারী সাকমান হোসেনের বুকে কাঁদানে গ্যাসের শেল লাগে। পরে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
তফসিল ঘোষণা ও অবরোধের ডাক দেওয়ার পর সোমবার রাত সাড়ে ১১টায় বরিশালের গৌরনদীতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পাল্টাপাল্টি মিছিল বের করে। বিএনপির সমর্থকেরা ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের গৌরনদীর ইল্লা বাসস্ট্যান্ডে মহাসড়কের ওপর টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন। তাঁরা বরিশালগামী কাঁচামালবাহী একটি ট্রাককে লক্ষ্য করে ইট মারলে ইটের আঘাতে কাঁচামাল ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম (২৭) আহত হন।
পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল তিনি মারা যান।
অবরোধ চলাকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ময়মনসিংহ, লালমনিরহাট, চাঁদপুর, গাজীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে রেলপথজুড়ে নাশকতার ঘটনা ঘটে। ফিশপ্লেট খুলে ফেলায় সকালে ময়মনসিংহের শ্যামগঞ্জে হাওর এক্সপ্রেসের কয়েকটি বগি লাইনচ্যুত হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় রেললাইন উপড়ে ফেলার পাশাপাশি দুটি ট্রেনে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করেছেন অবরোধকারীরা। লালমনিরহাটের মহেন্দ্রনগর স্টেশনেও হামলা হয়েছে।
ভোগান্তির পাশাপাশি নিরাপত্তাহীনতায় পড়তে হচ্ছে যাত্রীদের।
ফেনী সদর উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ে আগুনে বেশ কিছু কাগজপত্র পুড়ে গেছে। তবে কেউ আগুন দিয়েছে কি না, তা প্রশাসন নিশ্চিত করতে পারেনি।
বগুড়া সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুর রহিম জানান, গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সদর উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্সে উপজেলা নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এতে ওই কক্ষের যাবতীয় নথি পুড়ে যায়।
একইভাবে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে সোমবার রাতে অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্তরা আগুন দেয়।
উত্তরাঞ্চল থেকে রাজধানীর প্রবেশমুখ আমিনবাজারে গতকাল সকালে অবরোধকারীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে আটজনকে গ্রেপ্তার করেছে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিএনপির নেতৃত্বে ১৮ দলের নেতা-কর্মীদের আরেকটি মিছিল গাবতলী সেতুর পশ্চিম পাশে প্রধান সড়কের দিকে এগোতে থাকে। এ সময় পুলিশ জলকামান থেকে মিছিলে গরম পানি ছিটায় ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে।
একপর্যায়ে ১৮ দলের নেতা-কর্মীরা সাঁজোয়া যান লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়েন। এ সময় দুটি ককটেলের বিস্ফোরণ হয়। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষ বেধে যায়। উত্তরার আজমপুর রেলগেটে পুলিশের সঙ্গে অবরোধকারীদের সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় অবরোধকারীরা একটি মোটরসাইকেলে আগুন দেন।
[প্রতিবেদনের তথ্য পাঠিয়েছেন প্রথম আলোর ঢাকা, কুমিল্লা, সাতক্ষীরা ও সিরাজগঞ্জের নিজস্ব প্রতিবেদক এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিরা। ]
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।