লেখকের অনুমতিক্রমে লেখাগুলো ব্লগে প্রকাশ করা হচ্ছে। লেখকের এফবি আইডি http://www.facebook.com/muhammad.toimoor
হাকিনী
মুহম্মদ আলমগীর তৈমূর ( https://m.facebook.com/muhammad.toimoor?refid=52 )
১
পয়সাঅলা বাঙালি পরিবারগুলোর ব্যাপারে একটি প্রবাদ আছে। সেটি হলো এদের প্রথম পুরুষ কেনারাম, দ্বিতীয় পুরু ষ ভোগারাম, আর তৃতীয় পুরুষ বেচারাম। সোজা কথায় প্রথম পুরুষ টাকা বানাতে, জমিজমা কিনতেই জীবন হারাম করে ফেলে। দ্বিতীয় পুরুষ শুধু বসে বসে খায় আর ঘোরে।
তৃতীয় পুরুষ সব বেচেকিনে শেষ করে। চতুর্থ পুরুষের বেলায় কী হয় তা অবশ্য বলা নেই। তবে সে যে বস্তিরাম হবে তা নিশ্চিত। আমাদের পরিবারে অবশ্য কেনারাম যে বেচারাম সেই-ই। এক পুরু ষেই সব উড়েপুড়ে শেষ।
আমার বাবার ছিল তেজারতির ব্যবসা, যাকে বলে সুদের কারবার। জমিজমা-গয়না বন্ধক রেখে চড়া সুদে টাকা ধার দেওয়াই ছিল তার কাজ। প্রথম দিকে বাবা ছিলেন খুলনা শহরের এক মাড়োয়ারির দোকানের হিসাব লেখক। ৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর সেই মাড়োয়ারি ব্যবসাপাতি গুটিয়ে ইন্ডিয়ায় চলে গেল। সেই সাথে গেল বাবার চাকরিও।
বেকার হয়ে পথে পথে ঘুরতে লাগলেন। একদিন দুপুরে চার আনার বাদাম কিনে হাদিস পার্কের এক বেঞ্চের ওপর বসে কীভাবে আগামী মাসের ঘরভাড়া দেবেন ভাবতে লাগলেন সেই কথা। বাবা ভাড়ার কথা যখন ভাবছেন এবং মাঝেমধ্যেই উদাস হয়ে পার্কের গেটের সামনে রাস্তার দিকে তাকাচ্ছেন তখন হঠাৎ তার চোখ পড়ল গেটের পাশে বটগাছের নিচে বসা এক জ্যোতিষীর ওপর। জ্যোতিষীর পাশে পার্কের রেলিংয়ে লাল সালুতে রুপালি রঙে লেখা :
জ্যোতিষ সাগর নেতাই নাথ
হাত দেখিয়া ভাগ্য গণনা করা হয়
দর্শনী ১২ আনা মাত্র।
মাঝবয়সী ঘোর সংসারী মানুষ অর্থকষ্টে পড়লে তার মাথার ঠিক থাকে না।
চার আনার বাদাম কেনার পর বাবার সম্বল তখন একুনে বারো আনা। তিনি জ্যোতিষ সাগরকে দিয়ে ভাগ্য গণনা করালেন। নেতাই নাথ বাবাকে বললেন, ব্যবসার লাইনে বৃহস্পতি তুঙ্গে। চাকরির ক্ষেত্রে শনির বলয়ে কেতুর আনাগোনা। আগামী পঁচিশ বছরে শনির বলয় ছেড়ে কেতুর অন্য কোথাও যাওয়ার সম্ভাবনা জিরো পার্সেন্ট।
জ্যোতিষ সাগরকে হাত দেখানোর আগে বারো আনাই অ্যাডভান্স করতে হয়েছে। বাবার দুবছরের পুরোনো রংজ্বলা ক্রিজভাঙা প্যান্টের পকেট তখন গ্যাস বেলুনের মতো হালকা। বাসায় শ'খানেক টাকা মা'র কাছে আছে। শেষ সম্বল। ব্যবসা কীভাবে হবে বুঝতে পারছেন না।
তিনি জ্যোতিষ সাগরকে জিজ্ঞেস করলেন, কিসের ব্যবসায় উন্নতির সম্ভাবনা। জ্যোতিষ তাঁকে তেজারতির ব্যবসা ধরতে বলল। সাফল্যের পরিমাণ শতভাগ। আগেই বলেছি, ছাপোষা মানুষ বিপদে পড়লে মাথার ঠিক থাকে না। বাবা চলে গেলেন ঘোরের ভেতর।
বাস করতে লাগলেন এক মানসিক কোমায়। বাসায় ফিরে মাকে বললেন,
'বিমলা, চাকরি তো অনেক দিন করলাম। এবার ভাবছি ব্যবসা-বাণিজ্য করব। '
মা বললেন, 'আচ্ছা, তা না হয় করবেন। কিন্তু আপনার পুঁজি কোথায়?'
'তোমার বড় ভাইয়ের তো বিরাট অবস্থা।
তার কাছ থেকে হাজার দশেক এনে দাও। এক বছরের ভেতর শোধ হয়ে যাবে। '
'আর যদি শোধ দিতে না পারেন, তখন?'
