ভীতু হরিণীর মত একটা মেয়ে ত্রস্ত বিক্ষিপ্ত পায়ে
হঠাৎ কোত্থেকে এসে আমার হৃদয়ের ঘরে ঢুকে পড়ল,
আর সাথে সাথে কপাট বন্ধ করে দিল!
আমি দরজায় করাঘাত করতে লাগলাম,
-ঠক,ঠক, ঠক!
-কে?কে ওখানে?
-আমি!
-আমিটা কে ?
-ইয়ে মানে আমি !
-আমিটা কে রে!
-আমাকে চিনতে পাড়ছো না?
-উহু। চেনার কথা বুঝি?
-তোমার ছিল স্বপ্ন দেখার অসুখ ।
-তাই?ভুলে গেছি!শেষ কি বলেছিলে?
-আমারে ভুলো না ।
-যা ভুলতে চাইনা তাই বুঝি বারবার ভুলে যাই
যা ভুলতে চাই তা ফাঁসির দড়ির মত গলায় চেপে বসে।
-কি করে ভুললে আমারে?
-আমারও তো সে প্রশ্ন!
-এখানে এলে কি করে?
কত দীর্ঘ দিন-রাত্রি তোমার চিঠি পাই না
ঠিকানা মনে ছিল?
-নাতো!সত্যিই তো কি করে এলাম!
-তবে কি পথ ভুলে?
-না,না এ যে আমার পরিচিত ঘর,
এই যে অগোছালো আলনা,
মাকড়শার ঝুল, ছিরে যাওয়া চটি ।
-তবে কি লোকের কাছে জিজ্ঞেস করে করে?
-জিজ্ঞেস অবশ্য করেছিলাম। তোমার সেই বিষম দুঃখের কাছে।
সে হাত নেড়ে বলল, “ঐ তো ওদিকে”!
কোন দিকে বলল কিছু বোঝা গেলো না
-কি জিজ্ঞেস করলে?
-আমার বাড়িটা যেন কোথায়?!পথটা ভুলে গেছি!
-তাই!আমার হৃদয় বুঝি তোমার বাড়ি!
তবে না চিনে এলে কি করে?
-তোমার দয়ার শরীরটার কথা তো মনে ছিল
জানতাম ওখানেই কোথাও হবে ।
-কিন্তু আমি তো মিছিলে ছিলাম
-কি এসে যায়? মিছিলে কে স্লোগান দিচ্ছিল?
কার হাত সবচেয়ে উপরে ছিল
তা দেখে তো সহজেই বোঝা যায় ।
-তুমিও গিয়েছিলে বুঝি মিছিলে?
-পথ পাচ্ছিলাম না।
বুঝতে পারলাম এই মিছিলটা ঠিকঠাক পথ চিনে ।
-ভয় পাওনি?তুমি তো খুব ভীতু ছিলে একসময়...।
-এখনো অনেক ভীতু আছি;
মিছিলে সবার ভিতরে ভাঙনের শব্দ শুনে
খুব ভয় পেয়েছিলাম ।
আর যখন তোমাকে হারিয়ে ফেললাম তখন
আমার জ্ঞান ছিল না ।
-আমাকে হারিয়ে ফেলেছিলে বুঝি?
-হঠাৎ দেখি সেই সবচেয়ে দৃপ্ট কণ্ঠটা
আর শোনা যাচ্ছে না ।
সবচেয়ে উঁচু কর্মকঠোর হাতটাও আর দেখতে পাচ্ছিলাম না।
-তারপর?
-মিছিলটা আমাকে ভুল পথে নিয়ে গেলো,
তোমার দীর্ঘশ্বাস গুলো আমার চেনা খুব ,
আমারে হাওয়ায় দোল দিয়ে বলে গেলো
তোমারে রাস্তায় রক্তাক্ত পড়ে থাকতে দেখেছে।
-আমি কেন তোমারে দেখতে পেলাম না!
ইশ!পোড়া কপাল!শেষবারের জন্য?
