১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে কারাগারে আটক জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির এ কে এম ইউসুফ মারা গেছেন। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয় বলে নিশ্চিত করেন হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুল মজিদ ভূইয়া। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে ইউসুফের মরদেহ কাশিমপুর কারাগারের ডেপুটি জেলার আবিদ আহমেদ মরহুমের ছেলে এ কে এম মাহবুবুর রহমানের কাছে হস্তান্তর করেন। এ জামায়াত নেতার বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিচার শেষ পর্যায়ে ছিল।
কাশিমপুর-১ কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার জামিল আহমদ চৌধুরী জানান, এ কে এম ইউসুফ সকালে সুস্থ অবস্থায় নাশতাও খেয়েছিলেন। নাশতা খাওয়ার প্রায় আধা ঘণ্টা পর মাথা ঘুরিয়ে তিনি মেঝেতে পড়ে যান। এ খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কারাগারের চিকিৎসক নিয়ে যাওয়া হয় তাকে চেকআপ করানোর জন্য। চিকিৎসকের পরামর্শক্রমেই তাকে তাৎক্ষণিক ঢাকায় বিএসএমএমইউতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তবে দীর্ঘদিন ধরে তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন।
তার বুকে পেসমেকার বসানো ছিল।
তিনি আরও জানান, ইউসুফের অসুস্থতার বিষয়টি তাৎক্ষণিক তার পরিবারের সদস্যদের অবহিত করা হয়। বার্ধক্যজনিত কারণে মাঝে মাঝেই তিনি অসুস্থ থাকতেন। আদালতের নির্দেশক্রমে তাকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দিয়ে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হতো। এর বাইরেও তার মেয়ের জামাই ডাক্তার হওয়ায় তিনি নিজেও চিকিৎসায় সম্পৃক্ত ছিলেন।
বিএসএমএমইউ হাসপাতালের পরিচালক আবদুল মজিদ ভূইয়া জানান, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ইউসুফকে বিএসএমএমইউ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। গুরুতর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। তার 'ব্লাড প্রেসার ও পালস' (রক্তচাপ ও স্পন্দন) পাওয়া যাচ্ছিল না। হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের সিসিইউতে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়।
এর আগে গতকাল দুপুর ১২টার দিকে ইউসুফের জামাতা মেজর (অব.) ডা. আবদুল ওহাব দাবি করেন, একজন রোগী হিসেবে এ কে এম ইউসুফের যে ধরনের চিকিৎসা পাওয়ার কথা ছিল, তা তিনি পাননি।
মরদেহের ময়নাতদন্ত যেন করা না হয় এ মর্মে নির্দেশ চেয়ে ট্রাইব্যুনালে আবেদন করেন তারা। এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের নির্দেশ আসার পর এবং বিদেশে থাকা তার পাঁচ ছেলেমেয়ে দেশে ফেরার পর দাফনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। ইউসুফ আলীর আট সন্তানের মধ্যে দুই ছেলে ও এক মেয়ে আমেরিকা এবং দুই মেয়ে দুবাই থাকেন। এদিকে ইউসুফের পরিবারের পক্ষ থেকে লাশ ময়নাতদন্ত না করতে ট্রাইব্যুনালে আবেদন করা হলেও ট্রাইব্যুনাল তা নাকচ করে দেওয়ার পর ময়নাতদন্তের জন্য বিকাল ৪টা ৪০ মিনিটে মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়।
ঢামেক হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. একেএম শফিউজ্জামান ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেন।
তিনি সাংবাদিকদের জানান, মস্তিষ্কে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জন্য তার মৃত্যু হয়েছে এবং ভিসেরা পরীক্ষা করার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।
এদিকে ময়নাতদন্ত শেষে সন্ধ্যা সোয়া ৭টায় মরদেহ ধানমন্ডির ৯/এ গোলাপ ভিলায় নিয়ে যাওয়া হয়। ধানমন্ডিতে জানাজা শেষে রাতে লাশ বারডেম হাসপাতালের হিমাগারে রাখা হয়।