'না পারলে তোমার বাবার সম্পত্তির যে অংশ তুমি পাবে ওটা তার হবে। '
'ওইটুকুই তো সম্পত্তি। হাতের পাঁচ।
ওটা গেলে আর থাকল কী? পথে পথে ভিক্ষে করে খেতে হবে। '
'অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে পথে পথে ভিক্ষে তো মনে হয় কাল থেকেই করতে হবে। যা বলি মন দিয়ে শোনো। তোমার ভাইয়ের কাছ থেকে টাকাটা এনে দাও। মাড়োয়ারির দোকানটা এখনো খালিই আছে।
আপাতত ওখানেই বসা যাবে। নতুন মালিককে মাঝে মাঝে কিছু ভাড়া দিলেই হলো। '
২
সেই থেকে শুরু। দশ বছরে বাবা প্রায় ত্রিশ লাখ টাকার মালিক হয়ে গেলেন। সুদের কারবারে সাধারণত যা হয়।
আসল শোধ দিতে পারলেও সুদ থাকে। যদি সুদ শোধ হয় তো আসল থাকে। এগোলেও নির্বংশের ব্যাটা, পেছালেও নির্বংশের ব্যাটা। খাতকদের কাউকেই ছ'মাসের বেশি সময় বাবা দিতেন না। এর ভেতর আসলসহ সুদের টাকা শোধ না হলে বন্ধকী সম্পত্তি কিংবা গয়না বাজেয়াপ্ত হতো।
নিয়মানুযায়ী সুদসহ আসল কেটে রেখে সম্পত্তি বা গয়না বিক্রির উদ্বৃত্ত টাকা খাতককে দেওয়ার কথা। বাবা দিতেন না। বিশেষ করে, অসহায় বিধবা, এতিম অথবা অন্য জেলার লোকদের বেলায়। তার পোষা কিছু গুন্ডাপান্ডা ছিল। কেউ প্রতিবাদ করতে এলে তাদেরকে এরা ভাগিয়ে দিত।
৩
বাবা যখন বেশ জাঁকিয়ে বসেছেন, দুটি বাড়ি কেনার পর তিন নম্বর বাড়ির বায়না করবেন বিপদ ঘটল ঠিক তখন। পৌষ মাসের এক মেঘলা দিনে সন্ধেবেলা অশীতিপর এক বৃদ্ধা রিকশা থেকে তার দোকানের সামনে নামল। মহিলা কালীঘাটে পুরোনো এক বাড়িতে থাকে। দুটো বালা বন্ধক রেখে টাকা ধার করতে চায়। বালা দুটো হাতে নিয়ে খুব ভালো করে পরীক্ষা করলেন বাবা।
পুরোনো জিনিস। আদ্যিকালের ডিজাইন। তবে জিনিস ভারী। দুটোতে কম করে হলেও পাঁচ ভরি সোনা আছে। বর্তমান বাজারদরে ওগুলোর দাম সাড়ে তিন হাজার টাকা হওয়ার কথা।
বাবা বললেন,
'ওগুলো রেখে পাঁচশো টাকা নিয়ে যান। ছ'মাসের ভেতর সাতশো পঞ্চাশ টাকা দিয়ে বালা ফেরত নিয়ে যাবেন। দেনা পরিশোধ করতে না পারলে মাল বাজেয়াপ্ত হবে। '
বুড়ি কাগজে টিপ সই দিয়ে টাকা, রশিদ নিয়ে কালীঘাটে ফিরে গেল। ছ'মাস পার হলো।
বুড়ির দেখা নেই। বাবা বালা দুটো বাসায় এনে তার শোবার ঘরে সিন্দুকে রেখে দিলেন। তখন ১৯৭৫ সাল। রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়েছে। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল জিয়া জাতীয় গণতান্ত্রিক দল বা জাগ দল নামে নতুন দল গঠন করেছেন।
সেই দলের উঠতি নেতাদের সাংঘাতিক দাপট। এইরকম এক নেতা যার নাম মোটা মোসলেম বাবাকে বলল দোকান ছেড়ে দেওয়ার জন্য। মাড়োয়ারির ওই দোকান অর্পিত সম্পত্তি। ভেস্টেড প্রপার্টি। সরকারের কাছ থেকে নিরানব্বই বছরের লিজ নিয়েছে সে।
কাগজপত্র আপটুডেট। বাবা বললেন, দোকান তার দখলে। আগের মালিকের কাছ থেকে তিনি কিনে নিয়েছেন। কাগজপত্র তারও আছে। বাবা যেমন বুনো ওল নেতাও তেমন বাঘা তেঁতুল।
গন্ডগোল চরমে উঠল। নেতা বুঝল হুমকি-ধামকিতে কাজ হবে না। সে ধরল অন্য রাস্তা। থানার ওসিকে হাত করে দুটো মার্ডার কেসে বাবার নাম ঢুকিয়ে দিল। এর একটিতে তার পোষা গুন্ডাপান্ডার একজনকে বানাল রাজসাক্ষী।
ভালো রকমের জটিল মামলা। টুটপাড়ার এক হিন্দু বিধবার নাতি খুন হয়েছিল। পুরোপুরি বখে যাওয়া এই নাতির বাবা-মা থাকত কলকাতায়। বিরাট বাড়িতে দিদিমা একা। কলকাতার ছোট্ট খুপরি বাসায় দাদিমার দম বন্ধ হয়ে আসে।
নাতির কাজ কলেজে পড়াশুনো করা, দিদিমাকে দেখে রাখা। এই দুটোর কোনোটাতেই তার আগ্রহ ছিল না। তার সব আগ্রহ জুয়া, মদ, বাজে মেয়েমানুষে। দাদির গয়নাপাতি বন্ধক রেখে বাবার কাছ থেকে প্রায়ই টাকা ধার নিত নাতি। কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখা গেল, প্রায় বিশ হাজার টাকার গয়না বন্ধক রেখে বাবা তাকে দিয়েছেন মাত্র দুহাজার।
খুনের মোটিভ 'পরিষ্কার'।
বাবার ঠাঁই হলো জেলহাজতে। কেস চলল মাসের পর মাস। থানা, পুলিশ, কোর্ট-কাছারি, উকিল-মোক্তার করতে গিয়ে টাকা খরচ হতে লাগল হু হু করে। সুদখোরকে কেউ পছন্দ করে না।
আমরা কারও সহানুভূতি পেলাম না। যেখানে পাঁচশোতে কাজ হওয়ার কথা, সেখানে দিতে হয় হাজার টাকা। ক্যাশ যা ছিল গেল। এরপর গেল জমিজমা, বাড়িঘর। বাবা হাজত থেকে আর বেরোতে পারলেন না।
সাজানো মামলায় ফাঁকফোকর কম। উকিল সাহেব প্রথম প্রথম বলতেন, আগামী হেয়ারিংয়েই বেইল হবে। এখন কিছুই বলেন না। একদিন চেম্বারে অপেক্ষা করছি। উকিল সাহেব কোথায় যেন গেছেন।
তার মুহুরি আস্তে করে বলল,
'মনে হয় কনভিকশন হয়ে যাবে। '
এদিকে সংসার চালানো দায় হয়ে পড়েছে। একদিন সকালে বসে ডায়েরি লিখছি, শোবার ঘরের সিন্দুক খুলে সেই পুরোনো বালা দুটো বের করে মা বললেন,
'দেখ তো সঞ্জয়, এগুলো বেচা যায় কি না?'
