পৃথিবীর কোন ধর্ম কিংবা ধার্মিক ব্যক্তিত্ব পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টির কারণ হয়নি। বকধামিকেরাই কেবল ধমের অপব্যবহার বা বিকৃতি সাধন করে শান্তির বিপক্ষে কাজ করতে পারেন। বাংলাদেশে সিলেটের শাহজালাল, শাহপরান, খুলনার খানজাহান আলী, চট্টগ্রামের বারো আউলিয়া কিংবা বাইরের রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব, স্বামী বিবেকানন্দ, গৌতম বুদ্ধ, লোকনাথ ব্রহ্মচারী—তাঁরা কেউ বিশৃংখলা সৃষ্টি বা সম্প্রীতি নষ্টের কারণ হননি, মানুষের শান্তি নিশ্চিতকরণে সংগ্রাম করেছেন। অথচ এই ধর্মকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে,ধর্মের প্রতি মানুষের আবেগ অনুভূতিকে নেতিবাচক কাজে লাগিয়ে অনেকে বড় রকমের অধর্ম করেছেন। ধর্মের অপব্যবহার করেই অযৌক্তিকভাবে মানুষ হত্যা, জ্বালাও-পোড়াও, লুটপাট করাকে বৈধতাদানের অপচেষ্টা হচ্ছে, সমাজে অশান্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশ-মিয়ানমারে রক্তপাত, আহমদিয়াদের নির্যাতন, শিয়া-সুন্নিতে সংঘর্ষ ভীতসন্ত্রস্ত করছে মানুষকে। ধর্মীয় সম্প্রীতি ধ্বংস করাটাতেও যে পাপ-এই বোধটা লক্ষ্য করা যাচ্ছেনা।
সাধারণ মানুষের বিশ্বাস ও প্রথাগত আচারানুষ্ঠানের মধ্যেও রাজনীতি ঢুকে যাচ্ছে। সাধারণ বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক পরিবেশের অভ্যন্তরীন পরিবর্তনসমূহের অন্যতম ও স্পর্শকাতর অনুঘটক হচ্ছে ধর্ম। ধর্মকে অপব্যবহার করে অনেক রাজনীতিবিদ জনগণের মনোরঞ্জন ও অনৈতিক কাজকে বৈধতাদানের অপচেষ্টা করে থাকেন।
যেহেতু ধর্ম অধিকাংশ মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করে ফলে ধর্মীয় আবেগ অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে অনেকে স্বার্থের প্রয়োজনে ধর্মের মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। আবার অনেকে ধর্মীয় বিশ্লেষণ ও বিবেচনার সরবতাকে নিজের লোভ লালসা, অন্যায় ও অবৈধ কর্মকান্ডের জন্যে হুমকিভেবে ধর্মের বিরোধীতাও করেন। তবে আশার দিক হচ্ছে মানুষ ক্রমাগত সচেতনতার মাত্রা বাড়াতে বিরামহীন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যার ফলে প্রচলিত পথ ও প্রথাগত অনেক পদ্ধতির উত্তম বিকল্পের খোঁজ মিলছে। এটা ঠিক যে, অধার্মিক চেতনায় কিংবা ধর্মবিদ্বেষী পরিবেশে ধর্মপ্রাণ মানুষও তীব্র সামাজিক প্রতিরোধ ও ব্যক্তিগত অসহিষ্ণুতার সম্মুখীন হতে পারে। ধর্ম পালন ব্যক্তিগত পর্যােয়ে হলে অনেকের বাধাঁ থাকেনা কিন্তু ধর্মের সামাজিকীকরণ করতে চাইলে অনেকে কিছু কিছু কাজ স্বাধীনভাবে করতে না পারায় ধর্মের সামাজিক চর্চার বিরোধীতা করে।
নাস্তিক বা স্বাধীন মুক্ত জীবন প্রত্যাশীরা যেমন ইচ্ছামত সবকিছু করতে না পারায় ধর্মের বিরুদ্ধে যেতে পারে তেমনি অজ্ঞতার কারণে অন্ধবিশ্বাসীরা ধর্মকে ভালবেসেও অনিচ্ছাকৃতভাবে বা অসচেতনভাবে ধার্মিকদের ক্ষতিসাধন করতে পারে।
