বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...
বাংলাদেশে যে কোনো ধরনের নির্বাচন ও রাজনৈতিক টানাপোড়নের প্রথম শিকার হন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। এর কারণ কি? সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বাংলাদেশের রাজনীতির একটি অন্যতম হাতিয়ার। এটি সবচেয়ে বড় কারণ। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো হীনস্বার্থ উদ্ধারের জন্য, সংখ্যালঘুদের সহায় সম্পত্তি লুটপাট ও ভোগ-দখল করার জন্য, সংখ্যালঘুদের দেশ ছাড়া করার জন্য, বিভিন্ন রাজনৈতিক অযুহাতে সংখ্যালঘুদের উপর বিভিন্ন সময়ে নির্মম নির্যাতন, অত্যাচার, খুন, ধর্ষন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ সহ অনেক মানবতা বিরোধী কাজ করে থাকে। এটা এতোটাই নির্মম, পাশবিক, হৃদয় বিদারক ও মর্মস্পর্শী যে, তখন আর কিছুতেই মানুষ হিসেবে দাবী করা যায় না যে, বাংলাদেশ একটি ধর্ম নিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র।
বরং ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, বাংলাদেশ একটি বর্বর, অসভ্য, সাম্প্রদায়িক, অশিক্ষিত মুসলিম রাষ্ট্র, যেখানে প্রতিটি রাজনৈতিক টানাপোড়নে বিশেষ করে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সব সময়ই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা একটি অভ্যাসের মত ঘটনা। এই ঘটনা বারবার ঘটার পেছনে রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সরাসরি ইন্ধন থাকে। পাশাপাশি রাষ্ট্রের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার বদলে এক ধরেনর রহস্যময় শীতলতাও একটি বড় কারণ।
এটা এখন ২০১৪ সালে এসেও যখন চোখের সামনে ঘটতে দেখি, তখন বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে, একজন মুসলিম ঘরের সন্তান হিসেবে, একজন শিক্ষিত ব্যক্তি হিসেবে এবং একজন রাজনৈতিক সচেতন বোদ্ধা হিসেবে আমার বারবার বলতে ইচ্ছে করে, আমি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব চাই না। হে মাননীয় সরকার মহোদয়, তোমরা দয়া করে আমাকে বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডের বাইরে কোথাও নির্বাসনে পাঠাও।
আমি এসব সহ্য করতে পারি না। মানুষের জন্য মানুষ সৃষ্ট এমন দুর্যোগ, মানুষের জন্য মানুষ সৃষ্ট এমন দুর্ভোগ, মানুষের জন্য মানুষ সৃষ্ট এমন রাজনৈতিক নির্যাতন, মানুষ সৃষ্ট এমন মানবতা বিরোধী অপরাধ, এটা কেবল পৃথিবীর অসভ্য, বর্বর, অশিক্ষিত, সাম্প্রদায়িক দেশেই শোভা পায়। আর এই একই ঘটনা যখন বারবার বাংলাদেশে ঘটছে, সবার চোখের সামনে ঘটছে, প্রকাশ্য দিবালোকে ঘটছে, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অনুপস্থিতি ও উপস্থিতিতে ঘটছে, রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সরাসরি ইসারায় ঘটছে, সম্পত্তি, বাড়িঘর, বাগান ও জমি দখলের চক্রান্তে ঘটছে, তখন একথাই গভীরভাবে সুস্পষ্ট যে, বাংলাদেশকে কোনোভাবেই একটি অসাম্প্রদায়িক, ধর্ম নিরপেক্ষ, শিক্ষিত, সভ্য রাষ্ট্র বলার বা দাবী করার কোনো সুস্পষ্ট লক্ষণ নেই।
৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালে বাংলাদেশে দশম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচন কেমন হয়েছে তা গোটা বিশ্ব এখন ভালো করেই জানে।
