একেবারে অতি নিকট অতীতে বিভিন্ন দেশে যারাই যুগের পর যুগ ধরে ক্ষমতায় টিকে ছিল এবং এবং এখনো আছে তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে মিল পাওয়া যায়। চূড়ান্ত দলীয়করন, গোষ্ঠীকরন, এলাকাকরন, আত্মীয়করন এবং সম্ভব হলে একেবারে পারিবারিকীকরন। রাষ্ট্রকে একেবারে নিজেদের পরিবার পরিজন এবং আত্মীয়স্বজনের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নেয় তারা। ক্ষমতার নিয়ন্ত্রন কেন্দ্র যথা সেনাবাহিনী, বিচার বিভাগ এবং শাসন বিভাগে এগুলো করা হয় অতি যতেœর সাথে। তথাকথিত গনতন্ত্র চালু থাকলে দেশের সব মন্ত্রণালয়গুলো দলের মধ্য থেকে শাসকের প্রতি একান্ত অনুগতদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে দেয়া হয়।
দল ব্যবস্থার বদলে যদি রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র বা অন্যকোন ব্যবস্থা থাকে তাহলে মন্ত্রণালয়গুলো শাসক তার পরিবারের সদস্য যেমন নিজের ছেলে, মেয়ে, মেয়ের জামাই, ছেলের বউ, ভাই, বোন, ভাইপো, বোনপো, ভাবী, এভাবে ক্রমে কাছ থেকে দূরের আত্মীয়দের মধ্যে বন্টন করা হয়। এছাড়া সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিচার বিভাগসহ অন্য সকল গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের সকল গুরুত্বপূর্ণ পদেও শাসকের প্রতি একান্ত অন্ধ অনুগত আত্মীয়স্বজনদের বসানো হয়। গাদ্দাফি, সাদ্দাম এর ছেলে মেয়ে, মেয়ের জামাই এবং আত্মীয়স্বজন কর্তৃক রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়, পদ পদবি দখলের খবর আমরা জেনেছি স¤প্রতি আরব গণজাগরনের সময়। দীর্ঘস্থায়ী শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য রাষ্ট্রের সকল গুরুত্বপূর্ণ পদে শুধু যে শাসকের আত্মীয় স্বজনদের বসানো হয় তা নয় বরং দল বা আত্মীয় স্বজনের মধ্যে যারা অসৎ, তাদের প্রাধান্য দেয়া হয়। কারণ শাসক যদি অত্যাচারি, দুরাচার জুলুমবাজ হয় তাহলে সৎ লোককে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসালে সে তার জন্য সমস্যা হয়ে দাড়ায়।
কারণ সন্তান বা নিজের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হলেও তারা শাসকের সব অন্যায় নির্দেশ সময়মত পালন করবেনা। তাই তার চারপাশের সব পদের সব লোকজনের কাছ থেকে সদা অন্ধ আনুগত্যের উপযুক্ত লোকজনকে বসানো হয় যাতে কখনো তার সাথে তারা বিশ্বাসঘাতকতা না করে। সেজন্য তাদের সামনে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সকল প্রকার ভোগ বিলাসের সকল দরজা খুলে দেয়া হয়। সকল প্রকার ক্ষমতার অপব্যবহার, লুটপাট, দুর্ণীতির ক্ষেত্রে তাদেরকে জবাবদিহিতার উর্ধ্বে রাখা হয়। বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে আদায় করা হয় ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য নিরঙ্কুশ আনুগত্য।
এজন্য তারা সম্ভব হলে রাষ্ট্রের পিয়ন থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পদ পর্যন্ত এভাবে ধীরে ধীরে দলীয়করন, আত্মীয়করন, পারিবারিকীকরন করে থাকে যাতে চরম দু:সময়েও তারা দুরাচার অত্যাচারী শাসকের পক্ষে থাকে। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য তার সকল অন্যায় নির্দেশ যাতে তারা পালন করে, জনগনের বুকে গুলি চালাতে যেন কেউ কোন কার্পন্য না করে।
এছাড়া এসব দীর্ঘস্থায়ী দুরাচারী শাসকদের আরেকটি মিল হল--চরম নির্মমতা। গদি টিকিয়ে রাখার জন্য এরা শত শত, হাজার হাজার এমনকি সব জনগনকেও মেরে ফেলতে কুন্ঠাবোধ করেনা। সাদ্দাম হোসেন, গাদ্দাফি, হোসনী মোবারক, হাফিজ আল আসাদসহ এ ধরনের সব শাসকের বিরুদ্ধেই নিজ জনগনের প্রতি গনহত্যা পরিচালনার নজির রয়েছে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য।