ইউসুফের আইনজীবী তাজুল ইসলাম অভিযোগ করেন, 'তার (ইউসুফ) শারীরিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় আমরা অনেকবার ট্রাইব্যুনালে জামিন চেয়েছিলাম। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল জামিন না দিলেও আল্লাহ তাকে জামিন দিয়ে দিয়েছেন।
' তিনি অভিযোগ করেন, জরুরি বিভাগের চিকিৎসকরা তাকে সিসিইউতে স্থানান্তর করার কথা বললেও সিসিইউ থেকে বলা হয়, সেখানে সিট নেই।
তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেন হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুল মজিদ ভূইয়া।
এদিকে প্রসিকিউশনের তথ্যমতে, মুক্তিযুদ্ধকালে ইউসুফ প্রায় ৭০০ জনকে হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার বিরুদ্ধে ৩০০ বাড়ি ও ৪০০ দোকান লুটের পর অগি্নসংযোগ এবং ২০০ হিন্দুকে ধর্মান্তর করার অভিযোগও রয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা বিচারাধীন থাকা অবস্থায় কোনো অভিযুক্তের মৃত্যুর ঘটনা এই প্রথম।
পূর্বের আদেশ অনুযায়ী, বিচারিক ওই আদালতে আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি ইউসুফের বিরুদ্ধে মামলায় প্রসিকিউশনের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের কথা রয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ছাত্রজীবনে জমিয়তে তলাবা-ই-আরাবিয়ার সদস্য ছিলেন এ কে এম ইউসুফ। তার গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার রাজৈরে। ১৯৫২ সালে তিনি জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেন এবং ১৯৫৭ সালে দলের খুলনা বিভাগীয় প্রধান হন। জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন ১৯৬২ সালে।
১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ছিলেন তিনি। প্রসিকিউশনের অভিযোগ অনুসারে, ইউসুফ একাত্তরে বৃহত্তর খুলনার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন এবং তখনকার খুলনা মহকুমা, থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে শান্তি কমিটি ও সশস্ত্র রাজাকার বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। রাজাকার বাহিনীর নামটিও দেন তিনি। একাত্তরে ৯৬ জন জামায়াত সদস্য ও স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে খুলনার আনসার ও ভিডিপি ক্যাম্পে প্রথম সশস্ত্র রাজাকার বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন ইউসুফ। মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশে পাকিস্তানিদের গঠন করা কথিত মালেক সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য ইউসুফ এক সময় জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমিরের দায়িত্বও পালন করেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দালাল আইনে ইউসুফের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলেও আইনটি বাতিল হলে তিনি ছাড়া পান।
ইউসুফের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ : ২০১৩ সালের ১ আগস্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ ইউসুফের বিচার শুরু হয়। তার বিরুদ্ধে ১৩টি অভিযোগ গঠন করা হয় এ দিন। এর আগে একই বছরের ১২ মে প্রসিকিউশনের অভিযোগ আমলে নিয়ে ইউসুফের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। ওই দিনই গ্রেফতার করা হয় তাকে।
ইউসুফের বিরুদ্ধে আনা প্রথম অভিযোগ, ১৯১৭ সালের ১৭ মে বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ বাজারে তার নির্দেশে রাজাকাররা স্বাধীনতাকামী ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ৪০০ দোকান এবং ২০-২২টি বাড়িতে লুট করে আগুন ধরিয়ে দেয়। দ্বিতীয় অভিযোগ, ইউসুফের নির্দেশে ১৩ মে রজব আলী ফকিরের নেতৃত্বে ৫০-৬০ জন সশস্ত্র রাজাকার বাগেরহাটের হিন্দু অধ্যুষিত রণজিৎপুর গ্রামে হামলা চালিয়ে ৫০-৬০ জনকে হত্যা করে। তৃতীয় অভিযোগ, ১৯ মে রাতে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে ইউসুফ মোরেলগঞ্জ বাজারে গিয়ে রাজাকারদের ২০-২৫ জনের একটি দল সঙ্গে নিয়ে মিলিত অভিযান চালান। ওই সময় ছয়জন হিন্দুকে আটক ও নির্যাতনের পর একে একে গুলি করা হয়। চারজন মারা যান, দুজন বেঁচে ভারতে চলে যান।
