আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমায় তুমি ডেকেছিলে

জেল থেকে বের হয়ে হাফিজ অপলক চোখে আকাশের দিকে তাকালো। সে কোথায় যেন পড়েছে, আকাশের দিকে তাকালে মন ভালো হয়ে যায়। কিন্তু তার মন ভালো হলো না। বিষাদময় হয়ে গেল। তাকে নেবার জন্য কেউ জেল গেটে আসে নি।

পকেটেও একটি পয়সা নেই। আর্থিক সংকট নিয়ে সে চিন্তিত না। সে হেঁটেই যেতে পারবে বাড়িতে। কিন্তু সে কোথায় যাবে- নিজের বাড়িতে, না রুমিদের বাড়িতে?

একটু ক্ষণ সে দ্বিধা-দ্বন্ধে ভুগলো। তারপর সে সিদ্ধান্ত নিলো রুমিদের বাড়িতে যাওয়ার।


এখন বিকেল। আকাশ স্বচ্ছ। বিকেলের তেজহীন সূর্যের আলোয় চারদিক ঝিকমিক ঝিকমিক করছে। হাফিজ রুমিদের বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা করলো। তার প্রতিটি পদক্ষেপে ক্লান্তি।

মুখে আনমনা ভঙ্গি। তার মনে পড়ছে জেল জীবনের আগের কথা।

হাফিজ অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। স্বভাব- চরিত্র ভালো। কোনো দিন সে কোনো নারীর সর্বনাশ করেনি।

কিন্তু হঠাৎ করেই সে নারী কেলেংকারিতে ফেসে গেল।
পুলিশ তাকে গ্রেফতার করলো রুমিদের বাড়ি থেকে। রুমির চোখের সামনেই। সেদিন রুমি বাঁচাতে পারতো হাফিজকে; কিন্তু রুমি চুপচাপ ছিল। কেন ছিল? তা জানা দরকার।

রুমির রহস্যময় নীরবতায় হাফিজের জীবন ছারখার হয়ে গেছে। শিক্ষা জীবন বিপর্যস্ত। সামাজিক ও পারিবারিক জীবন কলংকিত।
ছ’মাসের জেল জীবনে হাফিজকে কেউ দেখতে আসেনি। বাবা না, ভাইবোন না - কেউ না।

শুধু মা একবার এসেছিল। সে কেঁদে কেঁদে হাফিজকে অভিশাপ দিয়েছিল। প্রিয় মা, সে-ও হাফিজকে সহ্য করতে পারে না। এর জন্য দায়ী রুমি।

রুমি এবার ক্লাশ টেনে পড়ে।

ছোট্ট মেয়ে সে। কিন্তু বড় পাকা। বছর খানেক আগে তার সাথে হাফিজকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল হাফিজের এক বন্ধূ। সেই বন্ধু হাফিজকে সাবধান করে দিয়ে বলেছিল, দোস্ত, জিনিসটা মারাতœক ডেনজারাস, একটু সাবধানে চলিস।

পরিচয় হবার পর থেকেই রুমি বড় বেশি আন্তরিক ব্যবহার দেখিয়েছিল।

আন্তরিক ব্যবহারে মজে গিয়েছিল হাফিজ। বাংলাদেশে যদি ডানকাটা পরী বাছাই করা হয়, রুমি তাদের দশের জনের একজন। গোলগাল সুশ্রী মুখ। ফর্সা ধবধবে। মাথায় দীঘল চুল।

মেদহীন শরীর। পাতলা ঠোঁটের ওপর টিকালো নাক। পরিমিত হাইট। মধুর কন্ঠস্বর। ব্যবহার নিখুঁত।

সে কী করে ডেনজারাস হয়? রুমি মোটেই সেরকম না, হাফিজ তার বন্ধুর সর্তকবাণীকে তুড়ি মেরে উঁডিয়ে দিয়েছিল।

হাফিজ তেমন সুদর্শন না। তবে সুপুরুষ। লম্বা ফিগার। বলশালী দেহ।

রুমি আকৃষ্ট হয়েছিল দারুণভাবে।
হাফিজকে ফোন করতে হত না। দরকারে-অদরকারে রুমিই করত। মাঝে মাঝে সে হাফিজের ফোনে ব্যালেন্স রিচার্জ করে দিত। এবং সে একেক দিন একটা বায়না ধরে বলত, “ভাইয়া, আজকে আপনার সাথে ঘুরতে যাব।

হালিম মামার ফুচকা খাবো। আপনি ফ্রি আছেন তো?”
হাফিজ আমতা আমতা করে বলত, “আজকে অনেক ব্যস্ততা। ”
রুমি নিষ্পাপ মেয়ের মতো বলত, “ব্যস্ততা ঝেড়ে ফেলুন। টাকা-পয়সা নিয়ে টেনশান করবেন না। আমি সব খরচ করব।


বাধ্য হয়েই হাফিজকে যেতে হত রুমির সাথে। ঘন্টার পর ঘন্টা ঘুরে বেড়াত তারা
উদ্দেশ্যহীনভাবে। এক জোড়া কবুতরের মতো। মাঠের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে।
কোনো কোনো দিন মাঝরাতে ফোন করে রুমি বলত, “ভাইয়া, আমাকে কিছু ইংলিশ ভিডিও গান জোগাড় করে দিতে হবে।