বর্তমানে বাশার আল আসাদ যে কত হাজার মানুষ মেরেছে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তার কোন সঠিক হিসেব নেই। গোটা দেশটাকেই সে ছারখার করে দিয়েছে। চেঙ্গিস, হালাকু সকলের নির্মমতা যেন ম্লান হতে বসেছে তার ধ্বংস যজ্ঞের জন্য। চেঙ্গিস হালাকুরা তবু পরদেশের লোকজন হত্যা করত। কিন্তু এসব পাপাচারির দল নিজ দেশের মানুষ মারছে নির্বিচারে, নিজ দেশ ধ্বংস করছে অকাতরে।
রাষ্ট্রের সকল শসস্ত্র বাহিনীগু, সকল গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর এসব শাসকরা তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত বা শাসক পরিবারের বাহিনী এবং সেক্টরে পরিণত করে ফেলে । রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের জনগন রক্ষার চেয়ে শাসক পরিবারকে পাহারা দেয়াই তখন তাদের মূল দায়িত্ব হয়ে দাড়ায়।
শাসনকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য এসব দুরাচারী তাদের সকল প্রতিপক্ষকে নির্মমভাবে খতম করে ধীরে ধীরে। এদিকের মিল ছাড়াও তাদের মধ্যে আরো একটি মিল তাহল বিরোধীদের খতম, দমন এবং বিনাসের জন্য গুপ্ত হত্যা পরিচালনা।
কুশাসন, দুু:শাসন আর সুশাসন যাই বলেননা কেন দীর্ঘস্থায়ী শাসনের জন্য এ ধরনের নীতি যেসব শাসক অতীতে অবলম্বন করেছে এবং এখনো করছে তাদের সাথে বাংলাদেশের এখনকার শাসননীতির কোন মিল পাচ্ছেন কি? উপরে যে সামান্য কয়েকটি দিকের কথা তুলে ধরা হল তার সাথে একে একে মিলিয়ে দেখুনতো বাংলাদেশের এখনকার চিত্রের কোন মিল আছে কি-না? কোন মিল খুঁজে পানকি? যদি ভুলে গিয়ে থাকেন তাহলে গত ৫ বছরে প্রশাসনে পদোন্নতির চিত্র সংগ্রহ করে দেখুন কিভাবে সর্ব নিম্ন স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তরে নিজেদের লোক বসানো হয়েছে।
সেনাবাহিনী, বিজিবি পুলিশের সকল গুরুত্বপূর্ণ পদের দিকে খেয়াল করেন। অভ্যুত্থানের ঝুকি নেয়ার মত কোন জেনারেল বাংলাদেশে নেই বলে সজিব ওয়াজেদ জয় যে মন্তব্য স¤প্রতি করেছেন তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তার এ ঘোষনার মাধ্যমে জাতিকে তিনি নিশ্চিত করেছেন যে, এ বাহিনীর সকল গুরুত্বপূর্ণ পদে এখন তাদের প্রতি চূড়ান্ত অনুগত কর্মকর্তাদের বসানো হয়েছে এবং তারা কখনো তাদের কথার বাইরে যাবেনা এ মর্মে তারা নিশ্চিত হয়েছেন তারা। সে কারনেই তিনি এ ধরনের স্বস্তির ঘোষনা দিতে পারলেন।
বর্তমান বিএনপি জামায়াত হয়ত আশা করেছিল আওয়ামী লীগ সরকারের একেবারে শেষের দিকে তাদের শাসনের লৌহযবনিকা ঢিলা হয়ে যাবে, প্রশাসন, পুলিশসহ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার অন্যান্য গেটুগলোতে পাহারাদার হিসেবে যারা বসে আছে তারা আর শেষের দিকে হয়ত সরকারের প্রতি অতটা অনুগত থাকবেনা।
যেমন ১৯৯৬ এবং ২০০৬ সালে দুবারই বিএনপি সরকারের শেষের দিকে রাষ্ট্রযন্ত্র ঠিকমত কাজ করেনি তেমন বর্তমান সরকারেরও শেষ দিকে হয়ত সব ঢিলে হয়ে যাবে এবং সেই সুযোগে তারা আন্দোলন তীব্র করে সরকারকে দাবি আদায়ে বাধ্য করবে। খেয়াল করুন ১৯৯৬ সালে এবং ২০০৬ সালে বেগম খালেদা জিয়া সরকারের শেষের দিকে রাষ্ট্রযন্ত্র কিভাবে ঢিলা হয়ে গিয়েছিল। কিভাবে সব ঠায় দাড়িয়েছিল এবং কিভাবে চারদিকে নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারিদের একটি অংশ বিদ্রোহ করে জনতার মঞ্চ গড়ে তুলেছিল। ২৮ অক্টেবর পুলিশের চোখের সামনে কিভাবে মানুষ হত্যার পৈশাচিক উৎসব হয়েছিল।