-আমি অনেক পথ খুঁজেছি
ভুল মিছিলটা থেকে ফিরে আসার
কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না ।
আমাদের একসাথে খাওয়া সেই সবুজ আইসক্রিমটার সাথে দেখা
সে বলে তোমাকে ডাইনের চোরা গলি ধরে একেলা হেঁটে যেতে দেখেছে
আমি সেই গলি ধরে পাগলিনীর মত ছুটে গেছি,
মঝারাস্তায় দেখি একটা দেশলাই বাক্স্;
তুমি আমাকে দেশলাই বাক্স্ বলতে,
আমার নাকি বুকজোড়া বিস্ফোরিত হবার অফুরান সম্ভাবনা;
কিন্তু আমি নাকি তোমার প্রেমের প্রদীপ জ্বালিয়েই খুশি থাকতাম;
কি যে পাগল ছিলে তুমি!
দেশলাই বাক্সটা বলল অই মোড়ের দোকান থেকে
তোমাকে সিগারেট কিনতে দেখেছে,
আমি মোড়ের দোকানীকে জিজ্ঞেস করলাম তোমার কথা ।
সে আমার দিকে বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে
মায়া মায়া কণ্ঠে বলল,
“আপামনি, সময় বড় খারাপ,
দেশের অবস্থা ভালো না,
দুই দল পাল্টাপাল্টি হরতাল দিছে ।
গুলাগুলি চলতেছে,বোমা ফাটছে যোহরের আযানের সময়,
এমন সময় আপন্যার মত ভালা মাইনষের বাইরে থাকন ঠিক না।
ঘরে গিয়া খিল দিয়া থাকেন গা,
ভাইজান আইলে আমি আপনের কথা কমু নে”।
আমি তোমার কড়া সিগারেটের ঘ্রাণ
অনুসরণ করে তার পিছনে পিছনে দৌড়াতে থাকি,
অতঃপর ঘ্রাণের সামনে পড়ে কালো কাঠের
অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে ভাঙাচোরা সিঁড়ি;
আমার ভূতের ভয় হতে থাকে ,
প্রতিটা সিঁড়িতে পা দিতেই ক্যাচক্যাচ শব্দ,
সিঁড়ির মাঝখানে গিয়ে বসে পড়ি ।
উপরে উঠব না নিচে নামব বুঝতে পারি না,
দুটা ইঁদুর ছুটে যায়,একটা তেলাপোকা উড়ে নাকে এসে পড়ে,
কোথায় যেন একটা হুতোম পেঁচা ডেকে উঠে
আমি শিউরে উঠি;
শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল স্রোত,
সব শক্তি শুষে নিয়ে নেমে যায় ।
তারপর হঠাৎ কীভাবে যেন চিনতে পারি,
এ যে তোমার পোষা রাতকানা হুতোম পেঁচাটা,
সে আমাকে বলে তাকে নদীর ধারে ফেলে তুমি
নদীর স্রোত ধরে হেঁটে গেছো ।
নদীর পথে যেতে যেতে নদী মরে যায়,
মরা নদীর বুকে দেখি কাশবন,
আমি কাশবনে ঢুকে দেখি গহন অরণ্যে এসে পড়েছি;
সূর্যের আলোও পৌছে না এখানে ।
ভীত বিস্ময়ে আবিষ্কার করি আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি!
আমি পথ খুঁজতে থাকি উন্মাদের মত,
দৌড়াতে দৌড়াতে আমি এক অভিশপ্ত ব্যধের পেতে রাখা
ফাঁদে পা আঁটকে অনন্ত গহীন গহ্বরে পড়ে যাই ।
তারপর এখানে এসে পড়ি!তোমার হৃদয়ে!
-কিন্তু আমি তো কোন ফাঁদ পাতিনি ।
-মায়জাল?মায়া দিয়ে তুমি আমাকে টেনে এনেছ ।
-যাক তবু শেষপর্যন্ত চিনতে পারলে তাহলে
-না তো!চিনতে পারিনি তো ।
চিনলে তো দরজাই খুলে দিতাম
কে তুমি?
-আমি এই ঘরের মালিক।
-মালিক!হাসালে!
“পরের জায়গা পরের জমি ঘর বানাইয়া আমি রই
আমি তো সেই ঘরের মালিক নই” । -
সে গুন গুন করে গাইতে থাকে,
আমি প্রানভরে অনেকদিন পর তার কণ্ঠে
গান শুনতে থাকি ।
আস্তে আস্তে তার কণ্ঠ ক্ষীন হয়ে আসে,
অনেক দূর থেকে তার কণ্ঠ শোনা যেতে থাকে,
তারপর ক্ষীন থেকে ক্ষীনতর হতে হতে
একসময় একদম থেমে যায়।
শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ পেতে থাকি,
একসময় তাও ক্ষীন থেকে ক্ষীনতর
হতে হতে থেমে যায়।
আমি অনেকক্ষন দরজায় ঠকঠক করি
নাম ধরে ডাকি “ভীরু মেয়ে, দরজা খোল
প্রেম আমার,দরজা খোল,
ওহে ভীরু মেয়ে,আর ভয় পেয় না আমাকে
আমি মিছিলের সেই গুলিবিদ্ধ মৃত ছেলেটা!