৪
খুলনার সবচেয়ে বড় সোনার দোকান অমিয় জুয়েলার্স। মন্ময় চৌধুরী দোকানের মালিক। বিরাট ধনী লোক।
কারও সাথে মেশেন না। দোকানের কাউন্টারে বালা দুটো রেখে সেলসম্যানকে বললাম, এগুলো আমি বেচতে চাই। সেলসম্যান প্রথমে খুঁটিয়ে দেখল। কষ্টিপাথরে ঘসে সোনার মান যাচাই করল। সবশেষে নিল ওজন।
তারপর বলল,
'এ দুটোতে পাঁচ ভরি সোনা আছে। অনেক টাকার ব্যাপার। মালিককে দেখাতে হবে। '
'ঠিক আছে, দেখান আপনার মালিককে। '
ভেতরে চলে গেল সেলসম্যান।
পাঁচ মিনিট পর ঘুরে এসে বলল,
'আপনাকে আমরা এ দুটোর জন্য পাঁচ হাজার পর্যন্ত দিতে রাজি আছি। দোকানে এত ক্যাশ নেই। সাহেব বলেছেন, এখন আড়াই হাজার দিতে। বাকিটা সন্ধ্যার পর আসলে পাবেন। কী করবেন দেখেন?'
সত্যি বলতে কী তিন হাজারের বেশি আমি আশাই করিনি।
সেই তুলনায় পাঁচ হাজার অনেক বেশি। বললাম,
'ঠিক আছে, সন্ধের পর এসে বাকিটা নিয়ে যাব। একটা রশিদ লিখে দেন। '
সন্ধের পর আবার গেলাম অমিয় জুয়েলার্সে। আগের সেলসম্যান কাস্টমার নিয়ে ব্যস্ত।
বুড়োমতো একজন এগিয়ে এল। বলল,
'আমি দোকানের ম্যানেজার। সাহেব আপনার সাথে দুমিনিট কথা বলতে চান। টাকাটা উনিই আপনাকে দেবেন। আমার সাথে একটু ভেতরে আসেন।
'
কাউন্টার পার হয়ে শোকেসের পাশে সরু দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। বিরাট হলঘরের মতো কামরায় আবছা অন্ধকারে স্যাঁকরার দল লাইন দিয়ে বসে কাজ করছে। নাইট্রিক এসিডের ঝাঁঝালো গন্ধে দম বন্ধ হয়ে এল। লোকগুলো বছরের পর বছর এই পরিবেশে কাজ করছে কী করে? পেতলের সরু পাইপ মুখে লাগিয়ে গয়নার গায়ে অনবরত ফুঁ দিচ্ছে তারা। গাল ফুলে উঠেছে শ্রাবণ মাসের কোলা ব্যাঙের মতো।
ফুসফুস এত চাপ সহ্য করে কীভাবে! হলঘর পেরিয়ে লাল কার্পেট মোড়া ছোট একটি প্যাসেজের মাথায় কাচ লাগানো সেগুন কাঠের দরজা। নক করে ম্যানেজার আমাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল।
প্রকাণ্ড জানালাঅলা ঝকঝকে কামরা। দেয়ালের একদিকে রেমিংটন কোম্পানির ইয়া বড় সিন্দুক। এই জগদ্দল পাথরের মতো ভারী বস্তু দোতলায় যে কারিগর উঠিয়েছে, তাকে অভিনন্দন।
অন্য দেয়ালের পুরোটা জুড়ে বইভর্তি কাচের শোকেস। মন্ময় চৌধুরী আমার দিকে তাকালেন। মনে পড়ল রবীন্দ্রনাথের 'কিনু গোয়ালার গলি' কবিতার কথা। 'যত্নে পাট করা লম্বা চুল। বড়বড় চোখ।
শৌখিন মেজাজ। কর্নেট বাজানো তার শখ। ' পার্থক্য শুধু এই যে ইনার চুলগুলো ধবধবে সাদা। ছড়িয়ে আছে ঘাড়ের ওপর। ইস্ত্রি করা ফিনফিনে পাজামা-পাঞ্জাবি পরা।
তবে ইনি যন্ত্র শিল্পী কি না বুঝতে পারছি না। ধারণা করেছিলাম, কালো মোটা ফতুয়া পরা ধূর্ত চেহারার কাউকে দেখতে পাব। মন্ময় চৌধুরী দেখতে রবীন্দ্রনাথের মতো। সাধক-টাইপ চেহারা। এই লোকের লেখালেখি করার কথা।
মাঝে মাঝে সভাসমিতিতে বক্তৃতা। কাগজে কাগজে ইন্টারভিউ। মনোযোগ দিয়ে পুরোনো আমলের একটি ক্যাটালগ দেখছেন মন্ময় চৌধুরী। ইশারায় বসতে বললেন।
'আপনি সঞ্জয় বাবু?' গভীর কালো চোখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন ম. চৌধুরী।
'আজ্ঞে, আমিই সঞ্জয়। '
'বালা দুটো পেলেন কোথায়?'
কোনো কিছু গোপন না করে তাঁকে সব ভেঙেচুরে বললাম।
'বুড়ির বাড়ির ঠিকানা কি আছে আপনার কাছে?'
'ছিল তো বটেই। তবে পুলিশ খাতাপত্র সব জব্দ করে মালখানায় রেখেছে। এখন আর সেটা পাব কীভাবে?'
'হুমম, বুঝতে পারছি।
একটা প্রশ্ন করি। কিছু মনে করবেন না তো?'
'সেটা বোঝা যাবে প্রশ্ন শোনার পর। কী প্রশ্ন? বুড়ির বাড়ি গিয়ে ভেরিফাই করতে চান, আমি সত্যি বলছি কি না এইতো? তার প্রয়োজন নেই। আমি সত্যি কথাই বলছি। মিথ্যে বললে আপনি ধরে ফেলতেন।
'
'ব্যাপারটা তা নয়। বুড়ির সাথে একটু কথা বলতে চাই আমি। বালা দুটো তার কাছে আসলা কীভাবে, সেইটে জানতে চাই। আপনি বলেছেন বুড়ি থাকে কালীঘাটে। এটাই বা জানলেন কীভাবে? খাতাপত্র মালখানায়।
বাবা জেলহাজতে। বালা দুটো হাতে পেয়েই আপনি আমার এখানে। '
'মার কাছ থেকে জেনেছি। দুপুরে ভাত খাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করেছিলাম। বাবা গয়নাপাতি বাসায় আনতেন খুব কম।
পুরোনো গয়না মাকে কখনো দেননি। নতুন বানিয়ে দিতেন। বালাগুলো একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। বাবাকে জিজ্ঞেস করে মা জানতে পারেন কালীঘাটের এক বুড়ির গয়না ওগুলো। আপনি যদি বুড়িকে খুঁজে বের করতে পারেন, তাহলে বলবেন।
কিছু টাকা তাকে ফিরিয়ে দিতে চাই আমি।
'আপনার কোনো ফোন নম্বর থাকলে আমাকে দিয়ে যান। খোঁজ পেলে জানাব। '
লক্ষ করলাম, কথা বলার পুরো সময়টাতেই ম্যানেজার ঠায় দাঁড়িয়ে। বুঝলাম, কর্মচারীরা মন্ময় চৌধুরীকে খুব সমীহ করে।
ভাবুক ধরনের এই মানুষটাকে এরা এত ভয় পায় কেন কে জানে?