পুলিশ সেদিন নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছিল বন্দুক এবং লাঠি হাতে। এর কারণ কি আপনারা খেয়াল করেছেন? এর একটি কারণ হতে পারে এখন যেমন ঠান্ডা মাথায় রাজপথে গুলি করে পুলিশ সরকার বিরোধী লোক হত্যা করে বিএনপি সরকার হয়ত তখন এ ধরনের অন্ধ আনুগত্যপরায়ন দলীয় ক্যাডারদের পুলিশ হিসেবে এভাবে এতমাত্রায় নিয়োগ দেয়নি এবং গুরুত্বপূর্ণ পদে এত মাত্রায় দলীয়করন, এলাকাকরন করেনি। । সরকারের প্রতি বিদ্রোহ কারর মত বিরোধী মনা কর্মকর্তাদেরও বিএনপি তখন রেখেছিল ফলে তারা জনতার মঞ্চ করেছিল। কিন্তু এখন কি রাষ্ট্রের কোন পদে এ ধরনের লোক আছে যারা সরকারের বিরুদ্ধে এ ধরনের পদক্ষেপ নেবে যেমন তারা নিয়েছিল বিএনপি সরকারের সময়? এমন একটি লোকও কোন পদে রাখেনি আওয়ামী লীগ সরকার।
বর্তমান সরকার শেষের দিকে স্বেচ্ছাচারের যে নজির সৃষ্টি করেছে এবং এখনো যেভাবে সরকার চলছে সে অবস্থায়ও পুলিশ ঠিক আগের মতই রাজপথে সরকার বিরোধী মিছিলকারীদের প্রতি গুলি ছুড়ছে, নির্বিচারে হত্যা করে চলেছে অত্যন্ত নির্মমভাবে। সরকারবিরোধী মিছিলে এভাবে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা, গ্রেফতার করে প্রকাশ্যে পিস্তল, বন্দুক ঠেকিয়ে হাতে, পায়ে গুলি করার নজির অতীতে হয়নি। এখনো পুলিশ সমান হিংস্রতা নিয়ে রাজপথে মিছিলকারিদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ছে। খোঁজ নিলে হয়ত দেখা যাবে একদিন এদের অনেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র নামধারী ক্যাডার হিসেবে বা সরকারের বিভিন্ন অঙ্গসঙ্গঠনের ক্যাডার হিসেবে অবৈধ অস্ত্র হাতে বিরোধী ছাত্র সংগঠন ও বিরোধী দলের লোকজনকে গুলি করে হত্যা করেছে, সন্ত্রাস চাঁদাবাজি করেছে তারাই আজ রাষ্ট্রীয় বন্দুক হাতে প্রতিপক্ষকে গুলি করে হত্যা করছে মহাআনন্দে। রাজপথে বন্দুক উচিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে মিছিলকারীদের ধাওয়া করতে পারে যারা, মিছিলকারীদের ধরে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করতে পারে যারা, ঠান্ডা মাথায় হাতে পায়ে গুলি করে পঙ্গু করতে পারে যারা এমন লোকদের দিয়ে যদি পুরো বাহিনী ভরে ফেলা যায় তাহলে বিরোধী দমনে এবং ক্ষমতায় টিকে থাকতে তেমন সমস্যা হয়না।
এদেরকে বলেও দিতে হয়না কখন কি করতে হয়। এরা নিজেরাই জানে তাদের কাজ কি।
গত ৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের যে শাসন নীতি তার প্রতি পদক্ষেপ থেকে এটি স্পষ্ট যে তারা দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকার পরিকল্পনা নিয়ে সবকিছু করেছে। এখনো ঠিক আগের মতই সরকারের প্রতি সকল সেক্টর থেকে নিরঙ্কুশ আনুগত্য তারই সাক্ষ্য বহন করছে।
তাছাড়া আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করিনা আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর মত লোক মাত্র তিন মাসের জন্য এরকম একটি বিতর্কিত সরকারের উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করবেন।
নিশ্চয়ই এ মর্মে তাকেসহ যারাই এ সরকারের পদপদবী গ্রহণ করেছে তাদের নিশ্চিত করা হয়েছে এ বিষয়ে। তা নাহলে এরশাদও মাত্র তিন মাসের জন্য এতবড় বেঈমান খেতাবের তিলক ধারন করবেন বলে বিশ্বাস করিনা। নিশ্চয়ই এর মাঝে মধু আছে। সে মর্মে তারা নিশ্চিত হয়েছে হয়ত। তারা মধুর গন্ধ পেয়েই এরকম ঝুকি নিয়েছেন।
সুতরাং আমি শঙ্কিত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।