অবরোধে বিপর্যস্ত দেশের অর্থনীতি। ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে নেমেছে ধস। চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা অর্থনীতির বুকে পেরেক ঠুকে দিয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, অসুস্থ রাজনীতির জাঁতাকলে তাদের বুকে চলছে রক্তক্ষরণ! একদিকে ব্যাংকগুলো টাকা নিয়ে বসে আছে, ঋণ নেওয়ার লোক নেই। অবরোধের কারণে বন্দরে বন্দরে আটকে আছে আমদানি পণ্য ও কাঁচামাল। একই কারণে রপ্তানি খাতেও নেমেছে ধস। নিরাপদে পণ্য পাঠাতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। সময়মতো পণ্য বুঝিয়ে দিতে না পারায় কার্যাদেশ বাতিল করছেন ক্রেতারা। অন্যদিকে প্রয়োজনীয় কাঁচামালের অভাবে ঘুরছে না কল-কারখানার চাকা। ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। ব্যাংক ঋণের সুদ বাড়তে থাকায় শিল্পোদ্যোক্তাদের মাথায় হাত। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পড়েছেন আরও বেশি সমস্যায়। আগুন ও সহিংসতার আশঙ্কায় ফুটপাতে বসতে পারছেন না দোকানিরা। বন্ধ থাকছে মার্কেট। লোকজনের আনাগোনা কম থাকায় বেচাকেনা কমে গেছে দোকানপাটের। এটিই এখন ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রকৃত চিত্র।
হুমকির মুখে তৈরি পোশাক খাত : রাজনৈতিক অস্থিরতায় তৈরি পোশাক খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে বলে দাবি করেছেন তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি, রাজনৈতিক অচলাবস্থা অব্যাহত থাকায় সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পোশাক খাতে কেবল পণ্য সরবরাহে ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল ইসলাম, বিকেএমইএ সভাপতি সেলিম ওসমান এবং বিটিএমএ সভাপতি জাহাঙ্গীর আলামিন এমন দাবি করেন। চিঠিতে তারা জানান, চলমান পরিস্থিতিতে পোশাক খাতে উৎপাদন ১০ শতাংশ কমে গেছে। অক্টোবরে পোশাক খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ২ শতাংশ। এঙ্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, হরতাল-অবরোধজনিত রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলেও ক্রেতারা তা মানতে চাচ্ছেন না। তারা চাচ্ছেন সময়মতো পণ্য সরবরাহ। ফলে জাহাজের পরিবর্তে বিশেষ নিরাপত্তা দিয়ে কার্গো বিমানে (এয়ারফ্রেইট) পণ্য পাঠাতে হচ্ছে। এতে দ্বিগুণেরও বেশি ব্যয় হচ্ছে। প্রয়োজনীয় কাঁচামালের অভাবে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। রপ্তানিমুখী পোশাক খাতের জন্য রাজনৈতিক অচলাবস্থা বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। এদিকে, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে মন্দা পরিস্থিতির কারণে ব্যাংকে জমছে অলস টাকার পাহাড়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় অলস টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮২ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা। এক বছর আগে ছিল ৪০ হাজার কোটি টাকার নিচে। ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিনিয়োগ না হওয়ায় অলস টাকা বাড়ছে। ব্যাংকগুলোর মুনাফায় ধস নেমেছে। অন্যদিকে, ১৮ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে নতুন করে বিনিয়োগ করতে চাচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০১১-১২ অর্থবছর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৬ দশমিক ৭৯ শতাংশ। গত অর্থবছরের জুন শেষে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৯৭ শতাংশ। ব্যাংকারদের সংগঠন এবিবির সভাপতি, এনসিসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল আমীন বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বিনিয়োগকারীদের মনে আস্থার সংকট বাড়ছে। কেউ ঋণ নিচ্ছেন না। ঋণ উত্তোলনও করা যাচ্ছে না। ফলে মুনাফা কমে যাবে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
ঘুরছে না বিনিয়োগের চাকা : অব্যাহত গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের সঙ্গে এবার নতুন করে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। এর ফলে বিনিয়োগ পরিস্থিতিতে স্থবিরতা নেমে এসেছে। নিরাপত্তাহীতার কারণে অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী ফিরেও যাচ্ছেন। দেশীয় বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি নিয়ে কোনো বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। বিনিয়োগ বোর্ডের তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধিত হয়েছে ২৫৭টি। ২০১২-১৩ অর্থবছরে বিনিয়োগ বোর্ডে ১ হাজার ৪৫৭টি স্থানীয় বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধিত হয়েছে। এর আগের অর্থবছরে নিবন্ধিত বিনিয়োগ প্রস্তাবের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৭৩৫টি। এদিকে প্রচুর পরিমাণ রেমিট্যান্স এলেও তা ভোগবিলাসে ব্যয় হচ্ছে, যার ফলে বাজারে নগদ টাকার প্রবাহ বেড়ে যাচ্ছে। এটি মূল্যস্ফীতির ঊধর্্বগতিকে উসকে দিচ্ছে। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির পরিমাণ কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। ফলে শিল্পোৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১০-১১ অর্থবছরে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে ২৩৩ কোটি ডলারের, ২০১১-১২ অর্থবছরে কমে দাঁড়িয়েছে ২০০ কোটি ডলারে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ১৮৩ কোটি ডলারে। চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাসে নেমে এসেছে ১০০ কোটি ডলারেরও নিচে। আমদানি কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতির জন্য রাজনৈতিক অস্থিরতাকে দায়ী করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, পুঁজির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আসবেন না। এ ছাড়া অনিশ্চয়তা বিরাজ করায় কেউই বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। এদিকে, গ্রামের হাটগুলো ঠিকভাবে বসতে না পারায় ধান কিনতে পারছে না মিলগুলো। ঘুরছে না চাল কলের চাকা। উত্তরবঙ্গের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ বন্ধ থাকায় কৃষিসহ নিত্যপণ্যের সরবরাহ লাইনে সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা জানান, তারা শুধু সপ্তাহে এক দিন (শুক্রবার) পণ্য পরিবহনের সুযোগ পাচ্ছেন। ফলে চাল, ডালসহ প্রয়োজনীয় পণ্যের সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। সরবরাহ সংকটের কারণে ভোক্তাকে বেশি দামে পণ্য কিনতে হলেও কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম পাচ্ছে না কৃষকরা।
উত্তরবঙ্গ থেকে বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি লায়েক আলী জানান, তাদের প্রায় ১৭ হাজার চাল কল আছে।
প্রয়োজনীয় ধান কিনতে না পারায় অর্ধেকই বন্ধ রয়েছে। অর্ধেক খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। মেশিন বন্ধ থাকলেও শ্রমিকদের বেতন ও ঋণের সুদ গুনতে হচ্ছে। এ অবস্থায় ব্যবসায়ীরা এখন জীবিত লাশ হয়ে গেছেন। বন্ধের পথে ক্ষুদ্র ব্যবসা : হরতাল-অবরোধে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অবস্থাও শোচনীয় বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি, অবরোধে দোকানপাট খোলা থাকলেও সহিংসতার আশঙ্কায় ক্রেতারা বাইরে বেরোচ্ছেন না। ফলে বিক্রিও কমে গেছে। রাজধানীর যেসব এলাকায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড_ মিছিল-সভা-সমাবেশ বেশি হয়, সেসব এলাকার ব্যবসায়ীরা প্রায় নিঃস্ব হতে বসেছেন। মাসের পর মাস দোকান বন্ধ রেখে পুঁজি হারাতে চলেছেন। অভিজাত বিপণিবিতান, রেস্টুরেন্ট, শপিং মলের অবস্থা করুণ। বিক্রি নেই, ঋণের চড়া সুদের হার। দোকান বন্ধ থাকলেও ভাড়া, গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল, কর্মচারীর বেতন দিতে হচ্ছে। বৃহত্তম পাইকারি বাজার মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ীরা উত্তরবঙ্গ ও চট্টগ্রাম থেকে পণ্য আনতে না পেরে ব্যবসা করতে পারছেন না। মোহাম্মদপুরে চামড়াজাত পণ্য তৈরি করেন এমন প্রায় ২ হাজার দোকানে বিক্রি নেই বললেই চলে। পুরনো গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরি ও মেরামতের কাজে নিয়োজিত ধোলাইখালের দোকানগুলোয় কাজের অভাবে শ্রমিকদের বসে বসে আড্ডা দিতে দেখা গেছে। ইসলামপুরের কাপড়ের দোকানিরা বলেন, বিক্রি কমে যাওয়ায় খেয়ে-পরে জীবিকা নির্বাহ করা নিয়েই সংশয় দেখা দিয়েছে। বঙ্গবাজার হকার্স মার্কেটের ব্যবসায়ীরা জানান, নভেম্বর-ডিসেম্বরে মফস্বল থেকে ব্যবসায়ীরা গাড়ি বোঝাই করে শীতের পোশাক নিয়ে যান। এবার তাদের দেখা নেই। ইসলামপুরে ছোট ৪ হাজারের মতো কাপড়ের পাইকারি দোকান আছে। সেখানকার ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার ব্যবসা হয়। হরতাল-অবরোধের কারণে অর্ধেকে নেমে এসেছে। বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা আসতে না পারায় বিক্রি বন্ধের পথে। ঢাকা মহানগর দোকান মালিক সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি রেজাউল ইসলাম মন্টু জানান, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সারা দেশে তাদের প্রায় ২৩ লাখ দোকানে প্রতিদিন গড়ে ৬০০ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি হতো। এটি এখন এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে। মানুষ বেশি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বেরোচ্ছে না। অস্থিরতা অব্যাহত থাকলে পুরো অর্থনীতি ধসে পড়বে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের বুকে এখন রক্তক্ষরণ চলছে! রাজনীতিবিদরা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এই রক্ত বের করছেন!
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।