আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভাসানীর বেগুন টাল এবং পোড়াবাড়ির চমচম


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম অনেক খেয়েছি। কিন্তু পোড়াবড়ি টাঙ্গাইলের কোথায় অবস্থিত তা জানা ছিল না। সেই সুযোগটা হটাৎ করেই পেয়ে গেলাম।
আমি তখন আরমবাগের একটি মেসে থাকি। আমার রুমমেট চাকরিজীবী উপেন দা।

ঢাকা ট্রেজারীতে চাকরি করেন। পাশের রুমে আলমগীর ও রিপন নামে দু’জন ছাত্র থাকে। একজন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে আরেকজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুইজনের বাড়িই টাঙ্গাইল জেলায়, তবে সদর থানায় নয়। ১৯৮৫ সালের ষোলই নভেম্বর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া রিপন এসে বলল, ভাই আমরা আগামী কাল ১৭ই নভেম্বর ভাসানীর মৃত্যু দিবসে টাঙ্গাইল যাচ্ছি, আপনারা ইচ্ছা করলে আমাদের সাথে যেতে পারেন।

আমরা ৫০ সিটের বাস রিজার্ভ ভাড়া করেছি। এখনও আমাদের ৫০জন হয়নাই।
রিপনের কথা শুনে সুবর্ন সুযোগ মনে হলো। এরকম সুযোগ পেলে আর কেউ না গেলেও আমি তো ছেড়ে দেয়ার পত্র নই। সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেলাম।


উপেন দা মানিক গঞ্জের লোক। বাংলায় মাস্টার্স তবে খুব রসিক লোক। তিনি মানিকগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। আমার যাওয়ার আগ্রহ দেখে হাসতে হাসতে বললেন, রিপন, ভালো মাইনষের কাছেই কইচাও, একে তো নাচুনী বুড়ি, তারোপর ঢোলের বাড়ি, এহন তোমরা না গেলেও পরামানিক একলা হইলেও যাইবো, বলেই হো হো করে হাসতে লাগলেন।
আমি উপেন দা’র হাসির সাথে যোগ দিয়ে হাসতে হাসতে বললাম, দাদা, ঘুরে বেড়ানের সুযোগ তো সব সময় পাই না।

এবার সেই সুযোগ যখন পেয়েছি তখন একটু না হয় ঘুরে আসি। আমি তার দিকে আগ্রহ নিয়ে বললাম, দাদা, আপনেও চলেন আমাদের সাথে?
দাদা হাত কচলাতে কচলাতে বললেন, নারে ভাই, চাকরির ডিউটি বাদ দিয়া ঘুইরা বেড়ান যাইবো না। তাইলে চাকরি থাকবো না। আপনারা বেকার মানুষ যত পারেন ঘুইরা বেড়ান। এহনই আপনাগো ঘুইরা বেড়ানের সময়।


আমাদের আগামীকালের প্রগ্রাম নিয়ে দাদা অনেক রসিকতা করলেন। আমরাও তার সাথে যোগ দিয়ে অনেক হাসাহাসি করে মজা পেলাম। অনেক কথা বলার পর রিপন তার রুমে চলে গেল। যাওয়ার সময় বলে গেল, প্রামানিক ভাই, বাস কিন্তু সকাল ছয়টায়। তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠবেন।


আমি ‘ঠিক আছে’ বলে সায় দিয়ে দিলাম।
ভোর থাকতেই রিপন আমাকে ঘুম থেকে ডেকে উঠালো। হাত মুখ ধুয়ে কাপড় পরে সকাল পৌনে ছয়টায় দু’জনে পল্টন মোড়ে এসে দাঁড়ালাম। যথা সময়ে বাস চলে এলো। আমরা বাসে উঠলাম।

পিছনের কিছু সিট ফাঁকাই থাকল। আমাকেসহ সর্বমোট ৪২জন। সকাল আটটার আগেই টাঙ্গাইল পৌছে গেলাম। সন্তোষের জমিদার বাড়ির সামনের রাস্তায় নেমে সবার সাথে আমিও স্লোগান ধরলাম। ইতিমধ্যেই অনেক লোক এসেছে।