৫
পরদিন কোর্টে বাবার হেয়ারিং ছিল। সাবজজ-১-এর কোর্টে কেস। বিশ-পঁচিশটা ফৌজদারি মামলার শুনানি হবে। কার কেস কখন উঠবে আগে থেকে বলার উপায় নেই। অফিস সকাল ন'টায় শুরু হলেও জজ সাহেব এগারোটার আগে এজলাসে ওঠেন না।
কেসের শুনানি চলে একটানা বিকেল চারটে অব্দি। এর ভেতর লাঞ্চ ব্রেক, নামাজের ওয়াক্ত এসব আছে। সকাল ন'টার ভেতরই জেল থেকে প্রিজনভ্যানে সব আসামি এনে পুলিশেরা কোর্ট-হাজতে রাখে। দশ টাকা, বিশ টাকা দিলে হাজতিকে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়াতে দেয় তারা। আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা হয়।
দর্শনার্থীদের ভেতর গ্রামের বৌ-ঝিরাই বেশি। কোলে-কাঁখে দু-তিনটা ছেলেমেয়ে। সিকনি গড়িয়ে পড়ছে বাচ্চাগুলোর নাক দিয়ে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে এর খানিকটা গালেও মেখেছে তারা। শুকিয়ে চড়চড় করছে গাল।
সব কটার পা খালি। এদের মায়েদের স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরা ধুলোভরা পা দেখে এত মন খারাপ হয়! একটা ছোট ছেলে তার হাজতি বাবাকে বলছে, 'আব্বা, আমাকে একটা পাউরু টি কিনে দেন না। ' শহরের মানুষের কাছে পাউরু টি কিছু না। গ্রামের মানুষের কাছে ওটা স্বপ্নের খাবার। আমাদের গাঁয়ের একটি খুব বুড়ো লোককে চিনতাম।
অনেক দিন থেকেই রোগে ভুগছিল। মরণ ঘনিয়ে এসেছে বুঝতে পেরে মেয়ে জিজ্ঞেস করল, 'আব্বা, কী খেতে মন চায়?' 'আমাকে একটা পাউরু টি খাওয়াতি পারবি?' জবাব দিলেন বাবা। গ্রাম থেকে রেলস্টেশন সাতাশ মাইল দূরে। পাউরু টি পাওয়া যায় শুধু সেখানেই। পায়ে হেঁটে একজন রওনা হলো পাউরু টি আনতে।
পরদিন বাসি পাউরু টি এসে যখন পৌঁছাল বুড়ো তখন পরপারে। একটা পাউরু টির দাম ষাট পয়সা। বাবার চোখ ছলছল করছে। তার কাছে এক টাকাও নেই।
আগেই বলেছি, কার কেস কখন উঠবে বলা যায় না।
এ হচ্ছে 'শেষ পুরোহিত কঙ্কালের পাশা খেলা। ' সাক্ষী-সাবুদ, আসামি সব বসে আছে সকাল থেকে। উকিলরা দু-তিনটা কোর্টে দৌড়াদৌড়ি করছে। আরিচা ঘাটে ফেরি-ধরা টেনশন। কোর্টে কেস উঠল।
সত্য-মিথ্যা সব সাক্ষী রেডি। আসামি হাজির। জজ সাহেব অপেক্ষা করছেন। উকিলের দেখা নেই। কিছুক্ষণ দেখে জজ সাহেব সে কেস বাদ দিয়ে আরেকটি ধরলেন।
নেঙ্ট হেয়ারিং ডেট তিন সপ্তাহ পরও পড়তে পারে, দু মাস পরও পড়তে পারে। আসামি আবারও প্রিজনভ্যানে। গন্তব্য কারার ঐ লৌহকপাট। কার গোয়ালে কে দেয় ধুঁয়ো। বাবার কেস ওঠা নিয়ে রাশিয়ান রু লেত খেলা চলে না।
পেশকারকে দুশো টাকা দিয়েছি। প্রথমেই যাতে বাবার কেসটা জজ সাহেবের হাতে ধরিয়ে দেয় সে। হেয়ারিং হলে আরও পঞ্চাশ। উকিলকে ধরে এনে বসিয়ে রেখেছি। তিনজন সাক্ষীকে একশো টাকা করে দিতে হয়েছে।
ভালো হোটেলে গোস্ত-পরটা খেয়েছে সকালে। কোর্টে এসে চা, পান, সিগারেট। মুহুরিকে বিশ টাকা দিয়ে হাজিরা জমা করে বসে আছি। ওপারের ডাক যদি আসে। দুহাত বুকের সমানে জড়ো করে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন বাবা।
হাতে বেড়ি, পায়ে বেড়ি, পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি। ক্ষুদিরামের খালু। তাকিয়ে আছেন জানালার বাইরে ড্রেনের ধারে কচুগাছের দিকে। মনের জানালা ধরে উঁকি দিয়ে গেছে! পয়সাঅলা মানুষদের চেহারায় যে তেলতেলে ভাব থাকে তার ছিটেফোঁটাও এখন নেই তার ভেতর। উকিল একবার উঠে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, 'ধন বাবু (বাবার নাম ধনঞ্জয়), ভালো তো?' বাবা পাত্তাও দিলেন না।
তার চোখে সক্রেটিসের উদাসীনতা। পাথরের বাটিতে কখন হেমলক পরিবেশন করা হবে তার অপেক্ষা।
বাবার কেস উঠল ঠিকই তবে হেয়ারিং হলো না। মোটা মোসলেম আসেনি। জাগ দলের জাতীয় সম্মেলনে যোগ দিতে ঢাকায় গেছে।
রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যস্ত। তার উকিল টাইম প্রেয়ার দিয়েছে। পরের হেয়ারিং ডেট পড়ল তিন সপ্তাহ পর। ছোট্ট টিফিন ক্যারিয়ারে বাবার জন্য ইলিশ মাছ ভাজি, লাউ দিয়ে রান্না মাস কলাইয়ের ডাল পাঠিয়েছিলেন মা। এক জেল পুলিশকে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে বললাম টিফিন ক্যারিয়ারটা বাবাকে দিতে।
পুলিশ বলল, 'জেলে গিয়া দিমুআনে। ' শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা পুলিশ আজও পেলাম না।
