আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গোপন

আমি এমন এক সাধারন মানুষ হতে চাই যে অসাধারন হবার পেছনে দৌঁড়ায়না এবং বিনা প্রশ্নে কিছু গ্রহন করেনা ।

অবশেষে আমি জায়গাটিতে পৌঁছালাম ।

দিনের পর দিন যাবত একটি নতুন বাসস্থানের জন্য জুতার শুকতলা ক্ষয়ে ফেলেছি । কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিলোনা । অনেক কষ্ট করার পর ২ কামরার এই বাসাটিতে আমার থাকবার ঠাঁই হলো ।

পূর্বের কোন কথা স্মরণ করতে ইচ্ছা করছেনা । অথচ সমগ্র মাথাজুড়ে সেই দুঃসহ স্মৃতিগুলোই খেলা করে যাচ্ছে অবিরাম ।

সবকিছু গোছগাছ করে নেওয়ার পর শরীরে আর তেমন কোন শক্তি অবশিষ্ট ছিলোনা । কোনমতে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে টেলিভিশন অন করলাম । সারাদিন কোন খবর দেখিনি ।

এবারে একটা খবর দেখা যাক । কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই চোখে পড়লো পুরনো হয়ে যাওয়া কোটটি এলোমেলোভাবেই বিছানার এক কোনায় পড়ে আছে । গোছগাছ করবার সময়তে খেয়াল করিনি । প্রথমে ভাবলাম যেমন আছে তেমনই থাক । কিন্তু মনে খচখচ করতে লাগলো ।

সচরাচর যে কোন কাজ করতে বসলে সেটা অর্ধেক শেষ করে ফেলে রাখতে পারিনা । এই ধরণের সামান্য কাজের বেলাতেও আমার খুতখুতানি কাজ করে সবসময় । ক্লান্তি নিয়েও উঠে পড়লাম । পরিপাটি করে কাবার্ডটায় কোটটি রাখলাম । কোটটি রেখে কাবার্ডের দরজা বন্ধ করতেই হঠাৎ দুই থেকে তিন পৃষ্ঠার একটি কাগজ মাটিতে পড়লো ।

দেখে মনে হচ্ছে কারো চিঠি হবে । হয়তো এই ঘরে আগে থাকতো তারই হবে ।

কাগজটি খুলে দেখবার আগে একটু উল্টেপাল্টে দেখলাম । বেশ পুরনো সময়ের বলেই দেখে মনে হলো । জানিনা তার ভেতরে কি আছে তবে বাইরের অবয়বে অযত্ন আর অবহেলার ছাপ স্পষ্ট ।

কাগজটি হাতে নিয়ে পুনরায় বিছানায় নিজেকে এলিয়ে দিলাম । তীব্র ক্লান্তিতে শরীর ভেঙ্গে আসছে । বেডসাইড টেবিলে এশট্রে দিয়ে কাগজটিকে চাপা দিয়ে রাখলাম । মনে হলো আগে একটু ঘুমিয়ে নেই তারপর উঠে পড়ে নিবো তাতে কি লেখা আছে । যেই অবহেলা আর উদাসীনতার ছাপ কাগজের চারপাশে দেখেছি তাতে এটুকু নিশ্চিত হয়েছি এটা নিতে আর কেউ আসবেনা ।

একজন মানুষ অযত্ন করা করা অপর মানুষেরও খোঁজখবর নেয় কিন্তু অবহেলা করে ছেড়ে যাওয়া নিজের লেখা পুরনো চিঠিপত্র নিতে কখনো আসেনা । নিজের লেখা পুরনো চিঠিপত্র কি এতোই যন্ত্রণাদায়ক যার প্রতি অভিমান কিংবা বিরাগ কোন মানুষের চাইতেও বেশী থাকতে পারে ? এসব ভাবতে ভাবতে টেলিভিশন অফ করে ঘুমাতে চেষ্টা করলাম ।

