জাতিসংঘ ফোরামে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির সর্বজনীন পরিবীক্ষণে বিভিন্ন দেশ যেসব পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ উত্থাপন করেছে, তার মধ্যে রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর কয়েকটি বিষয় আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সরকার আরও সময় চেয়েছে। এ ছাড়া দুটি বিষয়ে বাংলাদেশ সম্মতি দেয়নি।
জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থায় গত ২৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সর্বজনীন পরিবীক্ষণ বা ইউপিআর সভায় ৯৮টি দেশ মোট ১৯৬টি সুপারিশ পেশ করে। এগুলোর সংকলিত প্রতিবেদন গতকাল সংস্থার অধিবেশনে অনুমোদিত হয়।
জেনেভায় জাতিসংঘ দপ্তরে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে এসব সুপারিশ-সংবলিত ইউপিআর প্রতিবেদনটি অনুমোদিত হওয়ার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বলেছেন, এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ কোনো চেষ্টা বাদ রাখবে না।
যেসব দেশ সমালোচনার সুরে বাংলাদেশকে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে আরও অনেক করণীয় রয়েছে বলে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, তিনি তাদের সে জন্য ধন্যবাদ জানান। আর যারা প্রশংসা করেছে বা উৎসাহব্যঞ্জক মতামত দিয়েছে, তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, তাদের মন্তব্যে বাংলাদেশের প্রয়াস আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে।
বাংলাদেশ ২৬টি সুপারিশ পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সময় চেয়েছে, যেগুলোর প্রায় সবই রাজনৈতিক বিবেচনায় স্পর্শকাতর। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নির্যাতনবিরোধী সনদের ঐচ্ছিক অংশে স্বাক্ষর, সব ধরনের বৈষম্যের অবসান ঘটানোর সনদ, গুম বা এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স থেকে সব নাগরিককে সুরক্ষা দেওয়ার সনদ, উপজাতি ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার এবং তাদের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ বিষয়ে আইএলওর একাধিক সনদে স্বাক্ষর, নারীর বিরুদ্ধে সব ধরনের বৈষম্যের অবসান, অভিবাসী শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারের অধিকার সুরক্ষার মতো বিষয়গুলো।
রোম স্ট্যাটিউট নামে পরিচিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে ওই সনদ ও তার বিধিমালার সঙ্গে সংগতি আনার লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে আইন সংস্কারের সুপারিশটিও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সময় চেয়েছে সরকার।
এ রকম আরেকটি সুপারিশ, যেটিতে সরকার সম্মতি না দিয়ে সময় চেয়েছে, সেটি হলো গুম ও বিনা বিচারে হত্যার অভিযোগগুলোর বিষয়ে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুইজারল্যান্ডের উত্থাপিত সুপারিশ। তবে এ বিষয়ে যুক্তরাজ্য ও আয়ারল্যান্ডের প্রস্তাবে বাংলাদেশ সম্মত হয়েছে। এতে বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগগুলো বিশদ ও পক্ষপাতহীনভাবে তদন্তের সুপারিশ করা হয়।
তৈরি পোশাকশিল্প ও হস্তশিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের সর্বোচ্চ আইনগত ও পেশাগত সুরক্ষা দেওয়ার প্রস্তাবেও সরকার সম্মতি না দিয়ে সময় চেয়েছে।
যেসব বিষয় আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সরকার সময় চেয়েছে, সেসব বিষয়ে আগামী সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের যে সভা হবে, সেই সভার আগেই বাংলাদেশকে তার অবস্থান জানাতে হবে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞদের সবাইকে উন্মুক্ত আমন্ত্রণ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং বিনা বিচারে হত্যাবিষয়ক স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ারদের দ্রুত সফরের ব্যবস্থা করাসহ বিষয়ভিত্তিক সব বিশেষজ্ঞকে উন্মুক্ত আমন্ত্রণ জানানোর সুপারিশও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সময় চেয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ প্রথমে পাঁচটি প্রস্তাবে সম্মতি না দিলেও প্রতিবেদনের ওপর ভোট গ্রহণের প্রাক্কালে দুটি বাদে অন্যগুলো প্রত্যাহার করে নেয়। যে দুটি বিষয় বাংলাদেশ মেনে নেয়নি, সেগুলো হলো প্রধানত মৃত্যুদণ্ড বিলোপ করা এবং তা বিলোপের আগ পর্যন্ত সব ফাঁসি বন্ধ রাখা এবং অপরটি সমকামিতাকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা না করা। মৃত্যুদণ্ডের বিষয়ে সুপারিশ আসে অন্তত এক ডজন রাষ্ট্রের কাছ থেকে।
সরকার যেসব সুপারিশ বা পরামর্শ মেনে নিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে আছে বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, ন্যায়পাল নিয়োগ করা, নির্যাতনবিরোধী সনদের সঙ্গে সংগতি আনতে দেশীয় আইনের সংস্কার, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার এবং তাদের সুরক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে ওঠা নির্যাতনের তদন্ত, সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারীদের বিচার করা এবং তাঁদের নিরাপদে পেশাগত দায়িত্ব পালনের পরিবেশ নিশ্চিত করা, স্থানীয় বা জাতীয় পর্যায়ে মানবাধিকারকর্মীদের হয়রানি, হুমকি ও প্রতিবন্ধকতার অবসান, বেসামরিক নাগরিকদের হয়রানি ও নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে যাদের বিরুদ্ধে, তাদের দায়মুক্তির অবসান ঘটিয়ে বিচারের ব্যবস্থা করার বিষয়।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রশ্নে চেক প্রজাতন্ত্র ও স্পেনের যে সুপারিশে সরকার সম্মতি দিয়েছে, তাতে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য অভিযুক্তরা যাতে ন্যায়বিচার পান, তার ব্যবস্থা করা এবং অভিযুক্তের সব অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
সাভারের ভবনধস এবং সাম্প্রতিক আরও কিছু দুর্ঘটনার পটভূমিতে গুরুত্বপূর্ণ শ্রম অধিকার ও পেশাগত সুরক্ষাবিষয়ক যেসব সুপারিশে সরকার সম্মতি দিয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে শ্রম আইনের লঙ্ঘন রোধে শিল্পকারখানায় কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা, শিল্পকারখানায় প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যঝুঁকির বিপরীতে শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষা প্রসঙ্গ।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে দুটি রাষ্ট্রের একই ধরনের সুপারিশও সরকার মেনে নিয়েছে, যাতে মূলত পার্বত্য চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নের আহ্বান জানানো হয়েছে।
জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থার আয়োজনে বিশ্বের সব দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর নিয়মিত বিরতিতে পর্যালোচনার এই প্রক্রিয়া (ইউপিআর) শুরু হয় ২০০৯ সালে। এতে বাংলাদেশের সরকারি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি।
এবার ঢাকা থেকে তাঁর সফরসঙ্গী হন একজন বৌদ্ধ ধর্মগুরু, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এবং বেশ কিছু সরকারি কর্মকর্তা। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।