পরদিন দুপুরে খেয়ে খবরের কাগজ হাতে নিয়ে বিছানায় শুয়েছি। বাইরে শুরু হলো বৃষ্টি। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা।
মা ঘুম ভাঙিয়ে বললেন অমিয় জুয়েলার্স থেকে ফোন এসেছে। চৌধুরী সাহেব সন্ধের সময় দোকানে দেখা করতে বলেছেন। বুড়ির বাসার ঠিকানা পাওয়া গেছে।
৬
রিকশা করে আমাকে সাথে নিয়ে রওনা হলেন চৌধুরী বাবু। কালীঘাট এলাকায় আগে কখনো আসিনি আমি।
সরু রাস্তার দুপাশে পুরোনো সব টিনের বাড়ি। অনেকেই ধুনুচি জ্বালিয়ে সন্ধ্যা আরতি দিয়েছে। বাতাসে ধূপধুনোর গন্ধ ম ম করছে। সরু গলির মাথায় ছোট ছোট ইটে গাঁথা আদ্যিকালের বাড়ি। পলেস্তারা খসে ইট বের হয়ে সেই ইট পর্যন্ত ক্ষয়ে গেছে।
চারদিকে ভাঙাচোরা ইটের স্ত্মূপ। মানগাছ, কচুগাছের ঝোপ। এর মাঝে দুখানা মাত্র ঘর কোনোরকম টিকে আছে। ছোট জানালায় চটের পর্দা ঝুলছে। ভেতরে কুপি জ্বলছে বলে মনে হলো।
এ বাড়িতে কারেন্টের কারবার নেই। সামনেই সরু কাঠের দরজা। বারান্দা-সিঁড়ি এসবের কোনো বালাই নেই। কোনো কালে হয়তো ছিল। ঢোকার সরু দরজাটা পুরোনো ভাঙাচোরা হলেও এর জটিল নকশা দেখে বোঝা যায়, একসময় কত সুন্দর ছিল ওটা।
দরজার ওপরে শেকল, মাঝে দুটো কড়া। খুব জোরে কড়া নাড়লেন চৌধুরী সাহেব। বেশির ভাগ মানুষের ধারণা, বুড়োরা কানে কম শোনে। প্রায় সাথে সাথেই মাঝবয়সী শ্যামলা এক ভদ্রলোক দরজা খুললেন। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি, গলায় কাঠের মালা।
কামানো মাথার পেছনে ছোট একটা টিকি ঝুলছে। দেখেই বোঝা যায়, মন্দিরের পুরুত ঠাকুর। ভদ্রলোক বের হচ্ছিলেন বোধ হয়।
'আজ্ঞে, আপনারা?' কিছুটা অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলেন পুরুত।
'আমার নাম মন্ময় চৌধুরী।
অমিয় জুয়েলার্স থেকে আসছি। আমরা কাদম্বিনী দেবীর কাছে এসেছি। '
'আমি ওর নাতজামাই। তেনার শরীরটা খারাপ। কী দরকার জানা যাবে?'
'উনি কিছু টাকা পাবেন।
দেওয়ার জন্য এসেছি', বললাম আমি।
'আপনারা বসেন। দেখি কী করা যায়?'
ঘরের মেঝে স্যাঁতসেঁতে। নোনা ধরা দেয়াল। পায়া ভাঙা শাল কাঠের চকির ওপর পাটি বিছানো।
পুরু ধুলো জমে আছে ওপরে। কড়ি-বর্গা দেওয়া ছাদ থেকে আগের আমলের শেকলে বাঁধা ঝাড়লন্ঠন ঝুলছে। ঝুলকালিতে দেখতে হয়েছে কাকের বাসা। বুড়ি ওটাকে এত দিন বেচে দেয়নি কেন? যেভাবে লোহার শেকল দিয়ে বাঁধা তাতে নামানোর পারিশ্রমিক বিক্রীত মূল্যের চেয়ে বেশি হবে। ঝাড়লন্ঠন বিলুপ্ত না হওয়ার পেছনে ওটাই প্রধান কারণ।
'ঠাম্মা বাতের ব্যথায় খুব কষ্ট পাচ্ছেন। উনি উঠে আসতে পারবেন না। আপনাকেই ওর কাছে যেতে হবে। ' ফিরে এসে বলল পুরুত।
পুরুতের পেছন পেছন যে কামরায় এসে ঢুকলাম সেবা প্রকাশনীর বইয়ের ভাষায় সেখানে দারিদ্র্য 'মুখ ব্যাদান' করে আছে।
বিমূর্ত দারিদ্র্য এখানে মূর্ত। পভার্টি ইজ আ কার্স। অভিশাপ নয়, এখানে পভার্টির গজব নাজিল হয়েছে। জরাজীর্ণ ছোট এক খাটের ওপর চাঁদিছিলা জাজিম। তুলো নারকোলের ছোবড়া এত কালো হয়ে বেরিয়ে পড়েছে যে ওগুলো তেলতেলে হয়ে গেছে।
জাজিমের ওপর আঁশ ছেঁড়া শীতলপাটিতে শুয়ে আছে ফ্রানৎজ কাফকার 'দ্য হাঙ্গার আর্টিস্ট'। স্রেফ হাড়ের ওপর কোঁচকানো চামড়ার জীবন্ত বিভীষিকা। বুড়ির বয়সের গাছ-পাথর নেই। টি এস এলিয়টের 'দ্য ওয়েস্টল্যান্ড' কবিতার দ্য সিবিল অভ ক্যুমা। ঘরের সিলিংয়ের নিচে পলিথিন টাঙানো।
বৃষ্টি হলে ছাদ থেকে মনে হয় জল পড়ে। দেয়ালের এক কোণ ভেঙে ইট গেঁথে ড্রেনের মতো করা হয়েছে। বুড়ির বাথরুম। সেখানে এক বালতি পানিতে লাল রঙের প্লাস্টিকের মগ ভাসছে। খাটের পাশে চিলুঞ্চি।
কফ, থুতু চিলুঞ্চির ভেতরে যত, বাইরে তার শত গুণ। ঢাকা শহরের ডিআইটি ডাস্টবিন। মনে হলো, ঘরের ভেতরে ভেসে আছে 'অনাদি কালের বিরহ বেদনা। ' নাকে এসে লাগল গা গুলিয়ে ওঠা তীব্র আঁশটে গন্ধ। হাতল ভাঙা কাঠের চেয়ারে বসলেন মন্ময় চৌধুরী।
চেয়ার একটাই। পুরুত ঠাকুর বুড়ির মাজার কাছে বিছানায় বসেছে। আমি দাঁড়িয়ে।
'ঠাম্মা, উনার নাম মন্ময় চৌধুরী। আপনার সাথে আলাপ করতে চান।
' শুরু করল পুরুত।
ছানিপড়া চোখ তুলে মন্ময় চৌধুরীর দিকে তাকালেন বৃদ্ধা। কিছু দেখতে পেয়েছেন বলে মনে হলো না। পকেট থেকে বালা দুটো বের করে বুড়ির দিকে এগিয়ে দিলেন মন্ময়। বললেন,
'দেখুন তো এগুলো চিনতে পারেন কি না?'
