আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কার পাপের এই শাস্তি?

আজ ২৪ ডিসেম্বর আমাদের প্রিয় দল কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। আজ থেকে ১৪ বছর আগে আমরা কিছু মুক্তচিন্তার মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধা দেশের কথা, মানুষের কথা বলতে, স্বাধীনভাবে চলতে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ নামে একটি দল গঠন করেছিলাম। অনেক ঝড়-ঝাপটা, অনেক অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে এখনো টিকে আছি। দলটির জন্মক্ষণে আমাদের সাহস দিয়েছিলেন, শক্তি জুগিয়েছিলেন প্রবীণ নাগরিক অন্যতম সংবিধান প্রণেতা, বিশিষ্ট আইনবিদ ড. কামাল হোসেন ও বর্ষীয়ান ভাষাসৈনিক আবদুুল মতিন। এই শুভক্ষণে দলের পক্ষ থেকে আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

আপামর দেশবাসীকে জানাচ্ছি সশ্রদ্ধ সালাম। আর প্রার্থনা করছি, তাদের নিখাদ শুভ কামনা। আজ যারা কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রেসক্লাবে শরিক হবেন তাদেরও অগ্রিম অভিনন্দন জানাই।

আমরা একটা কঠিন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। বাংলাদেশের নির্বাচনী সময়টা থাকে উৎসবমুখর।

পান-বিড়ি-চায়ের দোকান থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে থাকে একটা সাজ সাজ রব। আমরা পহেলা বৈশাখ যেভাবে পালন করি, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দুর্গাপূজা, মুসলমানের ঈদের মতো আনন্দঘন পরিবেশে আমাদের দেশে নির্বাচন হয়। এবার জননেত্রী শেখ হাসিনার অভিনব ডিজিটাল নির্বাচন এক মারাত্দক বিষাদে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীতে এমন কলঙ্কিত নির্বাচনী প্রচেষ্টা এর আগে কখনো কেউ দেখেনি। এমন ত্রুটিপূর্ণ পাতানো নির্বাচনী মহড়া আর কখনো কোথাও হয়নি।

মানুষ সবকিছু থেকেই কিছু না কিছু শেখে; কিন্তু এমন নিম্নমানের পাতানো নির্বাচন থেকে কেউ ভালো কিছু শিখতে পারবে না। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একই জোটের মানুষ, সর্বদলীয় সরকারে যোগদানের আগে এক মুহূর্তের জন্যও জোট ছাড়েননি। তাকে নিয়েও ভোটাভুটি নয়, এক মহাভাগাভাগি। যে নেতারা নির্বাচনে কোনো দিন জামানত ফিরে পাবেন না, তাদের দলকে তিন-চারটা করে ভাগ দেওয়া হয়েছে। জননেত্রীর বয়ান অর্জুন কিংবা লক্ষ্মণের বাণের চেয়েও তীব্র ধারালো।

বীরত্ব দেখাতে গিয়ে বলেছেন, প্রধান বিরোধী দলও যদি সর্বদলীয় সরকারে আসত তাদেরও আমরা সিটের ভাগ দিতাম। ভাবখানা এমন যেন, কোরবানির গরু। নিজের জন্য এক অংশ, আত্দীয়স্বজনের জন্য আরেক অংশ, প্রতিবেশীদের জন্য এক অংশ। যারা বলেন তারাও লজ্জা পান না। আমাদেরও যেন কোনো উপায় নেই।

দেশটা যে কোরবানির গরু নয়, আর কেউ দেশের মালিক নয়_ এটাও আমরা বুঝতে চাই না। সারা পৃথিবী একদিকে, জননেত্রী একাই একদিকে। দেশের অর্থনীতি যে একেবারে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, নেতানেত্রীরা এটা বুঝতে পারছেন কিনা, নাকি ইচ্ছা করেই এসব করছেন? তা নিয়েও এক সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে মাঝে-মধ্যে এটা সেটা দেখি। কখনো-সখনো অবাস্তব কিছু বিজ্ঞাপন দেখে শিউরে উঠি।