হাফিজ জোগাড় করে লক্ষী ছেলের মতো সেগুলো দিয়ে আসত রুমির বাসায়। সেগুলো দেখার পর রুমি ফোন করে বলত, “ভাইয়া, যেগুলো দিয়েছেন সেগুলো দেখেছি। খুবই ভালো লেগেছে। এখন আরেকটু খোলামেলা ধরনের কয়েকটি ভিডিও দিবেন। ”
হাফিজ না করতে পারত না।

কোনো না কোনো উপায়ে সে জোগাড় করে দিত রগরগে ভিডিও গান।

এইসব স্মৃতি মনে করতে করতে হফিজ পথ চলছে। সে রুমিদের বাড়ির যত কাছাকাছি আসছে, তার স্মৃতি ততই প্রবল হয়ে উঠছে। সেই স্মৃতিতে রুমি ছাড়া আর কেউ নেই। যেদিন রুমি তার সর্বনাশ করেছিল সেদিনের কথা তার খুব মনে পড়ছে।



হাফিজ কলেজ থেকে এসে ক্লান্ত শরীরে ঘুমাচ্ছিল। হঠাৎ মোবাইল ফোনের রিন রিন শব্দ শুনে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল।
রিসিভ করার পর শুনতে পেল রুমির গলা- “ভাইয়া, আপনি কি এখন আমাদের বাসায় আসতে পারবেন একটু? প্লিজ আসুন। ”
রুমির অনুরোধ ফেলা যায় না। সে শুধু অনুরোধ করে না, অন্তর দিয়ে আহ্বান করে।



হাফিজ অতিদ্রুত বিছানা ছাড়ল। ঝটপট করে হাত মুখ ধুয়ে নিলো। তার কয়েক মিনিট পর সে হন্তদন্ত হয়ে উপস্থিত হলো রুমিদের বাসায়।


রুমি সেজেগুজে বউ হয়ে বসেছিল। মুখে আচ্ছা করে মেখেছিল মেকআপ।

ঠোঁটে গাঢ় করে লাল লিপিস্টিক। সমস্ত শরীরে ছিল সুগন্ধি। হাফিজ রুপবতীর সজ্জিত চেহারার দিকে তাকিয়েছিল অভিভূত দৃষ্টিতে।

রুমি হাস্যমুখে জিজ্ঞেস করেছিল, “আমাকে কেমন লাগছে আজ?”
হাফিজ গদগদ গলায় বলেছিল, “অপূর্ব। ”

তারপর দুজন নির্বাক হয়ে পার করে দিয়েছিল কয়েক মুহূর্ত।

সেই নিরবতার মধ্যে প্রাণের স্পন্দন ছিল। কিন্তু বিশুদ্ধ নিরবতা সহ্য করা যায় না বেশিক্ষণ। হাফিজ নিরবতা ভেঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিল, “তোমার আম্মু বাসায় নেই?”
রুমি খিল খিল করে হাসতে হাসতে বলেছিল, “আম্মু বাসায় থাকলে কি আপনাকে আসতে বলতাম?”
“এখন যদি এসে পড়ে?”
“আপনার ভয় নেই। আম্মুকে বলব আপনাকে আসতে বলেছি অংক বোঝাতে। ”
“তুমি পড়াশোনা নিয়ে ভাবো?”
“ভাবি।

তবে কম কম। ”
“আমার মনে হয় তুমি মোটেও ভাবো না। ”
“কেন মনে হলো?”
“তুমি ক্লাশ টেনে পড়ো। অথচ তোমার মোবাইল ফোন সেট তিনটা। একটা ল্যাপটপ।

সারাক্ষণ এগুলো নিয়েই ব্যস্ত থাকো। পড়াশোনা কর কখন?”
“আমার পড়াশোনা করতে ভালো লাগে না। ”
“একথা তোমার বাবা-মা জানে?”
“হ্যাঁ, জানে। ”
“তাহলে ওনারা তোমাকে ল্যাপটপ কিনে দিলেন কেন?”
“তাদেরকে বুঝিয়েছি ল্যাপটপ খুব দরকারি। তাছাড়া কম্পিউটার শিক্ষা আমার ফোর্থ সাবজেক্ট।


“সেটা না হয় বুঝলাম। কিন্তু মডেম কিনে দিলেন কোন হিসেবে?”
“তাদেরকে বুঝিয়েছি ইন্টারনেট সংযোগ থাকলে অনেক শিক্ষণীয় জিনিস বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করা যায়। এতে আমার লেখাপড়ার উন্নতি হবে। ”
“কী যে উন্নতি হয়েছে তা তো আমি জানি। আর কী শিক্ষণীয় জিনিস ডাউনলোড কর, তা যদি তারা জানতে পারত তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ল্যাপটপ ভেঙ্গে ফেলত।


