ম্যানেজার মাইডিয়ার আলাপী মানুষ । আরিফ সকাল সকালই উত্তরা ব্যাংকের এই শাখাটিতে গেছে । লকার ভাড়া করবে । সেদিন দিনের বেলা বাসার তালা ভেংগে ডাকাতরা সব সোনা দানা নিয়ে যাওয়ার পর হুঁশ হয়েছে । সব শুভার্থীরা অবাক হয়ে বলল,’ আজকাল এত সোনা দানা কেউ ঘরে রাখে বলেন ?’ আরিফ বলল,’ কোথায় রাখে ?’
‘ কেন আপনি কি কাচা মাছ খান ? লকারে রাখে ভাই লকারে ।
‘ তাদের পরামর্শেই লকার ভাড়া করতে আসা ।
ম্যানেজার ইকবাল হাসান বেশ করিৎ কর্মা লোক । আরিফকে উঠতে হল না । তাকে ভিজিটিং চেয়ারে বসিয়ে চা খাওয়ালেন । একজন অফিসারকে ডেকে দায়িত্ব দিয়ে দিলেন ।
অতি দ্রুত কাজ সম্পন্ন হল ।
কথায় কথায় জানা গেল ইকবাল হাসানের ফাদার ইন ল পানি উন্নয়ন বোর্ডের রিটায়ার্ড ডিডি । উৎকর্ণ হল আরিফ । তাঁর নাম জানতে চাইল । নাম শুনে চমকে উঠল সে ।
অবাক বিস্ময়ে জানতে চাইল,’ আপনার স্ত্রীর নাম কি জেসমিন ?’
এবার বিস্মিত হবার পালা ইকবাল হাসানের , বলল,’ হ্যাঁ , কিন্তু আপনি কিভাবে জানলেন ?’
জেসমিন ! জেসমিন !! আরিফের মনে হল সময় থেমে গেছে । নাকি পিছিয়ে গেছে ?
কত বছর আগের কথা ? ত্রিশ বছর । কোথা দিয়ে গেল সময় ? কেমন ঘোর লাগে আরিফের ।
সেবার এসএসসি পাশ করেছে আরিফ । কৈশোরের কলি যৌবনের দিকে দ্রুত ধাবমান ।
ওদের বিল্ডিংএর দোতলায় থাকেন শহীদ সাহেবের পরিবার । তার ছেলে মিঠু আরিফের ঘনিষ্ঠ বন্ধু । বন্ধুর বোন জেসমিন । ওদের কলেজে ফার্সট ইয়ারের শেষের দিকে জেসমিন নাইনে উঠল । আরিফের ভেতরে তখন যৌবনের স্ব্পন বীজ অংকুরিত হচ্ছে ।
দৃষ্টিতে প্রকাশ পাচ্ছে অচেনা রঙধনু । চেতনার ধূ ধূ প্রান্তর সবুজ ঘাসে ছেয়ে গেছে । নানা বর্ণ আর গন্ধের ফুলে শোভিত হয়েছে উদ্যান । ভাবনার মৌমাছি নতুন ভাললাগার মৌচাক ভরে তুলেছে ।
জেসমিনের দিকে তাকালে কেমন অচেনা লাগে ।
ওর ঘন কাল চুল যেন জীবনান্দের ‘ চুল তার কবেকার’ এর চেয়ে সুন্দর স্ব্পনময় । ওর চোখ যেন প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরতায় চাঁদের কিরণ মেখে অনন্ত মায়ায় ভাস্বর । ওর হেঁটে চলা যেন অজানা মুদ্রার নৃত্য । ওকে যত দেখে বুকের গভীরে তত কষ্ট বেড়ে যায় । চিন চিন ব্যাথা করে ।
কিসের অভিমানে বুক ফুলে ওঠে । অকারন কান্নার স্রোত কন্ঠ চেপে ধরে । চেষ্টা করেও নিজেকে দূরে রাখা যায় না । জেসমিন শুধু টানে । দূর্বার প্রবল আকর্ষনের ঘোর জেগে থাকে ।
সব ভয় লজ্জা শংকা উপেক্ষা করে একদিন সন্ধার পর সিঁড়ির নিচে জেসমিনের মুখোমুখি হল আরিফ । পেছন থেকে ওর নাম ধরে ডাকল । থেমে ফিরে তাকাল জেসমিন । সব রিহার্সেল এলোমেলো হয়ে গেল আরিফের । এভারেষ্টের কঠিন পথ মনে হল সামনে ।