কোনো কোনো সময় কত দুধে কত পানি মেশানো যায় এ রকম বিজ্ঞাপন দেখে অবাক বিস্মিত হই, ক্ষুব্ধ হই। এই সেদিন কী এক কোম্পানির মোটরসাইকেলের তেজ দেখাতে এক যুবকের পেছনে যুবতী। জিপ নিয়ে তাদের ধাওয়া করা হলো। গাড়ি থেকে কত গুলি করা হলো একটাও লাগল না। শেষে আকাশে জেট ফাইটার।

যুবক-যুবতীর মোটরসাইকেলের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় রিভলবার না পিস্তল নিয়ে যুবতী গুলি ছুড়ল আর মিগ ভেঙে খানখান হয়ে আছড়ে পড়ল। কী মারাত্দক সফলতা! এত বড় একটা মুক্তিযুদ্ধ করলাম, সব সময় গুলিভর্তি রিভলবার থাকত কোমরে। একদিনের জন্যও সেটাকে যুদ্ধাস্ত্র মনে হলো না। অস্ত্রটি কোমরে থাকত শত্রুর হাতে ধরা পড়লে তারা যাতে জীবিত না পায়। পিস্তল, রিভলবার, রাইফেল, স্টেনগান যুদ্ধে কোনো যুদ্ধাস্ত্র নয়।

যুদ্ধের ময়দানে ওসব কোনো কাজে আসে না। এফ সিঙ্টিনের কথা ছেড়েই দিলাম, মিগ টুয়েন্টিওয়ান থেকে মিগ টুয়েন্টিনাইন যা আমাদের দেশে আছে। কোনো ভালো প্রতিষ্ঠানের মোটরসাইকেল তো দূরের কথা, জার্মানের তৈরি কোনো মোটরকারের দু-একশ গজের মধ্য দিয়ে উড়ে গেলে বাতাসের আঘাতে সেটা কাগজের মতো ছিঁড়ে বাল্লা বাল্লা হয়ে যাবে। কোনো মহিলার মাথার ওপর দিয়ে মিগ উড়ে গেলে পেটে বাচ্চা থাকলে তা রাখা মুশকিল। আর টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে, এক যুবতী রিভলবার পিস্তলের গুলিতে জেট ফেলে দিচ্ছে।

গাজার নৌকা আর কত পাহাড় দিয়ে যাবে? বিজ্ঞাপনদাতারা ভেবেও দেখে না মিগের গতি মেশিনগানের বুলেটের চেয়েও বেশি। রিভলবার পিস্তলের গতি তো নস্যি। ঠিক এরকমই হয়েছে আমাদের এবারের জাতীয় নির্বাচন। অর্ধেকের বেশি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, বাকি অংশ কোথাও স্বতন্ত্র আবার কোথাও বিদ্রোহী। তাদের জন্য আবার ৫ জানুয়ারি নির্বাচন।

ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার সব সুব্যবস্থা নির্বাচন কমিশন করবে। শিল্পী কামরুল হাসান জনাব এরশাদকে বিশ্ব বেহায়া বলে দেহত্যাগ করেছিলেন। এ নির্বাচন কমিশনকে বিশ্বে কী বলা হবে ভেবে পাই না। ব্রিটিশ ভারতে ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিপ্লবের পর বিপ্লবীদের গাছে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। আগামী দিনে মানুষ এদেরকে যে কি করবে সে শুধু আল্লাহই জানেন।