কিছুতেই ঘুম এলোনা । কখনো কখনো এমন হয় । শরীরের ক্লান্তি টের পাওয়া যায় কিন্তু বিছানায় গেলে আর ঘুম আসেনা ।

কোনভাবেই তাকে বাগে আনা যাচ্ছেনা । প্রায় আধাঘন্টা যাবত ঘুমানোর চেষ্টা করার পর উঠে মনে হলো গোসলটা সেরে আসি । গোসল সেরে টেলিভিশনটা চালিয়ে বিছানায় বসতেই এশট্রেতে চাপা দিয়ে রাখা সেই কাগজটির দিকে চোখ গেলো । তুলে নিয়ে পড়তে আরম্ভ করলাম ,

“ প্রিয়তমেষু ,

আমার খুব প্রিয় একটা সম্বোধনে তোমাকে ডেকে চিঠিটা লিখতে শুরু করলাম । সম্বোধন নিয়েও আমাদের যেই সময়গুলোতে ঝগড়া হতো সেই সময়ের কথা মনে হচ্ছে ।

আমাদের ভালোবাসার উপলক্ষ্যের কোন অভাব ছিলোনা তেমন ঝগড়ার উপলক্ষ্যেরও কোন অভাব ছিলোনা । চার্লস ডিকেন্সের “ A Tale of Two Cities “ উপন্যাসের মতো বলতে পারি “ It was the best of times , it was the worst of times “ । এমন সময় অন্যদের বেলায় অহরহ আসে কিনা বলতে পারিনা তবে আমার জীবনে আসেনি তা নিশ্চিতভাবে বলার জন্য কসম কিংবা শপথ কোনটিরই প্রয়োজন পড়বেনা ।

তোমাকে চিঠি লিখতে লিখতে আমি সবসময়েই হাসি । অদ্ভুত একটা ব্যাপার ।

কখনো শুনেছো চিঠি লিখতে লিখতে কেউ ঠোঁটে হাসি মেখে রাখে ? এখনো তাই হচ্ছে । অথচ প্রবল দুঃসময়ের মাঝে বাস করছি দিনের পর দিন । মনে , শরীরে কোথাও হাসির সামান্য জলতরঙ্গেরও বেজে উঠবার কোন উপলক্ষ্য আমাকে স্পর্শ করবে এমন সুযোগ নেই । জীবনকে যাপন করার সময় আমার ফুরিয়ে গেছে বুঝি । দীর্ঘশ্বাসটাও আজ আর গোপন করিনা ।

যেন আত্মমগ্ন আকাশকে দেখতে দেখতে সহজিয়া মন আচমকা হলুদ বিকাল থেকে গাঢ় সন্ধ্যার মতো রঙ পাল্টে ক্রোধান্বিত হয়ে গেলো । মস্তিষ্কের কোষে কোষে স্মৃতিসমূহ কেটে কেটে ছড়িয়ে যেতে যেতে প্রহর ঘনালো । এদিকে অস্থিরচিত্তের জলজ সাপ ক্রমশ আঁকাবাঁকা জলপথে সাঁতার কেটেই চলেছে । অথচ কোথাও কোন সাড়া দেওয়ার চিহ্ন নেই । গোটা সময়টাই যেন নিস্পৃহতার স্তম্ভ ।



তোমার কাছে এই চিঠি কখনো পৌঁছাবেনা জেনেই এতো কাব্য করে লিখছি । পাঠাবার সুযোগ থাকলেও তোমায় পাঠাতাম না । বলতে পারো চিঠিটা তোমাকেই লেখা আবার নিজেকেও লেখা । আত্মোপলব্ধিকে শব্দে , বাক্যে ভেঙ্গে ভেঙ্গে অনুভূতির দূর্গ তৈরী করার সাথে তুমিই তো প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলে মনে পড়ে ? আমি জানি বিগত সেই সময়গুলোকে তুমি সচেতনভাবেই স্মরণ করতে চাওনা । আরো জানি সেটা আমার প্রতি কোন রাগ কিংবা বিরাগ থেকে নয় ।