অনেক কষ্টে সাধ্য সাধনায় সার্টের বুক পকেট থেকে ছোট চিঠিটা বের করে জেসমিনের দিকে বাড়িয়ে দিল । বলল ,’ আমার কিছু জরুরী কথা এতে লেখা আছে । পড়ে উত্তর দিও । ‘ জেসমিন ঘাড় কাত করে সায় দিয়ে চিঠিটা নিল ।
আহ , কি শান্তি ।
প্রেমের কঠিন প্রসব বেদনা বুঝি মুক্তি দিল আরিফকে । মনে হয় পৃথিবী জয় করা হয়ে গেছে । শুধু ঝান্ডা উড়ানো বাকী । মাঠ পাথালে হেঁটে স্কুলের বারান্দার দিকে এগোল সে । নিজেকে মনে হচ্ছে দিগ্বিজয়ী নেপোলিয়ন ।
পরদিন সকাল থেকে অপেক্ষা শুরু হল । উত্তরের অপেক্ষা । একদিন , দুদিন , তিনদিন গেল । খবর নেই । কি হল ? পথে ঘাটে সামনে পড়ে গেলে জেসমিন অন্যদিকে তাকিয়ে থাকছে ।
শংকা চেপে ধরল আরিফকে । আশার ফানুস চুপসে যেতে শুরু করল ।
সেদিন ভোরে জেসমিনের দেখা পাওয়ার আশায় আশে পাশে ঘুরে এল আরিফ । মেয়েটি মাঝে মাঝে ভোরে শিউলী তলায় ফুল কুড়াতে যায় । এ ক’দিন ওখানে যাচ্ছেনা ও ।
হতাশা গ্রাস করতে থাকল আরিফ কে ।
ঘরে এসে বিছানায় শুয়েছে । অগ্নিমূর্তি ধারন করে বাবা এসে ঢুকলেন রুমে । বললেন,’ অনেক সেয়ানা হয়েছ, না ? চিঠি লেখ !’
পা থেকে সেন্ডেল খুলে ইচ্ছামত প্যাদানী দিলেন । আরিফ শুয়েই রইল ।
মারের কোন অনুভূতিই তার নেই । লজ্জা ঘৃনা অভিমান ওকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে । ব্যুমেরাং হয়ে আসা স্বপ্নের আঘাতে ও যেন পঙ্গু হয়ে গেছে ।
প্রত্যাশার বিপরীতে এ আঘাতটি আরিফের জন্য খুবই তীব্র ছিল । ওর মন ভেংগে গেল ।
এমন পরিনতি আরিফের ধারনার বাইরে ছিল । জেসমিন এমন করল কেন কিছুতেই ভেবে পেল না । সে তার অসম্মতি জানাতে পারত । চিঠি না নিতে পারত অথবা ফেরত দিতে পারত ।
জীবন যাত্রার ধরন পালটে গেল আরিফের ।
উচ্ছল জীবন ম্রিয়মান স্তব্ধ হয়ে গেল । পথে ঘাটে দেখা হলে বেদনার্ত চোখে তাকায় জেসমিনের দিকে । কিন্তু কেমন স্বাভাবিক মেয়েটি । যেন কিছুই হয়নি । কৌতুক মেশানো দৃষ্টি ওর ।
ভাব যেন ভালই জব্দ করা গেছে আরিফকে । এত সুন্দর একটি মেয়ে এমন নিষ্ঠুর হয় !
সময় বোধকরি কিছু জিনিশ বদলে দেয় । লুবনা , জেসমিনের ছোট বোন । সে একদিন রহস্যময় হেসে একটা ছোট চিরকুট ধরিয়ে দিল আরিফের হাতে । জেসমিনের চিঠি ! বিস্ময়ে আনন্দে হতবাক হল আরিফ ।
দ্রুত নিজের রুমে গিয়ে দরোজা আটকে চিঠির ভাঁজ খুলল । জেসমিন তার আচরনের জন্য ক্ষমা চেয়েছে । নিজের ভালবাসার কথা প্রকাশ করেছে । আরিফের জীবনে আবার যেন ছন্দ ফিরে এল । অনেকদিন পর নিশ্বাস , দৃষ্টি আর নিদ্রায় তৃপ্তি খুঁজে পেল ।
অনেক গুছিয়ে বিশাল এক চিঠি লিখল ।
কিন্তু সে অবাক হয়ে লক্ষ্য করল উত্তর আসছে না । একদিন ওকে সামনে পেয়ে কিছু বলতে চাইল । কিন্তু মেয়েটি খুব দ্রুত হেঁটে আরিফকে অতিক্রম করে চলে গেল । হতভম্ব হয়ে গেল আরিফ ।
জেসমিনের এ বিচিত্র আচরণের কোন ব্যখ্যাই সে খুঁজে পাচ্ছেনা ।
কেমন নিষ্ঠুর আর অদ্ভূত খেলা মেয়েটির !
