আমি এমন এক সাধারন মানুষ হতে চাই যে অসাধারন হবার পেছনে দৌঁড়ায়না এবং বিনা প্রশ্নে কিছু গ্রহন করেনা ।
ছেঁড়া কম্বলটা নিয়ে শীতের মধ্যে কোনভাবে গায়ে জড়িয়ে শুয়ে থাকতে বেশ লাগছিলো ৬৮ বছরের কাশীনাথের । কাশিটা বড্ড বেড়েছে সেই দুপুর থেকে । কিছু খাওয়া যাও জুটেছিলো যুতমতো খাওয়া যায়নি । এর মধ্যে কোত্থেকে এসে নাতি গেদু এসে কম্বল ধরে টানাটানি করলে আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলেন না ।
প্রচন্ড কাশি থাকা অবস্থাতেই খেঁকিয়ে উঠে বললেন “ সর হতভাগার ছাও , শুইয়া থাকতে দে আমারে আর তুই ঘুমা । তোর বাপ – মায়ে মরছে তো মরছে মইরা গিয়াও আমারে জ্বালাইয়া খাইতেছে । আর পারিনা । “ গজগজ শেষ করতে না করতেই কাশীনাথের কাশি আরম্ভ হয়ে গেলো । মিনিট দুয়েক ধরে খুকখুক কাশিতে আকাশ – বাতাস প্রকম্পিত না হলেও কাশীনাথের দুর্বল শরীরের কলকব্জা নড়ে গেছে এমন মনে হতে লাগলো তার ।
নাতি গেদু তার বেঁচে থাকবার একমাত্র সম্বলের এই রুক্ষতা এবং অসহায়ত্বের কোনটাই সহ্য করতে পারলোনা । শব্দ না করলেও চোখ মুছতে মুছতে প্রায় অন্ধকার হয়ে আসা শহরের এক রাস্তা ধরেই কোথায় চলে গেলো ।
কাশীনাথ নাতির অভিমান স্পষ্ট বুঝতে পারলেন তবু তার উদ্দেশ্যে কিছু বলার কোন চেষ্টা করলেন না । সেই অবস্থাতে একেবারেই নেই । কাশির তীব্র আক্রমণে যেই জেরবার অবস্থা হয়েছে তার তাতে গলা উঁচু করে কিছু বলতে যাওয়ার মানেই হলো নিজের আরো বিপদ ডেকে আনা ।
সাথে গেদুটাকেও বিপদের সাগরের মধ্যে হাবুডুবু খাওয়ানো । পিচকা ছেলে এখনো কতো কিছুই দেখেনি বিপদ আপদের । রাস্তায় রাস্তায় তার সাথে বেওয়ারিশের মতো করে গু – মুতের মধ্যে পড়ে আছে অনেকদিন হলো তাতে কি হয়েছে ? আরো বছর দুয়েক অন্তত তার বেঁচে থাকতে হবে গেদুর জন্য । তারপরে সে নিজেই যা বুঝার সব বুঝে নিবে । কাশীনাথ আধবোঁজা চোখ মেলে চারপাশে তাকাতে চেষ্টা করলেন ।
তাকিয়েই যেই দৃশ্যটা দেখলেন সেটা ৬৮ বছরের জীবনে অসংখ্যবার দেখলেও এই সময়ে দেখবার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না । এক যুবক বয়সের কাউকে চোঁখ বেঁধে তিনটে ঠ্যাঙ্গাড়ে পুলিশ লাথি দিতে দিতে ধরে কই নিয়ে যাচ্ছে । চোখে পট্টি দিয়ে বেঁধে রাখা সেই যুবক কাশীনাথের আজন্ম অপরিচিত হলেও মুহূর্তের মধ্যেই ঘটনার প্রবাহে কাশীনাত্থের মনে হলো যেন সেই যুবক তার আত্মীয় বিশেষ ।
আশ্বিন কি কার্তিক মাসে হবে বৎসর পাঁচ আগে । বড় পোলা আর তার বউরে এমনেই মারতে মারতে কারখানার মধ্যেই মেরে ফেলছিলো পুলিশেরা ।