কিন্তু নির্বাচনের আগে ও নির্বাচন পরবর্তী সময়ে খুবই পরিকল্পিতভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা হয়েছে। একথা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের দিনেই যশোরের অভয়নগরে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলা হয়েছে। পরদিন ৬ জানুয়ারি ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, রংপুর, রাজশাহী, লালমনিরহাট, বগুড়া, যশোর ও চট্টগ্রামের নানা জায়গায় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলা হয়েছে। তাদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট হয়েছে।
অগ্নি সংযোগ হয়েছে। তাদের নারী-পুরুষ-শিশুদের উপর নির্যাতন হয়েছে। তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হুমকি দেওয়া হয়েছে। তারা অনেকে এখন মন্দির বা প্রতিবেশী মুসলিমদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। অনেক বয়স্ক হিন্দু নারী এমন অভিযোগও করেছেন যে, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক পুলিশ সদস্যকে তারা ফোন করেও ঘটনার সময় পাশে পায়নি।
অসহায়ের মত কেবল জীবন বাঁচাতে তারা সহায় সম্পত্তি, বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, জমি, বাগান ফেলে কেবল আশ্রয় নিয়েছে। অনেকেই এই তীব্র শৈত্যপ্রবাহের মধ্যে কেবল পড়নের কাপড় নিয়ে পালাতে পেরে খোলা আকাশের নিচে জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছে।
বাংলাদেশের সরকার নির্বাচনকালীন সময়ে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিশেষ করে দেশের হিন্দু সম্প্রদায়কে নিরাপত্তা দিতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। দেশের গণমাধ্যমে এসব খবর তেমন একটা প্রচারও পায়নি। অনেক সংবাদ মাধ্যম এই মানবতা বিরোধী খবরের চেয়ে বরং বিতর্কিত নির্বাচনী খবর প্রচারেই বেশি মনযোগী রয়েছে।
আইন শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী ঘটনা ঘটে যাবার পর কোথাও কোথাও উপস্থিত হবার খবর পাওয়া যায়। কোনো রাজনৈতিক দল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিরাপত্তা দিতে এগিয়ে আসেনি। দেশের তথাকথিত সুশীল সমাজ এই নারকীয় নির্যাতন নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য করেনি। বরং তারা নির্বাচনী নানামুখী বিশ্লেষণ করতে রাতের ঘুম হারাম করছেন।
রাষ্ট্র, ধর্ম, শিক্ষা, রাজনৈতিক মতাদর্শ, সম্প্রীতি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, উৎসব সবকিছুর উপরে প্রথম যে কথাটি আসে সেটি আমরা সবাই মানুষ।
মানবতার কোন সভ্যতায় এভাবে রাজনৈতিক টানাপোড়নের সময় বিশেষ করে নির্বাচনের সময় বারবার দেশের সংখ্যালঘুদের উপর হামলার বিষয়টি সুস্থ মস্তিস্কে মেনে নেওয়া যায়? আমরা কি সত্যি সত্যিই মানুষ? জঙ্গলে পশুদেরও সহ-অবস্থান নিয়ে যার যার টেরিটরিতে একটি অলিখিত আইন কাজ করে। পশুরাও একসঙ্গে বাস করে। আর আমরা মানুষ নামের কলংকিত অসভ্য বর্বর একটা জাতি, যারা বারবার রাজনৈতকিক অযুহাতে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা করছি। কোথায় মানবতা? রাষ্ট্র আগে নাকি ধর্ম আগে? গণতন্ত্র আগে নাকি মানবতা আগে? আমরা একুশ শতকের বাংলাদেশে এসব কি দেখছি? দেশের সংখ্যালঘুদের উপর এমন বর্বর অসভ্য নির্মম নির্যাতনের বিরুদ্ধে ঘৃনা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। তাহলে রাষ্ট্র, সরকার, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, ধর্ম নিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র, এগুলো সবই আসলে ভোগ দখলের খোড়া অযুহাত মাত্র।
আমরা আসলে মানবতা শিখতে পারিনি। তাহলে ৪২ বছর বয়সি বাংলাদেশ আসলে কোনদিকে যাচ্ছে?
