আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মাইকে গুজব ছড়িয়ে কারখানায় আগুন

শ্রমিক নিহত হওয়ার গুজব ছড়িয়ে গাজীপুরের কোনাবাড়ী জরুন এলাকার স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের পোশাক কারখানায় তাণ্ডব চালিয়েছেন বহিরাগত শ্রমিকেরা। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছেন কারখানার নয়তলা ভবন, পণ্যবোঝাই ১৯টি কাভার্ড ভ্যানসহ কয়েক শ কোটি টাকার সম্পদ।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশের সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার রাত ১১টায় কারখানা ভবনে আগুন লাগিয়ে দেন স্ট্যান্ডার্ডের আশপাশের কয়েকটি সোয়েটার কারখানার শ্রমিকেরা। আগুন যাতে নেভানো না যায়, সে জন্য সড়কে গাছের গুঁড়ি ফেলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের আসতে বাধা দেওয়া হয়। পুলিশ এসে হামলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দিলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে।

টানা ১৬ ঘণ্টা চেষ্টার পর গতকাল শুক্রবার বেলা দেড়টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিসের ১৪টি ইউনিট।
তবে গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময়ও কারখানার ওপরতলার পেছন দিকের স্টোরে আগুন জ্বলতে দেখা যায়। আগে ছুটি হয়ে যাওয়ায় আগুনে হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
গাজীপুরের পুলিশ সুপার মো. আবদুল বাতেন প্রথম আলোকে বলেন, মাইকে শ্রমিক নিহত হওয়ার গুজব ছড়িয়ে দেওয়ায় শত শত শ্রমিক উত্তেজিত হয়ে কারখানায় আগুন ধরিয়ে দেন।
স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের জ্যেষ্ঠ মহাব্যবস্থাপক মো. নূর-ই আলম বলেন, পরিকল্পিতভাবে প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংস করতেই গুজব ছড়িয়ে শ্রমিকদের উসকানি দেওয়া হয়েছে।

এখন প্রতিষ্ঠানের ভবনের কঙ্কাল ছাড়া আর কিছুই নেই।
কিছুদিন ধরেই জরুন এলাকায় তিতাস সোয়েটার লিমিটেড, আসিফ সোয়েটার, বেসটন ও ওয়াইকে সোয়েটার কারখানার শ্রমিকেরা মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ করে আসছিলেন। আন্দোলনের নামে ১৯ নভেম্বর ওই শ্রমিকেরা কুদ্দুস নগর কাঁচাবাজারে আগুন দেন। এতে প্রায় ৬০টির মতো দোকান পুড়ে যায়। পরদিন একই এলাকার একটি কলোনির ৫০টি ঘর পুড়িয়ে দেন শ্রমিকেরা।


সোয়েটার কারখানার এই শ্রমিকেরাই গত বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে স্ট্যান্ডার্ড কারখানার শ্রমিকদের আন্দোলনে আসার আহ্বান জানান। কিন্তু কারখানার শ্রমিকেরা বের হয়ে না আসায় বহিরাগতরা ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। খবর পেয়ে গাজীপুর শিল্প পুলিশ তাদের ধাওয়া করে সরিয়ে দেয়।
কারখানার শ্রমিক ও নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাত সাড়ে নয়টায় কারখানার ছুটি হয়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পর বহিরাগত শ্রমিকেরা আবারও জোট বেঁধে স্ট্যান্ডার্ডের কারখানার দিকে আসতে থাকে।

কারখানার ভেতরে থাকা শিল্প পুলিশ শ্রমিকদের ধাওয়া করে। একপর্যায়ে তারা শ্রমিকদের লক্ষ্য করে কয়েকটি গুলিও ছোড়ে। এতে স্ট্যান্ডার্ড কারখানার অপারেটর রাশেদুল ইসলাম আহত হন। তাঁকে প্রথমে কারখানার চিকিৎসাকেন্দ্রে চিকিৎসা দেওয়া হয়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।