“তাদেরকে জানতে দিলে তো? গভীর রাতে ইন্টারনেট নিয়ে বসি। তখন তারা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে। ”
“তোমার অনেক বুদ্ধি। যাইহোক, তুমি আমাকে ডেকেছো কেন?”
“সেটা ভেঙ্গে বলতে হবে?”
হাফিজ ইশারা বুঝতে পেরে রুমির সাথে ঘনিষ্ঠ হবার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলো। যেই রুমির হাতটা ধরে ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করল তার প্রায় সাথে সাথে বিরক্তকিরভাবে বেজে উঠলো কলিং বেল।



একটু খানি সময় নিয়ে রুমি দরজা খুলে দিলো। খোলা দরজা দিয়ে রুমির মা শাহনাজ ঢুকে পড়ল গট গট করে। বাসায় অপরিচিত একটা ছেলেকে দেখে সে অপ্রতিভ হয়ে গেল। একটু ধাতস্থ হয়ে সে হাফিজের দিকে তাকাল কটমট দৃষ্টিতে।

সে তার নিজের মেয়ের ওপর মহাক্ষুব্ধ।

রুমি অল্প বয়সেই বিগড়ে গিয়েছে। এর জন্য তারা স্বামী-স্ত্রী অনেকটা দায়ী। তারা রুমিকে কাড়ি কাড়ি হাত খরচ দেয়। মেয়েকে তারা ফোন সেট কিনে দিয়েছে ক্লাস সিক্স পড়া অবস্তায়। রুমি ঘন্টার পর ঘন্টা ফোনে ব্যস্ত থাকলেও তারা মেয়েকে বারণ করেনি।

রুমি রাত জেগে ল্যাপটপ নিয়ে গুঁতোগুঁতি করলেও তারা নীরব থেকেছে। রুমির বাবা ব্যবসার কাজে বাইরে বাইরে থাকে। শাহনাজকেও সাংসারিক কাজে মাঝে মাঝে বাইরে যেতে হয়। ঠিক সেই সময় রুমির তার ছেলেবন্ধুদেরকে বাসায় ডেকে এনে একান্তেু সময় কাটায়। এটার বিরুদ্ধে বললে রুমি ফোণা তোলা সাপের মতো ফোঁস করে ওঠে।

তাই শাহনাজ অনেকদিন ধরে ভাবছিল, এমন কিছু করতে হবে যাতে কোনো ছেলে রুমির ডাকে সাড়া না দেয়। রুমি যাদেরকে বাসায় আমন্ত্রন জানায় তারা বড়লোকের ছেলেপেলে। কিন্তু হাফিজকে তেমন দেখাচ্ছে না। তাকেই গিনিপিগ বানাতে হবে।
শাহনাজ থানায় ফোন করলো।

আধা ঘন্টা পরে তিনজন পুলিশ এলো। শাহনাজ অভিযোগ করলো হাফিজের নামে- শাহনাজ বাসায় ছিল না। এই সুযোগ নিয়ে হাফিজ বাসায় ঢুকে তার মেয়ের সম্ভ্রম নষ্ট করার চেষ্টা করেছে। পুলিশ হ্যান্ডকাপ পরিয়ে হাফিজকে নিয়ে গেল থানায়।
ছ’মাস আগের এই ঘটনা হাফিজের জীবনের বাঁক পরিবর্তন করে দিয়েছে।



হাফিজ এখন দাঁড়িয়ে আছে রুমিদের দোতলা বাড়ির সামনে। গেটে শব্দ করবে কি না ভাবছে।
রুমির হয়ত তাকে পরিকল্পিতভাবে ফাসায় নি। কিন্তু তার মা হাফিজকে পুলিশের হাতে যখন তুলে দিল, তখন সে কেন ভূমিকা নিলো না? এই প্রশ্নটা হাফিজের মনের ভেতর পাক খাওয়া স্রোতের মতো ঘুরপাক খাচ্ছে - রুমি, কেন আমায় তুমি ডেকেছিলে? ডেকেছিলে, তবে কেন বাঁচাবার চেষ্টা করলে না?

গেটে শব্দ করতে গিয়েও শব্দ করলো না হাফিজ। নিজের সাথে বোঝাপড়া করে দেখলো, এই প্রশ্নটা করে হবে কী? উত্তরটা জানতে পারলে কীই বা এমন লাভ হবে? যে মুখে চুন কালি মেখেছে, পৃথিবীর সমস্ত সাবান দিয়ে ধুলে কি তা পরিস্কার হবে?

তাহলে প্রশ্ন করার দরকার কী? হাফিজ কাঁন্না কাঁন্না মুখে রুমিদের বাড়ি ত্যাগ করলো।


চারদিকে এখন অন্ধকার। সন্ধ্যা নেমে গেছে সেই কখন। আর কিছুক্ষণ পর রাত নামবে। নিকষ কালো রাত। হাফিজ মনে মনে ভাবল, প্রকৃতির এই রাত ক্ষণস্থায়ী।

রাতের পর স্নিগ্ধ সকাল আসবেই। কিন্তু তার জীবনে যে অসীম অন্ধকারময় রাত নেমেছে, তা অন্তহীন। ।

সোর্স: http://prothom-aloblog.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।