বালা হাতে নিয়ে ছুঁয়ে দেখল বুড়ি।
তারপর রিনরিনে অথচ স্পষ্ট করে বলল,
'চিনতে পেরেছি, বাবা। সারা জীবন ওগুলো নাড়াচাড়া করেছি। এর প্রতিটি ঘাট আমার মুখস্থ। '
'ওগুলো কে দিয়েছিল আপনাকে?'
'কেউ দেয়নি। মায়ের কাছে ছিল।
মা মারা যাওয়ার আগে দিয়ে গেছেন। মায়ের দেওয়া জিনিস শত কষ্টের ভেতরও বাঁচিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো কোথায়?'
'আপনার মা ওগুলো পেলেন কোথায়, সে ব্যাপারে কিছু জানেন?'
'আমার বাবা তাকে দিয়েছিলেন। সে অনেক কাল আগের কথা, বাবা। তখন এই শহরে অনেক সাহেব ব্যবসায়ী ছিল।
এদের একজনের সাথে বাবার খাতির ছিল খুব। এই খুলনা শহরের নাম ছিল রোয়ালে বদেরপুর। রূপসা নদীর ধারে অনেক কাল আগের একটা মন্দির আছে। ওটা খুল্লনা দেবীর। ওর নাম থেকেই এই এলাকার নাম খুলনা।
বাবা ওই মন্দিরের সেবায়েত ছিলেন। পরে এই বাড়িতে চলে আসেন। এই বাড়িটা আগে থেকেই ছিল। এর মালিক ছিল নানাভাই ধূনজী। কলকাতার ব্যবসায়ী।
বিখ্যাত ধনী। আমার জন্ম এ বাড়িতেই। তখন আমাদের অবস্থা ভালো ছিল। মন্দিরে বাবা আর ফিরে যাননি। বাকি জীবন তন্ত্র সাধনা করে কাটিয়েছেন।
ওই সাহেব প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসতেন। দক্ষিণে আলাদা একটা ঘর ছিল। আমরা বলতাম কালীমন্দির। বাবার সাথে ওখানেই দেখা করতেন সাহেব। '
'সাহেবের নামটা বলতে পারবেন?' বুড়িকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন মন্ময়।
আসল প্রশ্নের উত্তরের ধারেকাছেও বুড়ি এখনো আসেনি। হাজার এক রজনী গল্পের ভূমিকা একে দিয়ে লেখালে ভালো হতো।
'উনাকে সবাই ঠাকরে সাহেব বলে ডাকত। লাল টকটকে চেহারা। সারা গায়ে ভালুকের মতো লোম।
খুব শক্তিমান পুরুষ। দেখলে ভয় হয়। এ বাড়িতে আসার কিছুদিন আগে বাবার ক্যাশ বাঙ্রে ভেতর মা ও দুটো দেখতে পান। ভীষণ অবাক হন ওগুলো দেখে। সোনার বালা নিজের কাছে কেন রাখবেন বাবা? গয়না আগলে বসে আছে এ-জাতীয় পুরু ষ বিরল।
বাবা ওই গোত্রের লোক ছিলেন না মোটেও। এ ছাড়া মা'র এ-ও মনে হলো, ওগুলো আগে কোথাও দেখেছেন। আগের দিনে অনেকেই মূল্যবান জিনিস, সোনাদানা, টাকাপয়সা মন্দিরে জমা রাখত। কেউ কেউ প্রতিমাকে অনেক কিছু দানও করত। মন্দিরে রাধা-কৃষ্ণের জোড় মূর্তির পেছনে ছোট্ট একটা ঘরে ওগুলো জমা করে রাখা হতো।
বছরে একবার বের করে হিসাব মেলানো হতো, ঝাড়পোঁছ করা হতো। এসব কাজে মাকেও সাহায্য করতে হয়েছে। সে সময়ই মা বালাগুলো দেখে থাকবেন। বাবাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলেন মা। বাবা বলেছিলেন, কয়েক দিনের জন্য বালাগুলো নিজের কাছে রেখেছেন।
বিশেষ দরকার। পরে ফিরিয়ে দেবেন। ফিরিয়ে আর দেননি। আষাঢ় মাসে অমাবস্যার এক রাতে কালীমন্দিরে সাধনায় বসেন বাবা। রাতে তার কাছে মন্দিরে যাওয়া মানা ছিল।
সকালে মা গিয়ে দেখেন বাবা মরে পড়ে আছেন। সবার ধারণা, সন্ন্যাস রোগে মারা গিয়েছিলেন বাবা। কিন্তু মা বলতেন, অপঘাতে মৃত্যু হয় তাঁর। '
'নানাভাই ধূনজীর সাথে কখনো দেখা হয়েছে আপনার?'
'ঠাকরে সাহেবের সাথে দু-একবার এখানে এসেছিলেন। বাবার সাথে মন্দিরে দেখা করতেন।
লম্বা চুল-দাড়িঅলা খুব মোটা লোক। ধবধবে ফরসা গায়ের রং। '
'আলাপ করে অনেক ভালো লাগল। আশা করি, শীঘ্রি ভালো হয়ে উঠবেন। '
'আমার আর ভালো-মন্দ, বাবা।
ভগবানের ডাক আসলে বাঁচি। যে অবস্থায় আছি তা মরারও অধম। '
আমি এগিয়ে গিয়ে বুড়ির একটি হাত ধরলাম। তাকে দুহাজার টাকা দিলাম। বুড়ি জিজ্ঞেস করল,
'টাকা কিসের জন্য, বাবা?'