এরপর বহিরাগত শ্রমিকেরা স্ট্যান্ডার্ডের পাশের মসজিদের তালা ভেঙে মাইকে ঘোষণা দেয়, ‘পুলিশের গুলিতে দুজন শ্রমিক মারা গেছেন। শ্রমিক ভাইয়েরা সবাই এগিয়ে আসেন। ’ বেশ কয়েকবার এমন ঘোষণা দেওয়ার পর আশপাশের কয়েক শ শ্রমিক বের হয়ে আসেন। তাঁরা লাঠিসোঁটা নিয়ে কারখানার ২ নম্বর ফটক ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেন। শ্রমিকেরা সংখ্যায় বেশি হওয়ায় তখন আর শিল্প পুলিশ বাধা দেয়নি।

কারখানার নিরাপত্তাকর্মীরা বাধা দিতে গেলে তাঁদের মারধর করেন শ্রমিকেরা।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শুরুতেই কারখানার ১ নম্বর ভবনের সামনে থাকা পণ্যবোঝাই চারটি কাভার্ড ভ্যানে আগুন ধরিয়ে দেয় হামলাকারীরা। পরে আগুন দেয় ভবনটির নিচতলায়। এরপর পাশে থাকা আরও সাত-আটটি কাভার্ড ভ্যানে আগুন দেওয়ার পর কারখানা চত্বরের দক্ষিণ পাশের ১ নম্বর ভবনে আগুন লাগিয়ে দেন উচ্ছৃঙ্খল শ্রমিকেরা।

আগুনের খবর পেয়ে গাজীপুর ও কালিয়াকৈর ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট রাত সাড়ে ১২টায় কোনাবাড়ী এলাকা থেকে কারখানার রোডে যায়।

কিন্তু শ্রমিকেরা রাস্তায় গাছ ফেলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করায় আটকে যায় তারা। কোনাবাড়ী এলাকায় একটি পেট্রলপাম্পে অবস্থান নিয়ে অপেক্ষা করে ফায়ার সার্ভিস। পরে গাজীপুর থেকে অতিরিক্ত পুলিশ এলে তাদের সহযোগিতায় রাত দেড়টার দিকে দুটি ইউনিট আগুন নেভাতে শুরু করে। আগুনের ভয়াবহতা বাড়তে থাকায় ঢাকার সদর দপ্তর, গাজীপুর, কালিয়াকৈর, সাভার, ইপিজেডসহ আশপাশের ১৪টি ইউনিট প্রায় ১৫-১৬ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। কারখানার নিরাপত্তাকর্মী আবদুল গনি দাবি করেন, বহিরাগত শ্রমিকেরা এ ঘটনা ঘটিয়েছেন।

ঘটনার আগে কুদ্দুস নগর স্কুলের মাঠে হামলাকারীরা এক দফা বৈঠকও করে। তিনি বলেন, ‘আমাদের কারখানার শ্রমিকেরা এ ঘটনার সঙ্গে নেই। কারণ, বেতন-ভাতা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই এখানে। ’

কারখানার পাশের মসজিদের ইমাম মুফতি শাকুর আহাম্মেদ জানান, বেশ কিছু লোক মসজিদের তালা ভেঙে  ভেতরে ঢুকে শ্রমিক নিহত হওয়ার খবর প্রচার করে। তবে তিনি কাউকে চিনতে পারেননি।

দাঁড়িয়ে আছে কারখানার কঙ্কাল: গতকাল সকালে গিয়ে দেখা যায়, দাউ দাউ করে জ্বলছে কারখানার নয়তলা ভবন। ভবনের নিচতলার গুদামের সব কাপড় পুড়ে ছাই। ওপরের আটতলার কয়েক হাজার সেলাইমেশিন পুড়ে শেষ। বিশাল কারখানা চত্বরে কেবল ধ্বংসের চিহ্ন। হামলাকারীদের হাত থেকে চত্বরের গাছগুলোও রেহাই পায়নি।