তুমি যার দীর্ঘশ্বাসও চিনতে
দরজা খোল!দরজা খোল!দরজা খোল!”
আমার মনের ঘরের ভেতর থেকে কেউ সারা দেয় না
আমি অস্থির হয়ে পড়ি,
নিজের চিত্তের দরজা নিজেই ভেঙে ফেলি ।
যা দেখি তা আমি বিশ্বাস করতে পারি না
হৃদয় বিস্ফো্রিত হয়,
চোখ ঝাপসা হয়ে আসে,
স্মৃতির মরিচ লেগে তীব্র জ্বালা করে ।
ফ্যান থেকে ঝুলে আছে,
তার ধবধবে শাদা দুটি পায়ে সদ্য রাঙা আলতা
বেণীতে বেলীফুলের মালা থেকে এখনো,
তাজা ফুলের ঘ্রাণ দমকে বেরুচ্ছে ।
আমি ভীতু মেয়েটিকে বুকবেঁধে নামিয়ে
বিছানায় শুইয়ে দেই ।
কপালে টকটকে সবুজ রঙের টিপ,
ঠোঁটে তীক্ষ্ন মেধার,তীব্র সাহসের মাধবী জ্যোতির
মুচকি হাসির রেখা লেগে আছে ।
কে বলবে এই মেয়েটা ভূতের ভয় পেত?
কে বলবে এই মেয়েটা তেলাপোকা দেখলে শিউরে উঠত?
কে বলবে রক্ত দেখে এই মেয়েটা জ্ঞান হারিয়েছিল?
কে বলবে হুতোম পেঁচার ডাক শুনে,
এ মেয়ে তিনমাস ঘর থেকে একা বেরুতে পারেনি?
ভীতু মেয়েরাও মাঝে মাঝে কি সাহসী যে হয়!
অথবা সাহস ভীতু মেয়ের আবরন ছেড়ে
মাঝে মাঝে বের হয়ে আসে ।
তার হাতের মুষ্ঠিতে শক্ত করে ধরা একটা কাগজের টুকরা,
এ কি মৃত্যুর আগে তার শেষ চিঠি?
আমি হাতে নিয়ে ভালো করে দেখি,অবাক হয়ে যাই,
আমি জনৈক কবির একটা কবিতা তাকে দিয়েছিলাম
বহু আগে; বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে পড়ার সময়,
আমরা দুজনে ঠিক ওভাবেই যেন একে অপরকে চিনেছিলাম,
হেসেছিলাম,ছুঁয়েছিলাম, ভালবেসেছিলাম ।
সেই কবিতা লেখা কাগজটা হাতে ধরে সে পড়ে আছে
আমি অশ্রুসিক্ত ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে পড়তে থাকি-
“তুমি এতো দৌড়াচ্ছ কেন? লাল ফিতা উড়িয়ে
ডালিম তলা পেরিয়ে, তুলসীর পথ মাড়িয়ে
একেবারে অন্দরে! তুমি এতো দৌড়াচ্ছ কেন
ভীতু মেয়ে, তোমার কপালের টিপ্ চিমটিতে
উঠিয়ে তো নিচ্ছিনে, বলছিযে শোন,
সুফিয়া লজের খালাম্মারা কই জানো?
বাগানে কেলিতে ছিলে রজনীগন্ধার সাথে
আনমনে বিলি কেটে চলেছিলে ভাবনার ।
পাশ কেটে যেতেই তোমার মৌচাক নাড়া খেয়ে গেল?
বড় বেশি লাজুক তোমার মৌমাছিগুলো।
ওদের ডাকোরে মেয়ে
আমি রিক্সা ঘুরিয়ে রওয়ানা দিচ্ছি পথে,
আর যদি আমায় ক্ষণিকের মুগ্ধ কুসুম ভাব
তাহলে তোমার মৌমাছিদের পাঠিয়ে দিও আমার বাগানে”।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।