'আপনার ওই বালা দুটো, যার সাথে এতক্ষণ কথা বললেন, তিনি কিনে নিয়েছেন।
আমার বাবার কাছে ওগুলো বন্ধক রেখেছিলেন, মনে আছে? পুরো টাকাটা তো নেননি তখন। এখন কিছু রাখেন। '
বুড়ি খুশি হলো কি না বুঝতে পারলাম না। তবে নাতজামাই যে খুশি হয়েছে, সেটা বোঝা গেল। ফেরার সময় চৌধুরী এবং আমাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাল।
বলল,
'দরকার হলে আবারও আসবেন। আপনাদের সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম। ' বৃক্ষ তোমার নাম কী, ফলে পরিচয়!
৭
বুড়ির বাসা থেকে বের হয়ে হেঁটে হেঁটে দুজনে বড় রাস্ত্মায় আসলাম। গুমগুম করে মেঘ ডাকছে। হিলহিলে ঠান্ডা বাতাস।
যেকোনো সময় ঝেঁপে বৃষ্টি আসবে। মন্ময় বাবু কোথায় থাকেন জানি না। এখান থেকেই আলাদা হয়ে যাওয়া ভালো। উনি আবারও রিকশা করে বাসায় পৌঁছে দেবেন, ভাবাই অন্যায়। বললাম,
'বাবু, আমাকে একটু নিউ মার্কেটের দিকে যেতে হবে।
তবে আর একবার আপনার সাথে দেখা করতে চাই। আপনার সময় হবে তো?'
'সময় করে একদিন আসেন। এ হপ্তা ব্যস্ত আছি। আগামী শনিবার আসতে পারেন। ফোন করে আসলে ভালো হয়।
দোকানের ফোন নম্বর আছে না আপনার কাছে?'
'আজ্ঞে আছে। দোকান থেকে যে রশিদ দিয়েছিলেন, তার ওপর লেখা আছে। '
'গুড। দেখা হবে, কেমন?'
অন্ধকারে হারিয়ে গেলেন মন্ময়। কিছুক্ষণ পর বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা পড়তে লাগল।
ছোট একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকে চা, কচুড়ির অর্ডার দিলাম। রেস্টুরেন্টের নাম ঘোষ মিষ্টান্ন ভান্ডার। ঢুকতেই বাঁ হাতে ভাঁটের আগুনে বাবলার খড়ি পুড়ছে। গাঁট পোড়ার পটপট শব্দ পেলাম। এক ইঞ্চি পুরু স্টিলের প্রকাণ্ড তাওয়ায় মোগলায় পরটা, নরমাল পরটা, কিমা পুরি ভাজা হচ্ছে।
পাশে কেরোসিনের পাম্প কুকারে কড়াইয়ের ডোবা তেলে কচুড়ি, শিঙাড়া, ডালপুরি, রেগুলার পুরি ফুটছে। এগুলোর সাথে ফ্রি আমড়া, জলপাইয়ের চাটনি। ঘন দুধের ধোঁয়া ওঠা চা। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। রেস্টুরেন্টের টিনের চালে ঝমঝমাঝম।
চমৎকার পরিবেশ। মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে। বৃষ্টি ধরে এল দুঘণ্টা পর। এর মধ্যে কচুড়ি, শিঙাড়া, পুরি, দুই খুরি চাটনি, তিন কাপ চা, তিনটা ৫৫৫ সিগারেট শেষ করেছি। বাসায় ফিরতে হবে।
মা দুশ্চিন্তা করবে। শেখ মুজিব হত্যার পর হিন্দুরা তাদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেছে। আসল অবস্থা সেরকম না মোটেও। বনের বাঘের চেয়ে মনের বাঘই খাচ্ছে বেশি। মাইনরিটি সারা জীবনই নিজেদের অনিরাপদ ভাবে।
৮
ছ'দিন বাদে ফোন করলাম মন্ময় চৌধুরীকে। পরদিন শনিবার। বিকেলের দিকে দোকানে যেতে বললেন। দোকানে গিয়ে দেখি কাউন্টারে বুড়ো ম্যানেজার বসে আছে আমাকে সাহেবের ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। পুরো দোকান খালি।
শনিবার আধবেলা, রবিবার পুরো দিন ছুটি। অফিসে বসে আছেন মন্ময়। তন্ময় হয়ে তাকিয়ে আছেন বালা দুটোর দিকে। আমাকে ইশারায় বসতে বললেন। ম্যানেজারকে বললেন চলে যেতে।
শুরু করলেন মন্ময় বাবু :
'সঞ্জয় বাবু, কোনো প্রশ্ন করবেন না। শুধু শুনে যান। আশা করি আপনার সব কৌতূহল মিটে যাবে। এই বালা দুটো অনেক দিন আগেকার। লক্ষণ সেনের আমলের।
সেনেরা দক্ষিণ ভারতের লোক, জানেন তো? এঁরা ছিলেন গোঁড়া হিন্দু। সেনেরা বাংলাদেশে আসার আগে এই দেশ শাসন করত পালরা। তখন এখানকার বেশির ভাগ লোকই ছিল বৌদ্ধ। হিন্দুদের ভেতরও জাতপাত তেমন ছিল না বললেই চলে। থাকলেও তেমনভাবে কেউ মানত না।
সেনেরা এসে সবকিছু পাল্টে দিল। বিহার বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সব বন্ধ হয়ে গেল। শুরু হলো বৌদ্ধ নিপীড়ন। পরে বখতিয়ার খলজির আমলে এই বৌদ্ধরাই দলে দলে মুসলমান হয়। এই জন্যই হিন্দুরা বাঙালি মুসলমানদের বলে নেড়ের জাত।
বৌদ্ধরা মাথাটাতা কামিয়ে ন্যাড়া হয়ে থাকত বলেই এই বিশেষণ। সেনেরা বাঙালিদের বিদেশে যাওয়াও বন্ধ করে দেয়। ব্রাহ্মণরা ঘোষণা করে, কোনো বাঙালি বিদেশে গেলে জাতিচ্যুত হবে। বাঙালি জাতি কুয়োর ব্যাঙ হয়ে ঘরে বসে থাকল। দিন-দুনিয়ার খবর আর রইল না কিছু তার কাছে।