বাংলাদেশে বারবার নির্বাচনকালীন সময়ে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর পরিকল্পিত এই হামলাকে বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত ঘটনা বলে বারবার পাশ কাটিয়ে যাবার কোনো সুযোগ নেই। বরং নির্বাচন কালীন সময়ে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্পদায়ের উপর বারবারই এই হামলা অত্যন্ত সুপরিকল্পিত, সুচিন্তিত এবং সুসংগঠিতভাবেই করা হয়েছে। আর এই হামলার পেছনে নির্বাচনের সময়কে বেছে নেবার পেছনেও অসৎ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই প্রধান। শুধুমাত্র স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত শিবিরের লোকজন এই হামলার সঙ্গে জড়িত নয়।
বরং দেশের প্রধান দুইটি রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)'র লোকজনও এই হামলার পেছনে জড়িত। যখন যারা ক্ষতায় থাকে তারা বিরোধী দলকে এই হামলার দায় দিয়ে নিজেরা ফেরেশতা সাজার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রকৃত সত্য হল, এই হামলার সঙ্গে দেশের সকল রাজনৈতিক দলের সরাসরি ও পরোক্ষ সম্পর্ক বিদ্যমান। যখন যার প্রয়োজন পড়ে তখন সে এই হামলা করে বাংলাদেশ থেকে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়কে নিশ্চিন্থ করার পায়তারা করছে বলেই ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়।
২০০১ সালের ১ লা অক্টোবর নির্বাচন পরবর্তী সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর একই ধরনের হামলার পর, হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ তখন সরকারের কাছে আবেদন করেছিলেন, আমরা ভোটের অধিকার চাই না।
আমাদের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে নিন। কিন্তু আমাদের নিরাপত্তা দিন। তাদের সেই আবেদনে কেউ সারা দেয়নি। বরং ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটলেও এবারের ৫ জানুয়ারি'র নির্বাচনে সেই ঘটনা আবার আরো তীব্র আকারে ঘটলো।
১৯৪১ সালের ভারতীয় আদমশুমারি অনুয়ায়ী, বাংলাদেশ ভূখণ্ডে তখন অন্তত শতকরা প্রায় ২৮ ভাগ মানুষ ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ।
১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান দেশ বিভাগ ও ১৯৪৬-৪৭ সালের হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার পর সেই সংখ্যা ১৯৫১ সালে শতকরা ২২ ভাগে নেমে আসে। তখন বাংলাদেশের অভিজাত হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা জানমালের নিরাপত্তার প্রশ্নে ভারতে চলে যায়। কিন্তু যারা গরিব তাদের আর যাওয়ার সুযোগ রইলো না। তারা এই হাজার বছরের বংশ পরম্পরার জন্ম ভিটেমাটিতেই আগলে রইলেন। পাকিস্তান কায়েক হবার পর সংখ্যালঘুদের উপর নানান ধরণের চাপ ও নির্যাতনের ফলে তখণ থেকে নিরবেই অনেকে বাংলাদেশ ছেড়ে যান।
১৯৬১ সালে সেই সংখ্যা মোট জনসংখ্যার শতকরা ১৮.৫ ভাগে নেমে আসে।
পাকিস্তানের সঙ্গে রাজনৈতিক মতাদর্শে এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রশ্নে ১৯৭১ সালে যে স্বাধীনতা যুদ্ধ সংগঠিত হয়, তখনো বাংলাদেশের প্রধান টার্গেটে পরিনত হয়েছিল সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালের প্রথম আদমশুমারি সাক্ষ্য দেয় যে, তখন বাংলাদেশে মাত্র শতকরা ১৩.৫ ভাগ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ ছিল। অন্যরা দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর মুসলমানদের কর্তৃত্ব ও চাপের কারণে সেই দেশ ত্যাগের ঘটনাটি নিরবে ঘটতেই থাকলো।
১৯৮১ সালে সেই সংখ্য নেমে আসে শতকরা ১২.১৩ ভাগে। আর ১৯৯১ সালে সেটি দাঁড়ায় শতকরা ১১.৬২ ভাগে।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক ও নির্বাচনকালীন এই হামলা ও সহিংসতা বন্ধ না হবার কারণে ২০০১ সালে এসে দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র শতকরা ৯.৬ ভাগে। ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, তখন বাংলাদেশে অন্তত ১ কোটি ১৩ লাখ ৭৯ হাজারের মত সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস ছিল। আর ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় শতকরা ৮ ভাগে নেমে আসে।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বিদ্যমান রাজনৈতিক সহিংসতা ও সংখ্যালঘুদের উপর বারবার হামলা ও নির্যাতনের ঘটনায় এই সংখ্যা এখন প্রকৃত হিসেবে কত সেটি বলা কষ্টকর হলেও, ধারণা করা যায়, এটি শতকরা ৫ ভাগের বেশি হবার কোনো যুক্তি নেই। কারণ, ২০১১ সালের আদমশুমারির পরে দেশে নিরবে হিন্দু সম্প্রদায়ের দেশ ত্যাগের অনেক ঘটনাই ঘটেছে। তাই বর্তমানে দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকসংখ্যা শতকরা ৫ ভাগের বেশি হবে না। তাছাড়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেখানোর জন্য বাংলাদেশের সরকারি তথ্য ও হিসেবে অনেক প্রকৃত তথ্যই এদিক সেদিক করার অভ্যাস মোটেও মিথ্যে নয়।