তোমার নানাবিধ বঞ্চনা , সমাজের প্রতি তোমার অপরিসীম ক্রোধের জায়গা থেকেই তুমি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছো । আমি একটা সময় কতো কিই না ভাবতাম তোমাকে । তুমি অনেক বড় হবে , তোমার মনের গাঢ় থেকে গাঢ়তম অনুভূতি শব্দে , বাক্যে সবার মাঝে স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো ছড়িয়ে পড়বে । তুমি বেড়ে উঠবে , আমি তার ছায়ার মাঝে নিজেকে পুনরাবিষ্কার করতে করতে কাটিয়ে দেবো একেকটি প্রহর । তার সবই যে কোন মনোমুগ্ধকর উপাখ্যান হতে হবে এমনটা কখনো চাইনি ।

বরং আমি চেয়েছি সেই প্রহরগুলোর বেশীরভাগ যেন সংকটাপূর্ণই হয় । মানুষের সংকট সম্পর্কে জানাশোনা না থাকলে কখনো তার কাছাকাছি আসা যায়না এটাও তো তুমিই শিখিয়েছিলে । তুমি ছাড়া আর কার সংকটগুলো জানবার জন্য আমার এমন তীব্র আকুলতা থাকতে পারতো ?

তুমি স্বেচ্ছায় নির্বাসিত জীবন যাপন করছো অনেকদিন হলো । প্রথম প্রথম খুব রাগ হতো তোমার উপরে । কেন এভাবে নিজেকে নিঃশেষ করে দিচ্ছো সেটা ভেবে ।

তখন অনুভূতিতে অনেক কাঁচা ছিলাম তো অনেক কিছু বুঝবার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত যুক্তিতর্ক ব্যবহার করে বুঝে উঠতে পারিনি । এখন বুঝি নিজেকে বিক্রী করা থেকে বাঁচাতে সেই স্বেচ্ছানির্বাসন ছাড়া তোমার কাছে অন্য কোন উপায় ছিলোনা । তোমার এই সিদ্ধান্ত কি এক অসহনীয় দোটানায় আমাকে ফেলে দিয়েছিলো ভবিষ্যতের জন্য জানো ? একদিকে তোমার সেই অনমনীয় জেদকেই আমি সবচেয়ে বেশী ভালোবেসেছি অন্যদিকে এই জেদের কারণেই আমার মনে হয় আমার কাছে এখন কিছুই নেই । এক জঘন্য সময়ের স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য কোন দুঃখ নেই । কিন্তু তুমি ভালো থাকবে সামান্য এই চাওয়াটুকুও পূরণ হলোনা আমার ।

চিঠিটা তোমার কাছে কখনো পৌঁছে গেলে দোটানার জায়গাটা নিশ্চিত বুঝতে । তোমার প্রবল ক্ষমতাধর বুদ্ধিদীপ্ত মস্তিষ্কের পাশে যেই সূক্ষ্ণতম হৃদয়াবৃত্তি ঘুরপাক খেয়েছে তবু নোংরা পারিপার্শ্বিকতার জন্য প্রস্ফুটিত হতে পারেনি তাকে যে আমি কতো ভালোবাসতাম । আচ্ছা ভালোবাসতাম বলছি কেন ? এখনো তো ভালোবাসি । নাকি আমিও ক্রমশ ধরে নিতে শুরু করেছি সেই সব পর্ব অতীতে পরিণত হতে শুরু করেছে ?