ধর্মের নামে সহিংসতা হলে তা কখনো মেনে নেয়া যায় না। কারো ওপর হামলা সব ধর্মই পাপ ও অন্যায় বলেছে। সমাজে বিচিত্র প্রকৃতির অধর্ম হচ্ছে। যেমন: ঘুষ-দুর্নীতির অধর্ম,গরিব মানুষকে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করার অধর্ম, টাকা দিয়ে রায় কেনার অধর্ম, অশ্লীল আচরণে অধর্ম।
ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর গুরুত্ব না দিলে কখনও এই অধম দূর হবে না। অজ্ঞতার জন্যও মানুষ ধর্মান্ধ হচ্ছে। অনেক মানুষ নিজ ধর্ম সম্পর্কে জানে না এবং ৯৯ শতাংশ মানুষ অন্য ধর্ম সম্পর্কে জানে না। সত্যিকার অর্থে মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও হিন্দু হতে পারলে বাংলাদেশে কেন, বিশ্বে কোনো সহিংসতা থাকত না। ইহুদি ধর্মের ১০টি নির্দেশের মধ্যে ষষ্ঠ নির্দেশ হচ্ছে, ‘কাউকে হত্যা কোরো না’।
হিন্দু সম্প্রদায়ের ‘নমস্কার’ শব্দটার অর্থ হচ্ছে, ‘তোমার ভেতরে যে ভগবান আছে, তার প্রতি আমি মাথা অবনত করছি। ’ এ সম্বোধন যে ধর্মে আছে, তারা তো অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি আঘাত হানতে পারে না। ফলে বকধার্মিক ও অধার্মিকরা কুসংস্কারাচ্ছন্ন হলেই কেবল ধর্ম ও আধুনিক সভ্যতার নীতি-নৈতিকতার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে পাপ কাজে যুক্ত হতে পারে।
ইসলাম ধর্মেও বলা হয়েছে, নিরপরাধ একজন মানুষকে হত্যা করার অর্থ হলো দুনিয়ার সব মানুষকে হত্যা করা। এবং একজন অসহায় মানুষকে রক্ষা করার অর্থ হলো, দুনিয়ার গোটা মানবজাতিকে রক্ষা করা।
যিশুখ্রিষ্টের আদর্শ যদি খ্রিষ্টানরা পালন করত, তাহলে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আণবিক বোমা ফেলতে পারত না। বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছিলেন, যদি কোনো ধর্ম সম্পর্কে ইতিবাচক কিছু বলতে বলা হয়, আমি বলব বৌদ্ধধর্মের কথা। কারণ, এ ধর্ম স্বর্গ বা নরকের ভয়ে সৎ থাকতে বলে না, বিবেকের তাড়নায় সৎ থাকতে বলে। ইসলাম ধর্ম অন্য ধর্মের প্রতি আঘাতের কথা বলেনা। পূর্ণ জীবনব্যবস্থা ইসলামে বৈষম্য নেই, ধর্মীয় সম্প্রীতি আছে।
স্বাভাবিক সময় তো নয়ই, এমনকি যুদ্ধের সময়ও কোনো উপাসনালয়ে আঘাত করা, শিশুদের আঘাত করা, বৃদ্ধ ও ধর্মীয় নেতাদের আঘাত করা-ইসলামে নিষিদ্ধ।
মার্ক্সের মতে ধর্ম হল পুঁজিবাদের হাতিয়ার যা দিয়ে তারা শোষণ প্রক্রিয়া চালু রাখে। তার ভাষায় ধর্ম হচ্ছে নিপীড়িত জনগনের আফিম কিংবা যন্ত্রনা নিবারক। ” আফিম খেলে বাঘ বাঘ ঝিমিয়ে থাকবে, মাথা তুলতে পারবে না, তাই কোন দিন সে খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে পড়তে পারে এমন দুঃচিন্তার কারণ থাকবে না। বাঘের বেলায় যেরকম ব্যবস্থা মেহনকারী মানুষদের বেলাতেও ঘানিকটা সেই ধরনে ব্যবস্থা গড়ে উঠল।
এই ব্যবস্থাটার নাম ধর্ম। ওয়েবার বলেন, ধর্মের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পুরোহিতদের অস্তিত্ত্ব। এরা ধর্মীয় বিশ্বাসের যৌক্তিকীকরনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা রাখে। যখন সম্পদের মালিকানার ভিত্তিতে দুটি শ্রেণী সৃষ্টি হল মেহনতকারী ও ভোতাকারী। এই মেহনকারী মানুষের জন্য সৃষ্টি হল ধর্ম।
“একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী মহলে ধর্ম ভিত্তিহীন হয়ে উঠলেও সাধারণ মানুষের কাছে কখনই গুরুত্ব হারায়নি। এক সময় চার্চের গুরুত্ব মানুষের কাছে কমে গিয়েছিল, কিন্তু ধর্মের শক্তি তখনও পুঞ্জিভূত ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অনেকেই ধর্মকে নতুন করে আবিষ্কার করেছেন, মুক্তি ও নিরাপত্তার আশায়। এ থেকে বোঝা যায় ধর্মের প্রতি অবজ্ঞা ভাব মূলত উন্নতি ও প্রতিপত্তি থেকে আসে। মানুষ প্রভাবশালী ও ধনী হয়ে গেলে ধর্মের প্রয়োজনীয়তা তার কাছে ফুরিয়ে যায়, অন্তত সে তা-ই মনে করে।
ধর্মের প্রতি অনেকেই নিবেদিত কিন্তু এদের মধ্যে অধিকাংশই হতদরিদ্র এটা বলে অনেকে ধর্মপ্রাণ মানুষকে দুনিয়ার বাস্তবতা ও জাগতিক জ্ঞানের ব্যাপারে পশ্চাদপদ প্রমাণ করতে চায়। যারা স্বচ্ছল তাদের অনেকে তাদের অর্জনকে নিজের চেষ্টা সাধনা ও পরিশ্রমের ফসল মনে করলেও নিয়মিত ধর্ম পালনকারী অসহায় দরিদ্ররা তাদের করুণ বা অস্বচ্ছল অবস্থার জন্য নিজেদেরকে নয় বরং ভাগ্যকে দায়ি করেন। এভাবেই আধুনিক মননে ও যাপিত জীবনে সভ্য জগৎ থেকে ধর্মকে কম গুরুত্বপূর্ণ বলে দেখানোর একটি প্রবণতা অনেকের মাঝে দেখা যায়। যদিও বাস্তবতা হচ্ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্ম এখনও বিশাল প্রভাব বিস্তার করে আছে।
সাধারণ মানুষের জন্য সমাজ একাঙ্গীকরণের চালিকা শক্তি হিসেবে এখনও ধর্মের বিকল্প নেই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে নাৎসি জার্মানিরা ধর্মকে বিলুপ্ত করে দেয়ার চেষ্টা করেছে । হিটলার ইহুদি বিদ্বেষ ও ইহুদি নিধনের চেতনার মূলে ছিল, ইহুদিরাই জার্মানদের সর্বশক্তিমান হয়ে উঠার পথে প্রধান অন্তরায়। আর জার্মানদের সর্বশক্তিমান হতে হবে এবং পুরো বিশ্বের নেতৃত্ব দেবে জার্মানরা এ ধরণের চেতনা হিটলার পেয়েছিলেন ইউজেনিক্স থেকে। তিনি মনে করতেন জার্মানদের চেয়ে সভ্য ও উন্নত আর কেউ নেই। এভাবেই হলোকাস্টের সূচনা।
হলোকাস্ট অবশ্যই ধর্মবিরোধী। খ্রিস্টান চার্চ হলোকাস্ট বা হিটলারের কুশাসন মেনে নিতে পারেনি। হিটলার নিজের চিন্তাধারার বিরোধী কোন পক্ষকেই টিকিয়ে রাখতে চাননি যার মধ্যে ধর্মপ্রচারকরাও পড়তেন। সংগঠিত ধর্মকে উপড়ে ফেলে নিজের ইউজেনিক্স কেন্দ্রিক নাৎসিবাদকে প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তার লক্ষ্য। তিনি "ইয়ুথ গ্রুপ" প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যরা উদ্দেশ্য ছিল, এমন যুব সমাজ গড়ে তোলা যাদের মধ্যে প্রথাগত ধর্মের প্রতি আনুগত্য থাকবে না।
কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নেও ধর্মহীন শিক্ষা প্রচলিত ছিল। কোন গ্রামের মানুষকে ধর্ম পালন থেকে বিরত রাখার একটি মোক্ষম উপায় হল, সেখান থেকে একটি শিশুকে ছিনিয়ে নেয়া এবং তাদেরকে বলে দেয়া, কেউ যদি ধর্ম পালন করে বা কোন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে সাহায্য করে তাহলে শিশুটিকে মেরে ফেলা হবে। জার্মানির মত খ্রিস্টান রাষ্ট্রে হিটলার কিভাবে এই নীতি প্রয়োগ করেছিলেন তা বেশ দুর্বোধ্য। এভাবে সমাজ থেকে ধর্ম উধাও হওয়ার সাথে সাথে সমাজ থেকে নৈতিক মানদণ্ডও উধাও হয়ে যায়, কোন সাধারণ বাধা সৃষ্টিকারী নীতিও থাকে না। কোন জাতি ধর্ম বাদ দিয়ে নৈতিকতা ধরে রাখতে পারবে কি-না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবার অধিকারটি সংবিধানস্বীকৃত। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪১(১)(ক) তে বলা হচ্ছে – আইন, জনশৃংখলা ও নৈতিকতার সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের যেকোন ধর্ম ‘অবলম্বন, পালন ও প্রচারের’ অধিকার রয়েছে। বিশ্বের প্রায় সকল দেশের সংবিধানেই নাগরিকদের এ অধিকারটি দেয়া হয়েছে। তবে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের বিষয়টি যদি ধর্ম পালনেরই একটি অংশ হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে অবস্থান কি হবে সে ধরণের বিধান আমরা সংবিধানে পাই না। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রায় নব্বইটিরও বেশি দেশে ধর্মভিত্তিক দলগুলো রাজনীতি করে যাচ্ছে, কেউ কেউ ক্ষমতাও লাভ করছে।
স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক দলগুলো দেশের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিত, সত্তরের নির্বাচনেও তাদের অংশগ্রহণ ছিল। তবে একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে তৎকালীন ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সবগুলোই এ সংগ্রামের বিপক্ষে অবস্থান নেয়, যার ফলশ্র“তিতে স্বাধীন বাংলাদেশে তারা রাজনীতি করবার অধিকার হারিয়ে ফেলে। বাহাত্তরের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৮ এ সংগঠনের স্বাধীনতা সম্পর্কে বলা ছিল, ‘জনশৃংখলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠনের অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে। তবে শর্ত থাকে যে, কেন ব্যক্তিরই এমন কোন সংগঠন গঠন করবার, সদস্য হবার কিংবা কোন কার্যক্রমে অংশ নেবার অধিকার থাকবে না যদি ঐ সংগঠনটি সাম্প্রদায়িক হয় অথবা কোন ধর্ম বা ধর্মীয় উদ্দেশ্যকে ভিত্তি করে কোন রাজনৈতিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য গঠিত হয়। ’ এর মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ হয়ে যায়।
জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে একটি আদেশের মাধ্যমে অনুচ্ছেদ ৩৮ এর ঐ শর্তাংশটুকু বাতিল করে দেন, পরবর্তীতে যা ১৯৭৯ সালে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সাংবিধানিক বৈধতা পায়। সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞাটি উঠে যাওয়ায় ইসলামী দলগুলো তাদের কার্যক্রম আবার শুরু করে এবং একে একে পাঁচটি সংসদ নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করে । ২০১০ সালে যখন আদালতের রায়ে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হয়ে যায়, তখনই বিভিন্ন পর্যায় থেকে ধর্মভিত্তিক দলের রাজনীতি করার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন আসতে শুরু করে। সর্বশেষে, ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে কিছু নতুন শর্তাবলী যুক্ত করা হয়, যার মাধ্যমে বাহাত্তরের সংবিধানের মত স্পষ্টভাবে না বললেও সরকারের হাতে ধর্মভিত্তিক দলের রাজনীতি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করবার কিংবা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে রাখবার এখতিয়ার চলে আসে। বাংলাদেশের সংবিধান এখন পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের, ধর্মভিত্তিক দলের গঠণতন্ত্র ও কার্যক্রমের সাথে বহু জায়গাতেই এটি সাংঘর্ষিক।
বাহাত্তরের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১২ অনুচ্ছেদের ৩য় শর্তটি, অর্থাৎ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার বিলোপ করা ইসলামী দলগুলোর জন্য মাথাব্যাথার বড় একটি কারণ । কেননা ধর্মের অপব্যবহার কি, কিভাবে হয় বা কতটুকুতে হয় এ বিষয়ে কোন সুস্পষ্ট বক্তব্য কোথাও নেই, সুতরাং সরকার চাইলে সুবিধামত সংজ্ঞা নির্ধারণ করে তা ইসলামী দলগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে। এছাড়াও অনুচ্ছেদ ৮ এ রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস এর বদলে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতিস্থাপন হয়েছে।
বিশ্বের প্রায় আশিটি দেশে একশ সত্তরটি খ্রিষ্টান ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন দল রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করছে। ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি কিংবা ক্রিশ্চিয়ান সোশ্যালিস্ট পার্টি এ ধরণের নাম দিয়েই ভিন্ন ভিন্ন দেশে দলগুলো কাজ করে চলেছে।
জার্মানীতে অ্যাঞ্জেলা মার্কেলের নেতৃত্বাধীন ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি এখন ক্ষমতায়। নেদারল্যান্ডস, আর্জেন্টিনা সহ বিশ্বের আরও বিভিন্ন দেশে এ ধরণের দল ক্ষমতায় রয়েছে। তবে নামে ক্রিশ্চিয়ান দল হলেও দলগুলো তাদের রাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক মূলনীতি অনুসরণ করে চলে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা হল সেক্যুলারিজম। খ্রিস্টান ধর্মে রাজনীতি বা রাষ্ট্রক্ষমতা লাভের উপর কোন সুনির্দিষ্ট গুরুত্বারোপ করা নেই। অপরদিকে মুসলিম দেশগুলোতে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর অবস্থা চোখে পড়বার মত।
৩০ টি দেশে প্রায় ৭৯টি ইসলামী দল বর্তমান বিশ্বে গণতান্ত্রিক পন্থায় রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। তবে মুসলিমপ্রধাণ দেশগুলোর মধ্যে সাংবিধানিক ভাবে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ রয়েছে মূলত চারটি দেশে মিসর, তুরস্ক, আলজেরিয়া এবং তিউনিসিয়া। এছাড়াও সাবেক ফরাসী কলোনীভুক্ত পশ্চিম আফ্রিকার কিছু দেশেও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি সাংবিধানিক ভাবে নিষিদ্ধ। ফ্রান্সে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ।