তাহলে স্বাভাবিক প্রশ্ন জাগে যে, বাংলাদেশে কি শেষ পর্যন্ত এভাবে ধীরে ধীরে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় একদিন নিশ্চিন্থ হয়ে যাবে? এখন যদি আমাকে কেউ এই প্রশ্ন করেন, আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি, যদি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে বাংলাদেশে আগামী বিশ পঁচিশ বছরের মধ্যে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় একটি নৃ-গোষ্ঠীতে পরিনত হতে যাচ্ছে।
এর পেছনে রাজনৈতিক অসৎ উদ্দেশ্য যেমন দায়ী। তেমনি বলপ্রয়োগ, রাজনৈতিক চাপ, নির্বাচনে হিন্দু সম্প্রদায়ের এভাবে নির্মম বলিদান, ধন সম্পদ লুটপাট, মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসার, দেশে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের বংশবিস্তার, স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির বিস্তার, দেশের সংবিধানে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক দলগুলোর এসব হামলার সময় নিরব দর্শকের ভূমিকা, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর নির্লজ্ব ব্যর্থতা, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা না দিতে পারার রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা, প্রতিবেশী দেশ ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের টানাপোড়ন, প্রতিবেশী মায়ানমারের জাতিগত দাঙ্গা, দেশের দুর্বল গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা, দেশে বিদ্যমান অন্যের সম্পত্তি দখলের লাগাতার সংস্কৃতি, হিন্দু সম্প্রদায়ের নিজস্ব নিরাপত্তাহীনতা, মিডিয়ার পক্ষপাত আচরণ, আর দেশের মানুষের মানবতা বিরোধী নির্মম ঘটনার পরেও স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি, এসব সম্মিলিত ধারার যুগপথ ধারার কারণেই ভবিষ্যতে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় এক সময় নিশ্চিন্থ হয়ে যেতে পারে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিনীত নিবেদন, নির্বাচনের পর চলমান রাজনৈতিক সহিংসতা থেকে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এখনই আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্কতায় ব্যবহার করুন। বিশেষ করে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা আর যাতে বিঘ্নিত না হয়, তাদের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়ার পাশাপাশি তাদের প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণেরও ব্যবস্থা করুন। নির্বাচন কালীন সহিংসতার সকল উপাদান সক্রিয় থাকা স্বত্ত্বেও কেন দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য যথেষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা সরকার গঠন করলো না, সেই অযুহাত নিয়ে রাজনীতি না করে বরং এখনই অবশিষ্ট হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর যাতে আর একটি হামলা না হয়, সেই নিশ্চয়তা নিশ্চিত করার অনুরোধ করছি।
নতুবা সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এটি আরো পাকাপাকিভাবে নিশ্চিত করে, দেশে বসবাসরত সংখ্যালঘু সকল সম্প্রদায়কে একটি নির্দিষ্ট সময় বেধে দিন, যে অমুক তারিখের মধ্যে সবাই নিরাপদে দেশত্যাগ করুন, নইলে অমুক তারিখে একযোগে হামলা করে সবাইকে শেষ করা হবে। একটা কঠোর সিদ্ধান্তে দয়া করে আসুন। বারবার সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক ঘুটি হিসেবে ব্যবহার না করে, এই সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান করুন।
আর যদি বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হয়, তাহলে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, এটা দশম সংসদের প্রথম অধিবেসনেই বর্জন করে ধর্ম নিরপেক্ষ লিখুন। পাশাপাশি জাতি ধর্ম বর্ণ গোষ্ঠি নির্বিশেষে সকলকে নিরাপত্তা দেবার একটি স্থায়ী কার্যকর ব্যবস্থা করুন।
আমরা আর একজনও সংখ্যালঘু'র উপর হামলা দেখতে চাই না। আর সংখ্যালঘু নিয়ে রাজনীতিও দেখতে চাই না। অনেক বৃদ্ধ হিন্দু মহিলা কান্নাজড়িত কণ্ঠে দাবী করেছেন, নৌকায় ভোট দেবার পর আজ তাদের এই দশা। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এখন শুধু একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানই নয় দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। সংখ্যালঘুরা কোথায় ভোট দিলেন, কেন ভোট দিলেন সেটি একটি সুসংগঠিত সুপরিকল্পিত হামলার জন্য অন্যতম কারণ হতে পারে না।
আর এটি মেনে নেওয়া যায় না। একজন মুসলমান কোথায় ভোট দিলেন, তার যেহেতু কোনো জবাবদিহিতা নেই, একটি রাষ্ট্রে কেন একজন সংখ্যালঘুকে বারবার এই একই প্রশ্নে নির্মম হামলার শিকার হতে হবে?