আরিফ ওকে প্রাণপনে ভুলতে চাইল । এদিকে শহরের এক বড়লোকের ছেলের সাথে প্রেমে জড়িয়ে পড়ল জেসমিন । বেশ মাখামাখি সম্পর্ক গড়ে উঠল ওদের । চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিইবা করার থাকল আরিফের !
ইন্টার পাশের পর ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হিল আরিফ ।
অনেক দূরে ফেলে এল মহকুমা শহরটিকে । ছুটিছাটায় যাওয়া হয় । জেসমিন সেই একই রকম সুদূর রহস্যময় নারী । অন্যের বাগানে ঠাঁই নেয়া প্রস্ফুটিত গোলাপ ।
দ্বিতীয় বর্ষ ফাইনালের পর এসে জেসমিনকে আর পাওয়া গেল না ।
ওর বাবা বদলী হয়ে গেছেন অন্য শহরে । তীক্ষ্ণ কষ্ট বিদ্ধ করল আরিফকে । আর বুঝি কোনদিন দেখা হবেনা !এ জীবনে কখনো আর বুঝি ভাসবেনা ওই প্রিয় মুখ দৃষ্টির সীমানায় ! হোক না অন্যের , চোখে চেয়ে দেখার প্রশান্তিটুকুতো ছিল ! তাও হারাল চিরতরে !
জীবন কি আর থেমে থাকে ? এযে বহতা নদী ! আরিফের জীবনও থেমে রইল না । পেরিয়ে এসেছে ত্রিশটি বছর । মাঝে মাঝে , নিজস্ব একান্ত সময়ে সেই কথাগুলো মনে হয় ।
ভাবে হয়তো কোনদিন কোথাও দেখা হয়ে যেতে পারে । চেনা যাবেতো ওকে ? কার সাথে বিয়ে হল ওর ? ও কি ভাল আছে ? ওর হৃদয়কি আজো রয়েছে সেই কঠিন পর্বতময় নিষ্ঠুর ? আরিফের কথা কি মনে পড়ে ওর ? কষ্ট কি হয় একটুও ?
ইকবাল হাসান অবাক হয়ে চেয়ে আছে ওর দিকে । বলল, ‘ কি হল আরিফ সাহেব ? কি ভাবছেন ? কথা বলছেন না যে ? আপনি কি জেসমিনকে চিনেন ?’
চমকে উঠল আরিফ । দ্রুত স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করল । বলল,’ জ্বি জ্বি , আমরাতো একসময় একই বিল্ডিংএ ছিলাম ।
ওর বড় ভাই মিঠু আমার বন্ধু । ‘
‘বাহ , তাহলেতো দেখছি আপনি আমার আত্বীয় ?’
‘ তাতো বটেই । ‘
মোবাইল টিপল ইকবাল হাসান । সংযোগ পেতেই বলল,’ এই শোন , তোমাদের এক পরিচিত আত্বীয় আমার সামনে বসে আছে । দেখতো চিনতে পার কিনা ?’ মোবাইলটা আরিফের দিকে এগিয়ে দিল ইকবাল ।
আরিফের ভেতর যেন শূণ্য হয়ে গেছে । বজ্রাহতের মত বসে রইল । ভেতরে কাঁপুনী শুরু হয়েছে । তা সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ছে । হাত কাঁপছে ।
কিভাবে মোবাইলটা নেবে ও ? মনের সাথে প্রচন্ড যুদ্ধ করে স্থির হতে চেষ্টা করল । ইকবাল হাসান বলল,’ কি ভাই, ধরেন কথা বলেন । ‘ কি কথা বলবে আরিফ ! গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে । বহু কষ্টে বলল,’ জেসমিন , আমি আরিফ । তুমি ভাল আছ ?’ ওকে চিনতে পারলনা জেসমিন , জিজ্ঞেস করল,’ কোন আরিফ ?’
‘ ওইযে সি টাইপ বিল্ডিংএ নিচতলায় ছিলাম ।
‘ ওপাশ থেকে কয়েক সেকেন্ড সাড়া পাওয়া গেল না । আরিফ আবার বলল,’ তুমি ভাল আছ ?’
‘ হ্যাঁ আছি । আপনি কেমন আছেন ?’
‘ ভাল আছি । শোন , ব্যাংকে এসে তোমার হাসব্যান্ডের সাথে পরিচয় হল । দারুন মাইডিয়ার লোক ।
তুমি সত্যিই ভাগ্যবতী । মিঠু , কাকা কাকি ভাল আছেন ?’
দ্রুত কথা শেষ করে বিদায় নিতে চাইল আরিফ । ইকবাল হাসান হেসে হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিল । বলল,’ নিজের লোক হয়ে গেলেনতো । যোগাযোগ রাখবেন ।
‘
‘ নিশ্চয়ই । ‘
ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠল আরিফ । জীবন কি অদ্ভূত, ভাবল ও ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।