এরপরও নির্বাচনী বাহানা শুনলেই কেমন লাগে। নির্বাচন কমিশন দুই সপ্তাহের জন্য সেনাবাহিনী নামাবে। জাতীয় সম্পদ সেনাবাহিনী, কেন তাদের নামাতে হবে? তারা কেন এই অবৈধ বিকলাঙ্গ নির্বাচনের বদনামের ভাগি হতে যাবে? মানুষের রক্ত-ঘামে অর্জিত অর্থ এভাবে অপব্যয় করার অধিকার নির্বাচন কমিশনকে কে দিয়েছে? দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন তামাশা এবং অর্থহীন হয়ে পড়েছে। এ ব্যাপার এখন ক্ষান্ত দেওয়াই ভালো। বিয়ের আগে বাচ্চা হলে যেমন বিশ্রী অবস্থা হয়, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন তার চেয়ে খারাপ হয়েছে।

নির্বাচন শেষ হওয়ার আগেই একাদশ জাতীয় সংসদের কথা উঠেছে, তারপর আর এসব করার কোনো মানে হয়? এ ব্যাপারে এখন সরকারি অর্থের এক পয়সা খরচ করাও চরম দুর্নীতির শামিল এবং ফৌজদারি অপরাধ। এ জন্য অবশ্যই এর পরেও যারা ১০ টাকাও খরচ করবেন তাদের জবাব দিতে হবে। তাই এ নির্বাচন ত্যাগ করুন। আসুন সবাই বসে আলোচনা করে অবাধ সুষ্ঠু একটি নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করি। নির্বাচন নির্বাচন বলে এখন আর লাভ নেই।

সারা পৃথিবী এই নির্বাচনকে প্রহসন ছাড়া আর কিছু বলবে না। নির্বাচনী কলঙ্কের যে তিলক আওয়ামী লীগের কপালে জুটেছে তা ঝামা দিয়ে ঘষেও আর মুছবে না। অর্থমন্ত্রী জনাব আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য নয়। দেশে-বিদেশে কারও কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। এটা একেবারেই ভোট ছাড়া নির্বাচন।

নেত্রীও নাকি এটা চান না। তাহলে এমন চুরিচামারি কে চান? তাকে তো তালাশ করা দরকার। এমন কুকর্মের হোতাকে বাঙালিদের চিনে রাখা উচিত। ঠিক সময় এ রকম দুষ্কর্মের হোতাকে চিনে রাখতে না পারলে পরে আরও অসুবিধা হবে। তাই সময় থাকতে এমন দুষ্ট লোক আগেভাগেই চিহ্নিত করা উচিত।

সেদিন খামারবাড়ি কৃষিবিদদের এক অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তাদের কাছে খবর ছিল বিএনপি নির্বাচনে আসবে, তাই মহাজোট সিট ভাগাভাগি করেছে। রাজনৈতিকভাবে তার এ কথা ঠিক। মহাজোট হিসেবে তারা নিশ্চয়ই সিট ভাগাভাগি করতে পারেন। কিন্তু নির্বাচন ভাগাভাগি করতে পারেন না। দেশবাসী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কোন কথা বিশ্বাস করবে? এর আগে বলেছিলেন, বিএনপি সর্বদলীয় সরকারে এলে তাকেও ভাগাভাগির অংশ দিতাম।

এ তো দেখছি গরু মেরে জুতা দানের মতো। যিনি উঠতে-বসতে বলেন দেশবাসীর ভোটের, ভাতের অধিকার রক্ত দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি এভাবে দেশবাসীকে ভোট থেকে বঞ্চিত করলেন? তার জন্য এত মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে, অর্থনীতি ভেঙে চুরমার খানখান হয়ে যাচ্ছে। এসবের জবাব কি তার কাছে পাওয়া যাবে? আসলে তিনি কি কিছুই বোঝেন না, নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করেন? খালি মাঠে গোল দেওয়া কি দর্শকরা খুব একটা ভালোভাবে নেয় বা দেখে? তথাকথিত মহাজোটের সঙ্গে কেউ খেলতে চাচ্ছে না_ এতে দোষ কার? মহাজোটের নাকি যারা খেলছে না তাদের? এ নিয়ে তো অবশ্যই বিশ্লেষণ করা দরকার। খালি মাঠে যত গণ্ডায় গণ্ডায় গোল দিন ম্যারাডোনা হতে পারবেন না।

