একজন মানুষের পৃথিবীতে আগমন ঘটে নির্দলীয় পরিচয়ে। আশপাশের শিক্ষা নিয়ে সে বেড়ে ওঠে এবং লেখাপড়া শিখে সচেতনতা লাভ করে। সে কোন দলের সদস্য হবে সেটা তার সচেতনতার ওপর নির্ভর করে। সে ভোটার হওয়ার পর ভোট দেওয়ার মাধ্যমে প্রথম রাজনৈতিক ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। সে জন্য উন্নত গণতান্ত্রিক বিশ্বে স্থানীয় সরকারগুলোকে রাজনীতির অাঁতুড়ঘর বলা হয়। সেখানকার স্থানীয় সরকারগুলোকে স্বশাসন দেওয়া হয়েছে বহু আগে। তা ছাড়া সেখানকার রাষ্ট্রের সর্বত্র গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীরণ ঘটায় দলবাজি করার সুযোগ থাকে কম। কিন্তু এদেশে জাতীয় রাজনীতিতে এখনো গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি ও আচার-আচরণ প্রতিষ্ঠা পায়নি, সে অবস্থায় স্থানীয়তে দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন দেওয়া হলে স্থানীয়রা আরও দলবাজিতে লিপ্ত হয়ে পড়বে এবং ভিজিডি-ভিজিএফ বিতরণ ও রাস্তাঘাট নির্মাণসহ স্থানীয় কাজগুলো দলীয় বিবেচনায় বাস্তবায়ন হওয়া শুরু হবে। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি গণভবনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, স্থানীয় নির্বাচন শেষ পর্যন্ত নির্দলীয় থাকে না। নির্বাচনের ফলাফল কোনো না কোনোভাবে দলের ওপর বর্তায়। তাই স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী দেওয়া যায় কিনা ভাবতে হবে। তবে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করার আগে দলের সঙ্গে নির্বাচন কমিশন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সংলাপ ও গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা যেতে পারে (সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৪ ফেব্রুয়ারি) দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় নির্বাচন হলে দলের সাংগঠনিক ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। লক্ষণীয়, উপজেলা ব্যবস্থাকে অপছন্দ করার পরও বিএনপি এ নির্বাচন করছে শুধু সাংগঠনিক ক্ষমতা অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থে। সবার জানা রয়েছে, এদেশে স্থানীয় পর্যায়ের শাসনকে আইনি কাঠামো প্রদান করে ব্রিটিশ সরকার। তারা শাসনের প্রয়োজনে বহু স্তরবিশিষ্ট স্থানীয় সরকার সৃষ্টি করে। স্থানীয়তে তাদের সমর্থক গোষ্ঠী তৈরির উদ্দেশ্যে স্থানীয় সরকারগুলোকে কতকগুলো স্থানীয় কাজ করার জন্য স্বাধীনতা দেওয়া হয়। যদিও ব্রিটিশদের আগমনের আগেও এদেশের জনগণ স্থানীয় কাজগুলো নিজেরা উদ্যোগী হয়ে মিলেমিশে সম্পন্ন করত। এখনো ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনগুলোকে কতকগুলো বাধ্যতামূলক কাজ ও ঐচ্ছিক কাজ করার জন্য ক্ষমতা দেওয়া আছে। এই কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে করার জন্য জাতীয় রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা কতটুকু রয়েছে তা ভেবে দেখা দরকার। উদাহরণস্বরূপ_ একটি ড্রেন থেকে সৃষ্ট দুর্গন্ধ আওয়ামী লীগ-বিএনপির নেতা-কর্মীসহ সবার নাকে সমানভাবে লাগার কথা, সেজন্য ড্রেনটি যিনি সুন্দরভাবে পরিষ্কার রাখবেন তাকেই স্থানীয়রা যোগ্য মনে করবেন, এটাই নিয়ম হওয়ার কথা। কিন্তু তথাকথিত জাতীয় রাজনীতির প্রয়োজনে ভোট দেওয়া শুরু হওয়ায় সেই যোগ্যতা বিবেচনার বিষয়টি আর থাকছে না (গত বছর অনুষ্ঠিত