কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ টেলিভিশনের বর্তমান মহাপরিচালক যখন একটি বাণিজ্যিক স্যাটলাইট চ্যানেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তখন তাঁর অফিস কক্ষে একদিন প্রায় ঘণ্টা খানেক বসেছিলাম। কথা এবং চায়ের ফাঁকে বারবারই টেলিভিশনের পর্দায় চলমান সংবাদের স্ক্রলে চোখ চলে যাচ্ছিল। ভুল ত্রুটি খোঁজার কোনো উদ্দেশ্য না থাকলেও নিতান্ত অভ্যাসবশত সংবাদের আড়াই থেকে তিন মিনিটের স্ক্রল দেখতে দেখতে পাঁচটি ভুল বানান চোখে পড়লো। এ ব্যাপারে প্রধান নির্বাহীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বার্তা বিভাগ এবং গ্রাফিক্সের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে ডেকে তাৎক্ষণিকভাবে ভুল সংশোধনের নির্দেশ দিয়ে ভবিষ্যতে এ ধরণের ভুলের পুনরাবৃত্তি রোধে কী ব্যবস্থা নেয়া যায় তার উপায় খুঁজে বের করার পরামর্শ দিলেন। পাঁচ সাত মিনিটের মধ্যেই স্ক্রলের বানানগুলো সংশোধিত হয়ে চলতে শুরু করলো।
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বললেন, ‘আমরা উচ্চারণ বা বানানের ব্যাপারে যতটা স্পর্শকাতর ছিলাম প্রাইভেট চ্যানেলে এরা এই বিষয়গুলোকে তেমন গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। ’
এখানে ‘আমরা’ বলতে তিনি সরকার নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং বাংলাদেশ বেতারের কথা বলেছিলেন। এ কথা সত্যি, অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আশির দশকের শেষ পর্যন্ত প্রমিত বাংলা উচ্চারণ ও শুদ্ধ বাংলা বানানের জন্য বাংলাদেশ টেলিভিশনের উপর আস্থা রাখা যেতো। সংবাদ পাঠ ও উপস্থাপনায় আগ্রহী নবীনেরা টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রেখে কান খুলে উচ্চারণের বিশুদ্ধতা নিয়ে নিশ্চিত হতে চাইতেন।
প্রয়াত কবি ও আবৃত্তিকার কাজী আবু জাফর সিদ্দিকী বাংলাদেশ টেলিভিশনে দীর্ঘকাল বাংলা বানান ও উচ্চারণের মানদ- হিসাবে বিবেচিত ছিলেন।
কোনো বানান বা উচ্চরণ নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হলে আমরা নতুন প্রজন্মের প্রায় সকলেই তাঁর শরণাপন্ন হয়েছি। এমন কি আবদুল্লাহ আল মামুন বা আতিকুল হক চৌধুরির মতো সিনিয়র সহকর্মীরাও তাঁর সাথে আলোচনা করেছেন। কিন্তু সেই কাজী আবু জাফর সিদ্দিকী বাংলাদেশ টেলিভিশনে মহাপরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণের পরে বিভিন্ন শিরোনামে প্রচারিত অসংখ্য অগোছালো ও অপরিপক্ক অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা এবং বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদের রিপোর্টিং-এর ক্ষেত্রে বিটিভির উচ্চারণের মান কোন পর্যায়ে নেমে গিয়েছিল, তা বিটিভির দর্শক মাত্রেরই জানা। এর প্রধানতম কারণ হচ্ছে একদিকে পুরোনোদের মধ্যে যাঁরা কেবলই বয়সের বিবেচনায় পদোন্নতি লাভ করে অনুষ্ঠান নির্মাণের দায়িত্ব লাভ করেছেন, তাঁদের অনেকেরই বানান বা উচ্চারণের ভুল এবং শুদ্ধ-এর মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করার ক্ষমতা, এমন কি ভুলকে শুদ্ধ ভেবে বিভ্রান্ত হবার জন্য যে যোগ্যতাটুকু প্রয়োজন তাও নেই। অন্যদিকে নতুন প্রজন্মের প্রযোজকদের মধ্যে ভাষা সাহিত্য এবং একই সাথে স্বদেশ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সীমাহীন ঔদাসীন্য।
ফলে একটি মূল ক্রেডিট টাইটেলে ‘ঈশ্বর’ বানানটি ‘ইশ্বর’ হিসাবে প্রচারিত হবার পরে সংশ্লিষ্ট প্রযোজককে যখন বিষয়টি জিজ্ঞেস করা হলো, তখন সদ্য পদোন্নতি প্রাপ্ত প্রযোজক বিন্দুমাত্র লজ্জিত বিচলিত না হয়ে জানালেন, ‘আজকাল ঈশ্বর হ্রস্ব ই-কার দিয়েও লেখা যায়!’