'লক্ষ্ণণ সেনের ঝোঁক ছিল তান্ত্রিকতার দিকে। লক্ষ্ণী নারায়ণ নামের এক কাপালিক ছিল তার গুরু। এই বালা দুটোর মুখগুলো দেখেন। দুটো ছাগির মুখ। অথচ সাধারণ বালাতে ব্যবহার হয় হাতি অথবা মাছের মুখ।
মুখগুলোতে প্যাঁচ লাগানো। দু'আঙুলে ধরে ঘোরালেই খোলে। আমি খুলেছি ওগুলো। ভেতরে সাদা সিল্কের ওপর ব্রাহ্মী লিপিতে হাকিনী বশীকরণ মন্ত্র লেখা। তন্ত্রসাধনায় বসলে সাধকের আসনের চারপাশে সে নকশা আঁকতে হবে, সেটাও দেওয়া আছে এখানে।
এগুলোকে ইংরেজিতে বলে অ্যামুলেট। নকশার ভেতরের ঘরগুলোর একটাতে লেখা 'নাদেস সুরাদেস ম্যানিনার'। প্রাচীন ব্যাবলনীয় ভাষা। এ মন্ত্র ভারতীয় নয়। এটা ব্যাবলনীয়।
প্রথম খিষ্টধর্ম, এরপর ইসলামের যখন প্রসার হলো, সেই সময় অনেক প্রেতসাধক ইরাক এবং সিরিয়া থেকে ভারতে চলে আসে। তন্ত্রমন্ত্র এখানে সারা জীবনই আছে। নরবলি, শবসাধনা এসব কাজে কোনো বাধানিষেধ নেই। লাকুম দ্বীনুকুম। যার যার ধর্ম তার তার কাছে।
ব্যাবিলনে তান্ত্রিকেরা বেড়ে উঠেছিল রাজানুকূল্য পেয়ে। ভারতেও সেটা পেতে তাদের খুব বেশি অসুবিধা হয়নি।
'বখতিয়ার খলজি বাংলা দখল করে নিলে লক্ষ্ণণ সেন পালিয়ে গেল পূর্ব বাংলার রাজধানী বিক্রমপুরে। সাথে লক্ষ্ণী নারায়ণ। মনে প্রতিহিংসার আগুন।
হারানো রাজ্য কীভাবে ফিরে পাবে রাত-দিন সেই ভাবনা। দৌর্দণ্ডপ্রতাপ বখতিয়ার আর তার মুসলমান সৈন্যরা এক মূর্তিমান বিভীষিকা। চিন্তা বাড়ে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে হতাশা। বাঙালি সেনদের দুঃশাসনে নিষ্পেষিত। গণ সমর্থন দুরাশা।
লোকবল, অর্থবল, মনোবল কোনোটাই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ক্রান্তিকালে এগিয়ে এল কাপালিক লক্ষ্ণী নারায়ণ। বখতিয়ার বিনাশ হবে হাকিনীর হাতে। জ্বরাসূরের বিকট মূর্তির সামনে জোড়া মোষ বলি হলো। লক্ষ্ণী নারায়ণের ইচ্ছে ছিল কুমারী উৎসর্গ করার।
লক্ষ্ণণ রাজি হননি। দেশের অবস্থা ভালো না। কুমারী, অকুমারী, বিবাহিতা সবারই বাবা-মা থাকে। এ নিয়ে ভেজাল হলে বিক্রমপুর ছেড়ে মিয়ানমারে গিয়ে উঠতে হবে। পুবে এখন শুধু ওই রাজ্যই নিরাপদ।
বখতিয়ারের এখতিয়ার মগের মুল্লুকে নেই। আয়োজন সম্পন্ন হলো বটে, তবে সমস্যা একটা রয়েই গেল। শবসাধনা করে হাকিনী ডেকে এনে বখতিয়ার বধ করতে হলে বখতিয়ারের কাছাকাছি থাকতে হবে। হাকিনীর কাছে রামও যা, রাবণও তা-ই। সে থাকে চির অন্ধকারের রাজ্যে।
বখতিয়ারকে হাকিনী চেনে না। তাকে চিনিয়ে দিতে হবে। লক্ষ্ণণ সেন পালিয়ে আসার সময় বখতিয়ার ছিল নদিয়ায়। এখন কোথায় আছে কে জানে? মুসলমান যোদ্ধারা নাকি ঘোড়ার পিঠ থেকে নামেই না। খাওয়া, ঘুম, নামাজ, যা-কিছু সব ওখানেই।
বখতিয়ার ঘোড়ার পিঠেই থাকে দিনের অর্ধেক সময়। ভেবেচিন্তে এক বুদ্ধি বের করল লক্ষ্ণী নারায়ণ। তার দুজন সাগরেদকে পাঠাল এই কাজে। শুরু হলো 'মিশন বখতিয়ার'।
'বাসমতি চাল পুড়িয়ে বানানো কয়লার সাথে ঘোড়ার রক্ত আর গর্ভবতী নারীর প্রস্রাব মিশিয়ে তৈরি কালিতে সাদা সিল্কের ওপর হাকিনী জাগানো মন্ত্র লিখে কাপড়টা দুটুকরো করে লক্ষ্ণী।
এই দুটো বালার ভেতর টুকরো দুটো ভরে সাগরেদ দুজনের হাতে একটা করে পরিয়ে দেয়। দুই সাগরেদ শুম্ভ ও নিশুম্ভ নদিয়ায় এসে জানতে পারে বখতিয়ার রংপুর অভিযানে। ওখান থেকে পায়ে হেঁটে রংপুর রওনা হলো তারা। দুদিন পর পদ্মা পার হয়ে বরেন্দ্র বা রাজশাহী পৌঁছাল। তখন চৈত্র মাস।
রাজশাহীতে কলেরা-বসন্তে গ্রামকে গ্রাম উজাড় হচ্ছে। কলেরার মহামারি চলছে, এমন এক গ্রামে সন্ধের মুখোমুখি ঢুকল দুজনে। দেখতে পেল তিন রাস্তার মাথায় ফাঁকা উঁচু ঢিবির মতো হাট বসার জায়গা। এর পাশেই প্রকাণ্ড বটগাছতলায় ধূপধুনো জ্বালিয়ে ওলাওঠা দেবীর পুজো হচ্ছে। রাস্তা দিয়ে কিছুক্ষণ পরপরই কাঁচা বাঁশের খাটিয়ায় বলহরি হরিবল করতে করতে শশ্মানে যাচ্ছে লাশ।
শুম্ভ ও নিশুম্ভ ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর। মহামারি লেগেছে এমন গ্রামে জল পর্যন্ত খাওয়া নিষেধ। অথচ সাগরে।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।