কাশীনাথ পরে জেনেছিলেন ট্রেড ইউনিয়নের নেতাই পল্টি খেয়ে বেতন বাড়ানোর আন্দোলন করা সবাইকে এমনে খুন করাইছে । পোলা আর পোলার বউসহ মোট বারোজনরে পুলিশ মেরে শুইয়ে দিয়েছিলো । একটা ঘসা পয়সা ক্ষতিপূরণের কথাও নিহতদের আত্মীয়স্বজনদের কেউ উচ্চারণ করতে সাহস পায়নি । তার অনেক আগের থেকেই কাশীনাথের পুলিশের উপরে বেজায় রাগ । বয়স যখন তার আঠারো ছিলো তখন গ্রামে সবার সামনে দিয়ে মধ্যে লাত্থি দিতে দিতে বড়জ্যাঠাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়েছিলো ।
কি কারণ ? তার বড়জ্যাঠা কি কমুনিস্ট না কমিউনিস্ট কি পার্টি করে আর ঘরে কি কি “ ভেঙ্গে দাও গুড়িয়ে দাও “ কথাবার্তার বইপত্র রাখে এই জন্যে । কিন্তু কাশীনাথ অনেক বয়স পর্যন্ত কোন হিসাবে মেলাতে পারতোনা । নিজের মনে কবিতা আওড়াতে থাকা বড়জ্যাঠা বরাবরই তার কাছে অনেক রহস্যে আবৃত এক প্রিয় চরিত্র ছিলো । কাশীনাথ আরো বড় হলে পরিষ্কার হাতেকলমে বুঝেছিলো বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা , পুলিশ ছুঁলে ছত্রিশ ঘা ।
এতোসব ভাবতে ভাবতে চোখ বাঁধা সেই যুবকের সাথে সাথে ঠ্যাঙ্গাড়ে পুলিশগুলো শহরের কোন রাস্তা বরাবর একটি নৃশংস এবং গতানুগতিক নাটক মঞ্চস্থ করতে চলে গিয়েছে সেটা কাশীনাথের ঠাহর হলোনা ।
বরং তার মস্তিষ্ক জুড়ে অগণিত স্মৃতির ঝাঁপি খুলে গেলো । সাথে বেশ কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে পুনরায় কাশি ফিরে আসলো সাড়ম্বরে । ছেঁড়া কম্বলের মধ্য দিয়ে কাশীনাথ কাশতে কাশতে বারবার কেঁপে উঠছেন আর তার শরীর থেকে সেই রুগ্নদশার কম্বল বারবার সরে যাচ্ছে । সেই রাস্তার একমাত্র যেই বাড়িটিতে এতোক্ষণ বাতি জ্বলে ছিলো সেই বাতিটাও হঠাৎ করে নিভে গেলো । সম্ভবত সেই বাড়ীর মানুষজনের নির্লিপ্ত থাকবার সময় হয়েছে ।
ঠিক এমন সময়তেই বেশ দূর থেকে রিকশার বেলের টুংটাং আওয়াজ কাশীনাথের কানে আসে । সেই রিকশা দিয়ে যাওয়া এক যুগলের ঝগড়ারত কথোপকথন এই নিস্তব্ধ রাস্তায় তীক্ষ্ণ ট্রেনের হুইসেলের শব্দের মতো শোনায় । কাশীনাথের হঠাৎ মৃতা স্ত্রী বালার কথা মনে পড়ে যায় । তাদের প্রথম সন্তান পাঁচ বছর বয়সে দুম করে একদিন মরে পড়ে ছিলো উঠান বরাবর । বালার উথালপাথাল আছড়ে পড়া আজও শিউরে উঠার মতো অনুভূতি এনে দেয় কাশীনাথের শরীরে ।
দুর্বল হাতজোড়া কি একটু কাঁপতে আরম্ভ করে তার ? অনেক আগে কাশীনাথ একবার লক্ষ্য করেছিলেন যে তীব্র আবেগে কিংবা ভয়ে শিউরে উঠলে তার হাতজোড়া এমনিতেই কেঁপে উঠতে শুরু করে ।