১৯টি কাভার্ড ভ্যানের স েহামলাকারীরা।

স্ট্যান্ডার্ডের কর্মকতা ওয়ালিউল্লাহ শিপন বলেন, ভবনের প্রতিটি তলা ৭৫ হাজার বর্গফুটের। মেশিন ছিল প্রায় সাত হাজার। কাজ করেন ১২ হাজার শ্রমিক। কারখানা চত্বরের আরও দুই ভবনে কাজ করেন আরও ১০ হাজার শ্রমিক।

শিপন জানান, স্ট্যান্ডার্ড গ্যাপ, ঈগল, ইউনিক্লো, এঅ্যান্ডইসহ বিশ্বখ্যাত প্রায় ৩৫টি ব্র্যান্ডের কাজ করে।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক এ কে এম শাকিল নেওয়াজ বলেন, ‘ঘণ্টার পর ঘণ্টা আগুনে পুড়ে ভবনের ট্যাম্পার লস হয়েছে। বড় বড় স্ল্যাব ধসে পড়ছে। এ কারণে কারখানা ভবনটি এখন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। যেকোনো মুহূর্তে ধসে যেতে পারে।

অনিশ্চয়তার মুখে শ্রমিকেরা: আগুনে পুড়ে যাওয়ায় স্ট্যান্ডার্ডের ২২ হাজার শ্রমিকের জীবন অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে। কারখানার শ্রমিকদের বেতন গতকালই দেওয়ার কথা ছিল। কারখানার শ্রমিক আরিফ হোসেন বলেন, ‘মাস শেষ হওয়ার আগেই আমাদের বেতন দেওয়া হয়। কিন্তু এবার কী হবে জানি না। ’

আরেক শ্রমিক সোহেল রানা বলেন, ‘আমাদের কারখানার মালিক সব সময় আমাদের খোঁজ নিতেন।

সব সুযোগ-সুবিধা দিতেন। বেতন নিয়ে কখনো ঝামেলা হতো না। এবারও মালিক বলেছিলেন, মজুরি বোর্ড  ঘোষণা অনুযায়ী শ্রমিকদের বেতন দেবেন। ’ এখন কী করবেন জিজ্ঞেস করলে চোখে পানি চলে আসে সোহেলের। চোখ মুছতে মুছতে বলেন, ‘জানি না...।

গতকাল দুপুর থেকে দেখা যায়, অনেক শ্রমিক বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাসযোগে জিনিসপত্র নিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে যাচ্ছেন। কোথায় যাচ্ছেন জানতে চাইলে রঞ্জনা বেগম বললেন, ‘আগুনে কারখানা শেষ। কাজ নাই। তাই বাড়িতে চলে যাচ্ছি। ’

কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোশারফ হোসেনের মুঠোফোনে চেষ্টা করেও তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

মালিক ও শ্রমিক নেতারা যা বলছেন: পরিকল্পিতভাবেই একটি চক্র স্ট্যান্ডার্ড কারখানায় আগুন দিয়েছে বলে মন্তব্য করেন বিজিএমইএ সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ওই এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে সমস্যা হচ্ছিল। কয়েকটি শ্রমিক সংগঠন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে বলে অভিযোগ তাঁর।

শহিদুল্লাহ আজিম বলেন, আগুনে স্ট্যান্ডার্ডের প্রায় হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তা ছাড়া পণ্যবোঝাই সব কটি কাভার্ড ভ্যান বৃহস্পতিবার রাতেই চট্টগ্রাম বন্দরে যাওয়ার কথা ছিল।

বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক-কর্মচারী লিগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, জরুন এলাকায় তিন শ্রমিক সংগঠন এ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে। বেশ কিছু দিন ধরেই ভুঁইফোড় এই সংগঠনগুলোর নেতারা অনৈতিকভাবে শ্রমিকদের উসকে দিচ্ছেন।  

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.