বিশ্ব বিদ্যালয়ের মাঠ ভরে গেছে। এরা সবাই যে ভাসানী ন্যাপ পার্টি করে তা নয়। আওয়ামীলীগ বিএনপিসহ অনেক পার্টির লোক এসেছে। ঐদিন লোকজনের ভাব দেখে মনে হলো, মওলানা ভাসানী মজলুম জননেতা হিসেবে আসলেই একজন জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। দলমত নির্বিশেষে তার প্রতি সকলেরই শ্রোদ্ধাবোধ আছে।

স্লোগান দিয়ে সবাই মঞ্চের দিকে চলে গেলে, আমি রিপনের কাছে গিয়ে আস্তে আস্তে বললাম, রিপন, আমি একটু এই এলাকাটা ঘুরে দেখবো।
রিপন বলল, ভাই বেশি দুরে যাবেন না। আমরা কিন্তু বেশি দেরি করবো না।
আমি যেতে যেতে বললাম, ঠিক আছে, তাড়াতাড়িই ফিরবো।
আমি মাঠের পূর্ব পার্শ্বে সন্তোষের রাজবাড়ির ভিতরে ঢুকে পুরানো বিল্ডিংগুলো দেখে দক্ষিণ পার্শ্বে চলে এলাম।

সামনে ঘাট বাঁধানো বিশাল পুকুর। পানি টলটল করছে। পুকুরের পূর্ব পাড় দিয়ে দক্ষিণে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। একজন রিক্সাওয়ালা চাড়াবাড়ি চাড়াবাড়ি করে যাত্রী ডাকছে। চাড়াবাড়ির নাম শুনে মওলানা ভাসানীর সেই ঘটনা মনে পড়ে গেল।


ইংরেজ বেনিয়াদের শাসন আমল। সারা বাংলায় বন্যার প্রকোপে ধান পাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যা পরবর্তি প্রচন্ড অভাব। বিশেষ করে পূর্ববাংলায় অভাবের পরিমাণ বেশি। মানুষ না খেয়ে অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছে।

এমতোবস্থায় মওলানা ভাসানী অনেকগুলো মহাজনী বড় বড় নৌকা বোঝাই ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে এসে হাজির। নৌকার বহর চাপিয়েছেন সন্তোষ জমিদার বাড়ি থেকে দুইমাইল পশ্চিমে চাড়াবাড়ি ঘাটে। একটি নৌকায় ভাসান চর থেকে নিয়ে এসেছেন সাদা ভুটিয়া তেজী ঘোড়া। নৌকা থেকে ঘোড়া নামিয়ে ঘোড়ায় চরে সন্তোষের রাজার বাড়ির দক্ষিণ পার্শ্বের রাস্তা দিয়ে রওনা হয়েছেন। যাবেন করটিয়ার জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নীর বাড়িতে।

রাজার বাড়ির সামনে পৌঁছতেই হইহই রইরই করে পাইক, বরকন্দাজ, লাঠিয়ালরা এসে ভাসানীর ঘোড়ার লাগম টেনে ধরল। তার কারণ, রাজার বাড়ির সামনে দিয়ে প্রজাদের ঘোড়ায় চরে যাওয়া নিষেধ। লাঠিয়ালরা তাকে ঘোড়া থেকে নেমে হেঁটে যেতে বলল। মওলানা ভাসানী বললেন, এটা কার নির্দেশ?
লাঠিয়াল সর্দার বলল, এটা রাজার নির্দেশ।
ভাসানী মুচকী হেসে বললেন, তোমার রাজাকে যায়া কও ভাসান চরের মওলানা ঘোড়ায় চইরাই যাইবো।


একজন লাঠিয়াল দৌড়ালো রাজার কাছে, রাজা রাজ প্রাসাদের দোতালায় বারান্দায় বসা ছিলেন। রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখেন একে তো যবন, তার উপর লুঙ্গি ফতুয়া পড়া দাড়ি পাগরীওয়ালা মুসলমান মোল্লা। রাজা সাথে সাথেই চোখ রাঙিয়ে লাঠিয়ালকে বলে দিলেন, যে হুকুম তাই পালন করা হোক।
লাঠিয়াল দৌড়ে এসে বলল, রাজার হুকুম ঘোড়া থেকে নেমে যেতে হবে।
লাঠিয়ালের কথা শুনে মুহুর্তেই মওলানা অগ্নিমুর্তী ধারণ করে গর্জে উঠলেন।

