আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পিছন পাগল

আমাদের পাড়ার পিছন পাগলের গল্পটা বলি।
ব্যাটা এমনিতে বেশ ভালো। সবার সাথে বিকেল বেলা আড্ডা দেয়, চা মুড়ি খায়, দেশের হাল হকিকত নিয়ে আলোচনা করে। খালি কেউ পিছন বললেই ক্ষেপে যায়। কারণটা আমরা ঠিক জানতাম না।

পাগলের নিজ নাম পছন্দ না বলে পিছন বললে ক্ষেপে যায় নাকি পিছন বললে ক্ষেপে যায় বলেই তার নাম পিছন পাগল এটা আমাদের কাছে ডিম-মুরগির মতো একটা ধাঁধা ছিল।
হেলাল একবার কচুয়া ধোলাই খেল পিছন পাগলের হাতে। হেলাল পাড়ায় নতুন, হাল হকিকত জানেনা। প্রথম পরিচয়য়েই সবার চা পুরির বিল দিয়ে দিল দেখেই আমরা বুঝে গেলাম উচ্চ বংশের ছেলে। গ্রুপে নিয়ে নিলাম।

কদিন পরে বোঝা গেল ছোকরা একটু ঘাউড়া স্বভাবের। সব কিছুতেই ঘাড় বেঁকিয়ে কিন্তু বলে তর্ক করতে লেগে যায়। বালেগ হবার পর থেকে আমরা সবাই একমত যে, পারুল আপা আমাদের পাড়ার সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে। হেলাল দেখে টেখে বলে, নাকটা একটু চাপা। সবাই প্রথমে কিছুদিন তর্ক করে হাল ছেড়ে দিলা।

দেখা গেল যে যাই বলে না কেন, শেষ কথাটা হেলালকেই বলতে হবে। আমরা তাই হেলালকে আদর করে জয়ী ডাকতাম। নামটা একটু মেয়েলী হলেও জয়ের গন্ধ আছে দেখে হেলাল খুশী মনে মেনে নিল। এই জয়ী হেলাল বিরাট পিটুনি খেল পিছন পাগলের হাতে। সবাই একসাথে বসে দিব্যি চা সিঙ্গারা খেয়ে খাচ্ছিলাম হারুনের হোটেলে।

পাগলও আমাদের সাথে এসে জুটেছে। দিব্যি খুশী মনে বদরুল ভাইয়ের সাথে সিরিয়ার সমস্যায় জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়ে আলাপ করে যাচ্ছিল। ওইদিকে বিল হেলাল দেবে এই আশায় সবাই পুরির পর পুরি সাবাড় করে যাচ্ছে। এই সময় ঘটল কাণ্ডটা। পিছন পাগল ডালপুরিতে কামড় দিয়ে আমোদে চোখ বন্ধ করে বলল, ডাইলপুরি দুনিয়ার সেরা খাদ্য।

হেলাল বলে, ডালপুরি ভালো কিন্তু আলুপুরি আরও ভালো। পাগল কটমট করে তাকাল, তারপর একটু ভেবে বলে তাও ঠিক। এরপরে আবার পিছন পাগল চায়ে ফুড়ুত করে একটা চুমুক দিয়ে বলে, চায়ের উপর দুনিয়াতে আর কিছু নাই। হেলাল ঘাড় বেঁকা করে কফির গুণগান করে। পাগল প্রথমে কটমট করে তাকালেও আর বেশী ঝামেলা করে না।

আচমকা মতিন হৈহৈ করে উঠে, পারুল আপা যায়। আমরা তাকিয়ে দেখি পারুল আপা দুলকি চালে যাচ্ছে হোটেলের সামনে দিয়ে। বেছে বেছে আমাদের আড্ডা দেয়ার সময়েই পারুল আপা সামনে দিয়ে কয়েকবার হেঁটে যেত। যেতে যতে আমাদের দিকে একটা 'যত্তসব বখাটে পোলাপান' টাইপ একটা চাহনি দিয়ে যেত। রনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, - পারুল আপা সামনে থেকে দেখতে দারুণ।

হেলাল তার স্বভাবমতো প্রতিবাদ করে বলে, পেছন থেকে তো আরও ভালো। আর যায় কোথায়। কেউ কিছু বোঝার আগেই পিছন পাগল হা রে রে রে করতে করতে হেলাল এর ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো। সবাই মিলে না থামালে সেদিন হেলালকে জানেই মেরে ফেলত। বদরুল ভাই মাথা নাড়তে নাড়তে আফসোসের সুরে বলেন, হেলাল, তোর কপাল ভালোরে।