চতুর্থ অভিযোগ, ২১ মে ইউসুফের নির্দেশে ৪০-৫০ জনের সশস্ত্র রাজাকার দল দুটি নৌকায় করে ডাকরা গ্রামে গিয়ে হিন্দুদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি চালালে দু-তিন ঘণ্টায় ৬০০-৭০০ নিহত হন। পঞ্চম অভিযোগ, ইউসুফের পরামর্শ ও প্ররোচনায় ১৪ অক্টোবর রাজাকার রজব আলী ১০০-১৫০ সশস্ত্র রাজাকার নিয়ে বাগেরহাটের চুলকাঠি বাজার ও আশপাশের হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে হামলা চালিয়ে ছয়জন হিন্দু ও একজন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে এবং ৪২টি বাড়িতে লুট ও অগি্নসংযোগ করে। ষষ্ঠ অভিযোগ, ১৫ অক্টোবর ইউসুফের নির্দেশে ৪০-৪৫ জন সশস্ত্র রাজাকার বাগেরহাটের কচুয়া থানার ভাষারবাজার গ্রামে ১৫ জন নিরস্ত্র হিন্দুকে হত্যা করে।
সপ্তম অভিযোগ, ৫ নভেম্বর ইউসুফের নির্দেশে ও প্ররোচনায় ৫০-৬০ জন রাজাকারের একটি সশস্ত্র দল বাগেরহাটের কচুয়া থানার শাঁখারীকাঠিতে হামলা চালিয়ে ৪০ জন নিরস্ত্র হিন্দুকে গুলি করে হত্যা করে। অষ্টম অভিযোগ, জুলাই মাসের মাঝামাঝি ইউসুফের নির্দেশ ও প্ররোচনায় শাঁখারীকাঠির হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় ৪৫ হিন্দুকে গরুর মাংস খাইয়ে, কলেমা পড়িয়ে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়।
৫ নভেম্বর ওই ধর্মান্তরিত হিন্দুদের প্রথম ৪০ জনকে হত্যা করা হয়। নবম অভিযাগ, ১২ মে গভীর রাতে ইউসুফের নির্দেশ, পরামর্শ ও প্ররোচনায় ২০-২২ জনের সশস্ত্র রাজাকারের দল মোরেলগঞ্জ বাজারের বারুইখালী ইউনিয়নে যায়। ওই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে রাজাকারদের যুদ্ধ হয়। পরদিন ইউসুফসহ পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল সামরিক গানবোটে ওই স্থানে গিয়ে রাজাকারদের সাহায্য করলে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন। ওই মুক্তিযোদ্ধাদের একজন আবুবক্কর সিদ্দিক স্থানীয় একটি বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করলে ইউসুফের উপস্থিতিতে ও নির্দেশে রাজাকাররা তাকে আটক করে বারুইখালী রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে হত্যা করে।
দশম অভিযোগ, ৭ জুন সকালে শরণখোলার রায়েন্দা বাজারে গিয়ে ইউসুফ বক্তৃতা দেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের ও হিন্দুদের নির্মূল করার নির্দেশ দেন। এরপর সশস্ত্র রাজাকাররা তিনজন মুক্তিযোদ্ধাকে নির্যাতনের পর হত্যা করে। ১১তম অভিযোগ, ৯ জুন বাগেরহাটের শরণখোলার তাফালবাড়ি বাজারে ইউসুফের নেতৃত্বে ২০-২৫ জনের সশস্ত্র রাজাকার মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল ফকির ও বাশারত খানকে আটক করে। পরে তাদের নির্যাতনের পর ইউসুফের নির্দেশে রাজেশ্বর নামক স্থানে নিয়ে গুলি করে হত্যার পর লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
১২তম অভিযোগ, ২৯ জুলাই ইউসুফের নির্দেশে রাজাকাররা মোরেলগঞ্জ বাজারের চিকিৎসক আবদুল মজিদকে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করায় মজিদকে হত্যা করা হয়। ১৩তম অভিযোগে বলা হয়েছে, ২৯ জুলাই রাজাকারদের নিয়ে রায়েন্দা বাজারে ইউসুফের বৈঠকের সময় রাজাকাররা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের আবদুস সালামকে ধরে ইউসুফের সামনে নিয়ে যায়। পরে ইউসুফের নির্দেশে সালামকে গুলি করে লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।