কয়েকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেরকম ঘটনাই ঘটতে দেখা গেছে)। বলা হয়, উন্নত বিশ্বে স্থানীয় পর্যায়ে দলভিত্তিক নির্বাচন হচ্ছে, এদেশে হলে সমস্যা দেখায়! সেখানে গণতান্ত্রিক শাসনের দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের সম্পর্ক সমমর্যাদাপূর্ণ। সেখানে ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, ধনী, গরিব ইত্যাদি বিবেচনায় রাষ্ট্র বৈষম্যমূলক আচরণ করে না। রাষ্ট্রের সর্বত্র গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি ও আচার-আচরণের প্রাতিষ্ঠানিকতা রয়েছে। সেখানে আইনের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারের কাজ আলাদা করে দেওয়া আছে। স্থানীয় সরকারগুলো নাগরিক তৈরির কারখানা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। সরকারের কাজ হলো নাগরিকদের অর্জিত অধিকারগুলো রক্ষা করা। সেখানে সিভিল সোসাইটির দীর্ঘ সংগ্রামের ঐতিহ্যও রয়েছে। সিভিল সোসাইটির আন্দোলনকে তারা সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান পার্টি এক সময় দাসপ্রথা ও বর্ণপ্রথার পক্ষে ছিল। সিভিল সোসাইটির আন্দোলনের কারণেই পরবর্তী সময়ে সেসব নীতি পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু এদেশে 'স্থানীয় সরকার নামে আলাদা কোনো সরকার নেই। এদেশের বড় দল দুটির নেতানেত্রীরা দলের বাইরে মহৎ কোনো কর্মসূচি আছে বলে বিশ্বাসই করতে চান না। ফলে জাতীয় রাজনীতিতে সুস্থ কর্মকাণ্ড চর্চার থেকে অসুস্থ কর্মকাণ্ডে চর্চাই হয় বেশি। সেরকম রাজনীতি যদি স্থানীয়তে প্রয়োগ হওয়া শুরু হয়, তাহলে স্থানীয়তে যতটুকু গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ অবশিষ্ট আছে, ততটুকুও নিমিষে ধ্বংস হয়ে যাবে। সে জন্য সরকারের উচিত হবে, ভুল চিন্তা পরিত্যাগ করে স্থানীয় সরকারগুলোকে গণতান্ত্রিক করার বিষয়ে মনোযোগী হওয়া। সেক্ষেত্রে দুই প্রকারের সরকার ব্যবস্থা, তথা কেন্দ্রীয় সরকারব্যবস্থা ও স্থানীয় সরকারব্যবস্থা বাস্তবায়নের নীতি গ্রহণ করতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদগুলোকে গ্রামীণ কাজ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনগুলোকে নগরীয় কাজ করার জন্য একক ক্ষমতা দিয়ে দিতে হবে। গ্রামীণ ও নগরীয় কাজগুলো তত্ত্বাবধান করার জন্য জেলাকে সর্বোচ্চ ইউনিট হিসেবে ঘোষণা দিতে হবে। সেই সঙ্গে প্রতিটি স্থানীয় ইউনিটে প্রজাতান্ত্রিক রূপ দিয়ে (যেমন_ ইউনিয়ন সরকার, নগর সরকার, জেলা সরকার ইত্যাদি) স্থানীয়দের গণতান্ত্রিক ক্ষমতায়নসহ জাতীয়তেও একই সঙ্গে গণতন্ত্রায়নের কাজ শুরু করতে হবে। সে রকম ব্যবস্থা গ্রহণের পর স্থানীয়তে দলীয়-নির্দলীয় নিয়মে নির্বাচন শুরু করা যেতে পারে। তখন রাজনৈতিক দলগুলোতেও দুই ধরনের কমিটি, তথা স্থানীয় কমিটি ও জাতীয় কমিটি থাকবে। স্থানীয় কমিটি জাতীয় কমিটি থেকে মুক্ত থেকে স্বাধীনভাবে প্রার্থী বাছাই করবে (বর্তমানে স্থানীয় কমিটিগুলো জাতীয় কমিটির বর্ধিত অংশ হিসেবে কাজ করছে)। সেরকম ব্যবস্থা গৃহীত হলে শাসন ও উন্নয়ন কাজে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টিসহ বর্তমান বিশ্বের বহুল প্রচলিত 'ঞযরহশ মষড়নধষু, অপঃ ষড়পধষু' নীতির বাস্তবায়নও শুরু হবে।
লেখক : গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক। ঈশ্বরদী, পাবনা।
ই-মেইল : সঁংযধ. ঢ়পফপ@মসধরষ.পড়স
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।