আমাদের দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত মোট ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ১১টি ইসলামী দল রয়েছে, এদের মধ্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সর্বপ্রথম নিবন্ধিত ইসলামী দল, যারা ২০০৮ এর ৪ঠা নভেম্বর নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হয়।
দেশের জাতীয় নির্বাচনগুলোতে অংশগ্রহণের হিসাব করলে দেখা যায়, ১৯৭৩ এর প্রথম নির্বাচনে ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধ থাকায় জামায়াত নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি। ১৯৭৮ সালে কার্যক্রম শুরু করবার পর ১৯৮৬ এর নির্বাচনে দশটি আসন লাভ করে জামায়াত। ১৯৯১ এর নির্বাচনে ১৮টি আসন লাভ করবার পর ১৯৯৬তে তা নেমে আসে ৩টি আসনে। এরপর ২০০১ এর নির্বাচনে ১৮টি আসন পেলেও সর্বশেষ ২০০৮ এ জামায়াত পায় মাত্র দুটি আসন। অন্যান্য ইসলামী দলগুলোর নির্বাচনে চোখে পড়বার মত কোন তৎপরতা এখনও পরিলক্ষিত হয়নি।
মিয়ানমারে সামরিক জান্তা প্রণীত আইনে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহারের উদ্দেশ্যে কোন দল নিবন্ধন পাবে না। ভারতের গণপ্রতিনিধিত্ব আইন, ১৯৫২ এর ২৯(ক) আইনের ৫ম উপধারা অনুযায়ী, নিবন্ধনের জন্য প্রতিটি দলকে অবশ্যই তার গঠণতন্ত্রে এ অনুচ্ছেদটি যোগ করতে হবে যেখানে বলা হয়েছে, এ দলটি ভারতের সংবিধান ও সকল আইনের প্রতি এবং সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং গণতন্ত্রের মূলনীতিসমূহের উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস ধারণ করবে এবং ভারতের সার্বভ্যেমত্ব, ঐক্য এবং উন্নতি নিশ্চিত করতে সচেষ্ট হবে। তবে ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, অস্ট্রেলিয়াসহ আরো বেশকিছু দেশে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনে সাংগঠনিক দৃঢ়তা এবং অর্থনৈতিক স্বচ্ছতাকেই মূল বিবেচ্য হিসেবে দেখা হয়, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি সম্পর্কে কোন আলাদা বিধিনিষেধ সেখানে আরোপিত নেই যদি না তা দেশের সার্বভৌমত্ব হানিকর কোন উদ্দেশ্যে গঠিত হয়।
ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি কিংবা ধর্ম বিদ্বেষ আমরা চাইনা। অন্ধ আনুগত্য অযৌক্তিক বিরোধীতার চেয়ে মোটেই কম ক্ষতিকর নয়।
দেশের লাখো-কোটি খেটে খাওয়া মানুষের স্বপ্ন এবং স্বর্ণালী আগামীর প্রেরণা বুকে নিয়ে পথ চলা তরুণ-যুবসমাজের অমিত সম্ভাবনাময় এই দেশ নিয়ে আমরা আশাবাদী। সংকীর্ণতা এবং প্রতিহিংসার রাজনীতির বলয় থেকে বেরিয়ে এসে মসৃণ গণতান্ত্রিক পথ চলা নিশ্চিত করতে এবং দেশ গড়তে সর্বজনীন অংশগ্রহণের ভিত্তিতে কার্যকরী সংসদ গড়ে তুলতে পরমতসহিষ্ণুতা এবং পরম বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে সক্ষম হতে হবে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে। দেশের জন্য একটি আলোকিত ভবিষ্যতের দরজা উন্মুক্ত করণে সম্মিলিত প্রয়াসের বিকল্প নেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।