তোমাকে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার ছিলো কিন্তু কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি । এখানেই লিখে ফেলি ।

এই যে ধরো শতাব্দীর পর শতাব্দী যাবত মানুষ একে অপরের কাছাকাছি আসছে , বংশবৃদ্ধি করছে তার মাঝে তো নতুন কিছু নেই । সেই একইভাবে এক্স , ওয়াই ক্রমোজমের সমীকরণ , বীর্যের সোঁদা আঁশটে গন্ধ থেকে নতুন প্রাণের উন্মেষ , সেই সৃষ্টির উৎপাদক শ্রেণী গর্ভধারিণীরা কনামাত্র সম্মাননাও পায়না কোথাও । তবু মানুষ কেন এতো বছর পরে এসেও হৃদয়বৃত্তির এই জটিল , দুর্বোধ্য খেলায় সম্মোহিত হতে ভালোবাসে ? সমগ্র পৃথিবী থেকেই প্রতিটি মানুষ যেই প্রবল বিচ্ছিন্নতায় জীবন কাটিয়ে দেয় তার ক্ষতচিহ্নে কিভাবে এই হৃদয় বিনিময় প্রলেপ লাগিয়ে জীবনের কাছেই জীবনকে ফিরিয়ে নেয় ? তোমার কাছে প্রশ্নগুলো করাও হলোনা , উত্তরও পাওয়া গেলোনা । কি আর করা ? অসহায়ের জীবন মানেই না পাওয়া একরাশ প্রশ্নের উত্তরের জন্য নিরন্তর হাহাকার । তোমাকে দেখেই এই উপলব্ধি হয়েছিলো ।



তোমার কাছে কখনো এই চিঠি পৌঁছাবেনা তবুও এই চিঠিটাই তোমাকে লেখা আমার দীর্ঘতম চিঠি । কি অদ্ভুত তাই না ? মনে হচ্ছে তোমাকে যতো বেশী জানাতে চেয়েছি তার চাইতেও বেশী গোপন করতে চেয়েছি । সেই গোপনীয়তার কথা তোমাকে জানাতে পারছিনা বলে আফসোস হচ্ছে । গোপনীয়তার মাঝেও যে গভীরতম প্রাপ্তি থাকতে পারে সেটা তুমি আমার মাধ্যমে জেনে যেতে পারলে অনেক দুঃসহ বোঝার ভার হালকা করতে পারতে । কিন্তু সেই সুযোগ আর তোমার হলোনা ।

আমিও আর তোমাকে কিছু লিখে যেতে পারবোনা । চিঠিটা শেষ করে এখন নিজের জিনিসপত্র গোছগাছ করে সব কিছুদূরের এক ডাস্টবীনে ফেলে দিয়ে আসবো । তারপর চলে যাবো সেই ব্রীজের সামনে । কোন এক শরতের রাতে যেখানে তুমি আমাকে প্রথম চুমু খেয়েছিলে । তোমার সেই ভয়াবহ আকর্ষণীয় চাহনীর ছবিটা ঠোঁটে লাগিয়েই আমি আর সময় নষ্ট করবোনা ।

মানুষজন ধরে ফেলে আমাকে বাঁচিয়ে ফেললে আরো দীর্ঘদিন এভাবে মরে থাকতে হবে ।

ইতি ,
তোমার ময়ী “

কোথাও একটা বাজ পড়ার শব্দ পেলাম বলে মনে হচ্ছে । পরমুহূর্তেই বিভ্রমে পূর্ণ হয়ে উঠলো আমার মস্তিষ্ক । বাজ কি আসলেই পড়েছে কোথাও নাকি আমার মস্তিষ্কেই কেবল সেই বাজ পড়ার শব্দ শুনে যাচ্ছি ক্রমাগত ? ঠিক এমন সময়ে দরজায় হালকা কড়া নাড়ার শব্দ । আইহোল দিয়ে তাকিয়ে দেখতে চেষ্টা করলাম কে ।

চিনতে পারলাম না । আচ্ছা আগন্তুক কি আমাকে গোপন কিছু জানাতে চায় ? সেই গোপনীয়তার চরিত্র কি এই চিঠিতে বর্ণিত ... নাহ কোনভাবেই উত্তরটা ইতিবাচক আসলোনা । আমি শক্ত মনেই দরজা খুলবো মনঃস্থির করলাম । চিঠির বর্ণিত সেই গোপনীয়তার স্পর্শ যত্রতত্র যে কেউই পায়না ।



অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.