বজ্রকণ্ঠে ধমক দিয়ে বললেন, তোর রাজারে যায়া কইস মওলানা ভাসানী পায়ে হাইটা সেই দিন যাইবো যেদিন এই রাজবাড়িতে বেগুনের টাল (সবজি বাগান) করবার পারবো। বলেই ঝটকা টান মেরে লাঠিয়ালের হাত থেকে লাগাম খুলে নিয়ে ঝড়ের বেগে ঘোড়ায় চড়ে চলে গেলেন। মওলানার কান্ড দেখে সারা রাজবাড়ি হইচই শুরু হয়ে গেল। রাজার মাথায় যেন বজ্রাঘাত হলো। রাজা মওলানাকে ধরার জন্য হুলিয়া জারী করে দিলেন।

কিন্তু ধরতে পারলেন না।
মওলানা ভাসানী তার বজ্রকণ্ঠের ঘোষিত সেই কথা ঠিকই বাস্তবায়ন করলেন। রাজার সমস্ত সম্পত্তি ছিল সম্রাট কর্তৃক ইসলাম প্রচারের জন্য ওয়াক্ফ সম্পত্তি। একসময় মওলানা ভাসানীর হাতে চলে আসে সম্রাট আওরঙ্গজেবের সইমোহরাংকিত তাম্রপাত্রে লিখিত সেই দলিল। ময়মনসিংহ আদালতে রাজার বিরুদ্ধে মামলা করলেন।

মামলায় রাজা পরাজিত হয়ে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গেলেন। মওলানা ভাসানী রাজবাড়ি দখল করেই বেগুনের টাল করলেন। তারপর পুরো রাজবাড়ি পায়ে হেঁটে বেড়ালেন।
সন্তোষের সেই রাজবাড়িটিই বর্তমানে মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
মওলানা ভাসানীর সেই কাহিনী মনে পড়তেই চাড়াবাড়ি ঘাট দেখার জন্য মনটা ছটফট করতে লাগল।

জিজ্ঞেস করলাম, চাড়াবাড়ি কতদুর?
রিক্সাওয়ালা বলল, দুই মাইল।
আমি বললাম, ভাড়া কত?
রিক্সাওয়ালা কি মনে করে যেন আমাকে আবার প্রশ্ন করল, আপনি কি চাড়াবাড়ি যাইবেন, না পোড়াবাড়ি যাইবেন?
রিক্সাওয়ালার প্রশ্ন শুনে আমিও পাল্টা প্রশ্ন করলাম, কোন পোড়াবাড়ি?
কিছুটা আশ্চার্য হয়ে রিক্সাওয়ালা বলল, আপনি পোড়াবাড়ি চেনেন না? পোড়াবাড়ির হাট চেনেন?
আমি আমতা আমতা করে বললাম, এটা কি চমচমের পোড়াবাড়ি।
রিক্সাওয়ালা এবার মাথা ঝাঁকিয়ে খুশি খুশি ভাব নিয়ে বলল, হ হ, এইটাই তো আসল চমচমের পোড়াবাড়ির হাট।
চমচমের পোড়াবাড়ির হাটের নাম শুনে মনটা আনন্দে নেচে উঠল। এতদুর এসে যদি পোড়াবাড়ি না যাই তা হলে মনের মধ্যে একটা আফসোস তো থাকবেই তারোপর আসল পোড়াবাড়ির চমচম না খেলে জীবনটাই অতৃপ্তির মধ্যে থেকে যাবে।

তাই রিক্সাওয়ালাকে বললাম, পোড়াবাড়ি হাটের ভাড়া কত?
রিক্সাওয়ালা বলল, আপনি কি একলাই যাইবেন না আমি একজন পেসান্দার নিমু?
আমি বললাম, একাই যাবো?
রিক্সাওয়ালা মাথাটা বাম দিকে কাত করে বলল, তাইলে দশ ট্যাকা নিমু।
জিজ্ঞেস করলাম, এখান থেকে কতদুর।
দুরুত্ব নিয়ে আমার ভীতিভাব যাতে না আসে সেই চিন্তা করে দুরুত্বটাকে সহজভাবে বুঝানোর জন্য মুখটা বিকৃত করে ডানবাম ঝাঁকি দিয়ে বলল, বেশি দুর না। মাত্র তিন মাইল।
আমি আর কোন প্রশ্ন না করে রিক্সাওয়ালাকে বললাম, ঠিক আছে চলেন।

বলেই রিক্সায় উঠে বসলাম।

(চলবে)।

সোর্স: http://prothom-aloblog.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.