কানের কাছ দিয়া গুলি গেছে। অল্পের উপর দিয়ে বাইচ্চা গেছোস। হেলাল হাউমাউ করে উঠে, আমি কি করছি? আমারে মারলো কেন? পারুল আপাকে নিয়ে কথা বলার জন্য মারলো? - নারে। সমস্যা পারুল না। সমস্যা হইতেছে বদরুল ভাই থেমে যান, শব্দটা আর উচ্চারণ করেন না।


হেলাল অল্পের উপর দিয়ে বেঁচে গেলেও রকিবুল ভাই বাঁচতে পারলেন না। রকিবুল ভাই আসার পর আমাদের মাথা বদরুল ভাই পোতায়ে গেলেন। এর আগ পর্যন্ত আড্ডার সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন বদরুল ভাই। রকিবুল ভাই এর জ্ঞানের তোড়ে বদরুল ভাই ভেসে গেলেন। শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, রাজনীতি, দেশ, বিদেশ সব বিসয়েই রকিবুল ভাইয়ের জ্ঞান আছে, কিছু না কিছু বলার আছে।

তিনি বলতেন আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনে যেতাম। বিজয় দিবসে বদরুল ভাই পাড়া থেকে একটা ছোটখাটো ম্যাগাজিন বের করতে চাইলেন। ম্যালা কাজ, স্পন্সর যোগার করা, লেখা যোগার করা, ছাপাখানায় দৌড়াদৌড়ি। রকিবুল ভাই বেশ পাত্তিওয়ালা লোক, জানাশুনাও ভালো। কিন্তু গাইগুই করতে লাগলেন।

বলেন, তোমরা ইয়াং ম্যান আরও বড় কিছু নিয়ে চিন্তা কর। আমরা বরং আরও কনস্ট্রাকটিভ কিছু করতে পারি। মনে কর পাড়ায় শীত বস্ত্র বিতরণ অথবা চাঁদা তুলে একটা কম্পিউটার ক্লাব করা। বদরুল ভাই একটু প্রতিবাদের চেষ্টা করলেন, - সে সব তো যে কোন সময়েই করা যায়। কিন্তু বিজয় দিবসে আমরা আসলে জোর দিয়ে আমাদের অবস্থানটা জানাতে চাই।

সব শুনে টুনে রকিবুল ভাই বললেন, - সবই বুঝলাম কিন্তু চল্লিশ বছরের পুরনো একটা গণ্ডগোল নিয়ে যেভাবে রাজনীতি হচ্ছে দেশে সেটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে আর কত ভালো লাগে বল। আমাদের আসলে পিছনের কথা ভুলে সামনে এগিয়ে যাওয়া উচিৎ।
পিছন পাগল পিছন শুনেই বসা থেকে তিড়িং করে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়লো রকিবুল ভাইয়ের উপর। প্রথমে ধরে কিছুক্ষণ আঁচরে খামচে দিল। তারপর তাকে মাটিতে ফেলে উপুড় করলো।

হেলাল এর ঘটনার সময় আমরা সবাই মিলে পিছন পাগলকে আটকিয়েছিলাম। এবারে কেন যেন কেউ এগিয়ে আসলো না। মতিন একটু মৃদু প্রতিবাদ করলো, কাজটা ভালো হচ্ছে না কিন্তু। পিছন পাগল ততক্ষণে রকিবুল ভাইয়ের প্যান্ট খুলে ফেলেছে। রনি মৃদু গলায় বলে, - অত্যন্ত বাজে একটা ব্যাপার হচ্ছে।

আমি এর আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানাই। বদরুল ভাই চায়ে একটা হালকা চুমুক দিয়ে বলেন, - বেশী ব্যথা দেইস না কিন্তু পাগলা।
আধা ঘণ্টা পার হয়। রকিবুল ভাই কষ্টে সৃষ্টে উঠে রক্তাক্ত পশ্চাৎদেশ নিয়ে কোনরকমে উঠে দাঁড়ান। পিছন পাগল চোখ মটকে বলে, আর কখনো পিছনের কথা ভুলবি? বদরুল ভাই, মাথা নেড়ে আফসোসের সুরে বলেন, আসলেই পিছন পাগল কাউকে পিছনের কথা ভুলতে দেয় না।

এর পর কতকত বছর কেটে গেল। রকিবুল ভাই জীবনে অনেক এগিয়ে গিয়েছেন কিন্তু পিছনের কথা ভুলেন নাই। জীবনের প্রতিমুহূর্তে উঠা থেকে বসতে, বসা থেকে শুতে, শোয়া থেকে উঠতে, উপুড় থেকে চিত হতে, চিত থেকে কাত হতে একবার করে আহা উঁহু করে আর্তনাদ করে পিছনের কথা মনে করেছেন।

সোর্স: http://www.sachalayatan.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।