নইলে আমার যে হিন্দু বন্ধু সে আমাকে কোন ভরসায় বিশ্বাস করবে? আমার যে হিন্দু প্রতিবেশী কোন ভরসায় তারা আমাদের পাশে বসবাস করবে? আমাদের যে হিন্দু উৎসব, কোন ভরসায় তারা সেই উৎসব করবে? ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর হামলার পর তারা পরের বছর তাদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব সারদীয় দুর্গাপূজা বর্জন করেছিলেন। একটি সম্প্রদায় কতো কষ্ট পেলে নিজেদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব বর্জনের ঘোষণা দিতে পারে, সেটি কি আমরা একবারও অনুমান করতে পারি? আমরা কি এই হামলার প্রতিবাদে আগামী ঈদ উৎসব বর্জন করব? ২০০১ সালে হিন্দু সম্প্রদায় দাবী করেছিলেন, তারা ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে জীবনের নিরাপত্তা চায়। যদি তাদের নিয়ে সত্যিই কোনো রাজনীতি না থাকে, তাহলে তাহলে তাদের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে নিয়ে আগে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক। নিরাপত্তা যখন সার্বিকভাবে নিশ্চিত হবে, তখণ না হয় তারাই আবার দাবী তুলবে যে, আমাদের ভোটের অধিকার এখন ফিরিয়ে দাও।
একটা সমাধান দয়া্ করে বের করুন। আর এভাবে মানবতার পরাজয়, সভ্যতার পরাজয়, হিংসার রাজনীতিতে ধুকে ধুকে শকুনের হিংস্র থাবার মুখে দেশের হিন্দু সম্প্রদায়কে বারবার মুখোমুখি করার সত্যি সত্যিই কোনো অসভ্যতা আমরা দেখতে চাই না।
আর সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়কে আহবান জানাব, আপনারা পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায় মহল্লায় নিজেদের নিরাপত্তার জন্য যুবকদের নিয়ে নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলুন। যতোক্ষণ নিজেরা লড়াই করতে পারবেন, ততোক্ষণ লড়াই করুন। নিজেদের বসত বাড়ি ব্যবসা সম্পত্তি ফেলে পালিয়ে শুধু আত্মরক্ষাই করা যায়, জীবন সংগ্রাম থেকে পালানো যায় না।
আপনাদের যুবশ্রেণী যতোক্ষণ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে ততোক্ষণ, আপনারা নিশ্চিত নিরাপদ। পাশাপাশি আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী যদি সময় মত সারা না দেয়, মা বোনেরাও প্রতিরোধের জন্য তৈরি হোন। যতোক্ষণ জীবন, ততোক্ষণ লড়াই। একবার প্রতিরোধ করুন, দেখবেন হামলাকারীরা পরের হামলাটি করার জন্য একটু হলেও পিছপা নেবে। বাংলাদেশে এখনো অনেক অসাম্প্রদায়িক মুসলমান আছে।
তারা আপনাদের প্রতিবেশী। আপনাদের বন্ধু। তাদেরকেও সেই প্রতিরোধ বলয়ে ডাকুন। নিজেরা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য পাড়ায় পাড়ায় এভাবে টহল প্রতিরোধ গঠন করুন। নইলে বারবার ভয় আর আতংক আপনাদের মানসিকভাবে আরো দুর্বল করে দেবে।
আর মানসিকভাবে দুর্বল থাকলে সরকারি আইন শৃঙ্খলা বাহিনী বেশি দিন আপনাদের যে পাহারা দিয়ে বাঁচাতে পারবে না বা পাহারা দেবে না এটা আপনারাও হয়তো জানেন। পাশপাশি এই হামলার সকল ঘটনা বিশ্ববাসীর কাছে নানাভাবে তুলে ধরে সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করুন। আপনারা যতোবেশি সংগঠিত থাকবেন, ততোই আপনাদের নিরাপত্তা সবল থাকবে। মনে রাখবেন, যারা হামলা করছে তারা কিন্তু দলবদ্ধ। তাই আপনারাও দলবদ্ধ থাকুন।
এর বেশি কিছু বলার মত আমি ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। একজন মুসলিম ঘরের সন্তান হিসেবে আপনাদের কাছে আমি ক্ষমা চাচ্ছি। এই হামলার দায় মুসলিমরা এড়াতে পারে না। রাষ্ট্র এড়াতে পারে না। রাজনৈতিক দলগুলো এড়াতে পারে না।
নাির্বাচন কমিশন এড়াতে পারে না। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী এড়াতে পারে না। সত্যি সত্যিই কেউ এই দায় এড়াতে পারে না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।