স্বজন তোষণ বা রাজনৈতিক বিবেচনাকে প্রশ্রয় দিয়ে যে কোনো ক্ষেত্রে একবার নিজস্ব নির্ধারিত মানের নিচে নেমে যাবার সুযোগ সৃষ্টি করলে তা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে বের করা কঠিন। বরং যাঁরা বেনো জলের মতো ঢুকে পড়া এই অপরিশীলিত অপতৎপরতা বন্ধ করতে উদ্যোগী হয়েছেন তাঁদের জন্যেও তা সমস্যার সৃষ্টি করেছে। এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। জাতীয় শোক দিবসের একটি অনুষ্ঠানে উপস্থাপকের আঞ্চলিকতা এবং অপরিশীলিত উচ্চারণ সত্ত্বেও ‘বিশেষ বিবেচনায়’ অনুষ্ঠানটি প্রিভিউ করে প্রচারের অনুমতি দেয়া হয়েছিল। তবে শর্ত ছিল প্রচারের আগে অনুষ্ঠানের প্রথম পরিচিতি ফলকে ভুল বানানে লেখা ‘জাতীর জনক’ এবং ‘শ্রদ্ধাঞ্জলী’ শব্দ দুটি অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে।
প্রযোজক যে কোনো কারণেই হোক শুরুর টাইটেলটি পরিবর্তন না করে পুরোটাই ফেলে দিয়েছিলেন এবং যিনি এই ত্রুটি সংশোধনের পরামর্শ দিয়েছিলেন তাঁকে বঙ্গব›ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী হিসাবে চিহ্নিত করে প্রচারণা চালাবার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছিলেন।
নব্বই দশকের শেষ দিকে দেশে ব্যক্তি মালিকানাধীন স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল চালু হবার পরে অনেকদিন পর্যন্ত তারা বানান এবং উচ্চারণের ক্ষেত্রে নূন্যতম একটি মান বজায় রেখে চলতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন নাম পরিচয়ে বিপুল সংখ্যক স্যাটেলাইট চ্যানেল তাদের সম্প্রচার শুরু করলেও দক্ষ এবং যোগ্য সম্প্রচার কর্মীর অভাবে এবং সম্প্রচারের মতো প্রফেশনাল কাজে মালিকপক্ষের হস্তক্ষেপে গণমাধ্যমে প্রমিত বাংলা ব্যবহারের বিষয়টি ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। বিশেষ করে নগরকেন্দ্রিক এফএম রেডিও চালু হবার পরে উচ্চারণ বিকৃতির যে মহোৎসব শুরু হয়েছে তাকে থামানোর কোনো কার্যকরী উদ্যোগ কোনো দিক থেকে লক্ষ করা যাচ্ছে না। বরং ‘আর জে’ নামে পরিচিত এইসব বেতার অনুষ্ঠান উপস্থাপকদের মধ্যে যার বাংলায় ইংরেজি, এমন কি হিন্দির মিশেল বেশি, যার উচ্চারণ যতো বেশি ইংরেজি ঘেঁষা এবং যার উচ্চারণে ‘র’ কে ‘ড়’. ‘ছ’ কে ‘স’ জাতীয় বিকৃতি এবং শ্রুতিকটূ আঞ্চলিকতার রুচিহীন বিস্তার লক্ষণীয়ভাবে উপস্থিত তাদের প্রশংসিত, উৎসাহিত এবং পুরস্কৃত করার উদ্বেগজনক সংবাদ মাঝে মধ্যেই চোখে পড়ছে।
টেলিভিশনের ‘টক শো’গুলোতে যাঁরা অংশগ্রহণ করেন তাঁদের অনেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত, স্বনামধন্য এবং অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। দেশের মানুষের অনেক রাজনৈতিক ও সামাজিক সিদ্ধান্ত তাঁরা প্রভাবিত করেন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, তাঁদের অনেকের ত্রুটিপূর্ণ বাক্য বিন্যাস এবং আঞ্চলিকতা দোষে দুষ্ট বিকৃত উচ্চারণ গণমাধ্যমে প্রমিত বাংলা প্রচলনের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রতিবন্ধক। ভবিষ্যতে আলোচনা অনুষ্ঠান এবং ‘টক শো’ জাতীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রেও উচ্চারণের একটি ন্যূনতম মান নির্ধারণের ব্যবস্থা করা না হলে জাতীয় পর্যায়ের এইসব অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বের উচ্চারণ আমাদের তরুণ সমাজকে প্রভাবিত করতে পারে।
প্রতি বছরই ফেব্রুয়ারি মাসে মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাবশত হোক বা না হোক, নেহায়েত আনুষ্ঠানিকতার কারণেও ভাষা সম্পর্কিত সচেতনতা হয়তো কিছুটা বৃদ্ধি পায়।
এর ফলে আজকাল টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে বাংলা বানানের বিভ্রান্তি কম চোখে পড়লেও উচ্চারণের ক্ষেত্রে তেমন কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যায়নি। বিস্ময়ের ব্যাপার অতি সম্প্রতি দু একটি এফএম বেতারে প্রমিত বাংলা উচ্চারণের প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে। এ ধরনের শুভ উদ্যোগের ধারাবাহিকতা সারা বছর জুড়ে অব্যহত থাকলে হয়তো একটি ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া যেতে পারে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।