আর নির্বাচনে অংশ না নিতে পেরে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি হাউমাউ করে কাঁদতে যাবে কেন? তাদের কি সমস্যা? সারা দুনিয়ার কাছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অপমানিত হলে প্রধান বিরোধী দলের ক্ষতি কোথায়? যতকাল পৃথিবী থাকবে এই প্রার্থী ছাড়া নির্বাচনের রেকর্ড থাকবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তো নিন্দিত হলেনই, যেসব বর্ষীয়ান নেতার এখন কিছুই করার নেই, ওইসব খামখেয়ালি নিন্দার তালিকায় তাদের নামও প্রথমদিকেই থাকবে। নিজেরাই যেখানে বলছেন, দশম জাতীয় নির্বাচন দেশে-বিদেশে কোনো গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। কোনো ভোট হয়নি। তখন অন্যদের বুঝাবেন কী করে? এ রকম গাওজুরি পৃথিবী আগে কখনো দেখেনি।

চাপার জোরেরও একটা সীমা থাকে, এখানে সেসব সীমাকে পার করে কেমন একটা অসহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। দিনের পর দিন রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে আছে। সম্পদ জ্বলছে, পুড়ছে, মানুষ খুন হচ্ছে তারপরও সরকার বলছে সব ঠিক আছে। এই তো সেদিন একঘরে ছয়জন খুন হয়েছে। প্রশাসন কিছুই জানে না।

উঠন্ত বয়সী মেয়ে বাবা-মাকে একসঙ্গে খুন করেছে, সাংবাদিক সাগর-রুনি নিজের ঘরে নিরাপদে ঘুমাতে পারেননি_ এমন ব্যর্থ প্রশাসন আগে কেউ দেখেছে বলে মনে হয় না। যে কোনো মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রীর পরেই অর্থমন্ত্রীর জ্যেষ্ঠতা, সেই অর্থমন্ত্রীর ঘরে দেশের মালিক পাগল ঢুকে পড়তে পারে নির্বিবাদে। দেশের সচিবালয়েরই যদি এরকম নিরাপত্তা, তাহলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কেমন তা তো সহজেই অনুমেয়। এক সময়ের এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি, তারও আগে যখন পুঁটি মাছের ভাগার মতো টেলিভিশন চ্যানেল ছিল না, তখন টেলিভিশন উপস্থাপক বর্তমান গার্মেন্ট ব্যবসায়ী আনিসুল হকের বাংলাদেশ প্রতিদিনে 'কোথায় যাচ্ছি আমরা' শিরোনামে এক অসাধারণ লেখা আমাকে বেশ নাড়া দিয়েছে। এ তো শুধু আনিসুল হকের আকুতি নয়, সার্বিকভাবে প্রায় সবার একই কথা, একই কান্না।

কেউ সাজিয়ে-গুছিয়ে কাঁদতে পারে, আবার কেউ পারে না। কিন্তু সবার কান্নাই এক। যা বুকের ভেতর গুমরে মরছে, মুক্তির দুয়ার খুঁজে পাচ্ছে না। তাই পিঞ্জিরাবদ্ধ কষ্টগুলো নিয়ে মানুষ বড় ম্রিয়মাণ হয়ে আছে। কষ্টের ভারে তারা আর চলতে পারছেন না।

কে বা কারা তাদের ভারমুক্ত করবে, তাদের বুকের জ্বালা শান্ত করে বাঁচার একটা পথ দেখাবে_ সেই প্রত্যাশায় দেশবাসী দিন গুনছে। জীবনের কড়কড়ে বাস্তব থেকে শেখা গুমট কখনো চিরস্থায়ী নয়, একেবারে ক্ষণস্থায়ী। তাই আশায় বুক বেঁধে আছি_ এ কুয়াশা কাটবেই কাটবে। হাহাকার আর কতক্ষণ? কয়েক ঘণ্টা বা কয়েক দিন।

লেখক : রাজনীতিক।

 

 


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।