কেঁপে উঠা হাত নিয়ে বেশীক্ষণ চিন্তা করতে পারলেন না । গজ ষাটের দূরত্বে কি নিয়ে এই রাতের বেলাতেও কেন হইহই বেঁধেছে বুঝতে চেষ্টা করলেন । কেউ মরেছে নাকি ? কি জানি বাপু । মানুষের মরা তো পানি খাওয়ার মতোই সহজ জিনিস ।
দুম করে যে কোন সময়ে যে কেউই মরতে পারে । তিনি কিভাবে এই শরীরে এই শীতের মধ্যে কাশি নিয়ে বেঁচে আছেন তাই আশ্চর্যের । তিনটা কুকুর নিজেদের মধ্যে চিৎকার চিৎকার করতে করতে রাস্তা দিয়ে ছুটে গেলো । তাতে কর্ণপাত করবার জন্য রাস্তায় কেউ বসে নেই এই মুহূর্তে ।
তাদের মতোই আগুন পোহাতে আরো একটি পরিবার চলে আসলো রাস্তার শেষ মাথার কোনায় ।
কাশীনাথের চোখে পড়লোনা । এই অন্ধকারে তার সেটা দেখতে পাবার কোন কারণ নেই । সেই পরিবারের অল্পবয়ষ্কা এক নারী এই শীতের মধ্যেই আগুন পোহাতে পোহাতেই গান ধরলো । করুণ সুরের সেই গানের সাথে সাথে কেউ সামান্যতম গলা না মেলালেও প্রত্যেকেই তন্ময় হয়ে সেই গান শুনতে লাগলো । জনপদের এই বিপুল অংশের কোন আজাইরা ক্যারিকেচার নেই ।
আইন – কানুন , সংবিধান , দেশপ্রেম , নিয়ম-শৃঙ্খলা কোনকিছু নিয়ে মাথা ঘামিয়ে বিজ্ঞ হবার ভড়ং নেই । বেখাপ্পা , অর্ধশিক্ষিত সমাজে শাহেনশাহ হবার প্রতিযোগীতায় নেমে যাওয়ার তাড়না নেই । রেডিও , টেলিভিশন , পত্রিকা , বিলবোর্ডে নিজের বদন দেখাবার কোন বাসনা নেই । চোখ বুঁজে থেকে আবালের মতো প্রাজ্ঞ সেজে বসে থাকবার কোন অদম্য স্পৃহা নেই । কেবল আজকে কিভাবে বাঁচবে তার বন্দোবস্ত করো ।
সেটা করতে পারলে কাল সকালে ঘুম থেকে উঠে কোন জায়গার এঁটোকাঁটার মধ্যে গিয়ে উঠা যায় সেই চিন্তা করো । এক্কেবারে সোজা হিসাব , কোন বাড়তি এদিক – ওদিক ভাবনা নেই ।
রাত ক্রমশ বাড়তে থাকলে কাশীনাথ শীতের সাথে যুঝে আর বুঝি উঠতে পারেনা । তার মনে হতে থাকে যেন শরীরের সমস্ত হাড় জমে বরফের চাঁই হয়ে যাচ্ছে । কম্বলটা আরো শক্ত করে গায়ে জড়িয়ে রাখতে গিয়ে টের পেলো তাতেও কাজ হচ্ছেনা ।
ঠিক সেই সময়তেই অন্ধকারে আচমকা গেদুর কন্ঠ শোনা গেলো “ ওষুধটা লইয়া লও অক্ষণ , নাইলে কাশতে কাশতে আইজকাই মইরা যাইবা । “ প্রবল অন্ধকার ছিলো বলে কাশীনাথ দেখতে পেলোনা গেদুর শার্টের অর্ধভাগ ফালাফালা হয়ে আছে । সে আর জিজ্ঞেসও করলোনা ওষুধ যোগাড় হলো কিভাবে । জিজ্ঞেস করলেও গেদু জবাব দিতো নাকি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতো তাও তর্কসাপেক্ষ ।
রাত পৌনে এগারোটা বেজে চল্লিশ সেকেন্ডের মাথায় ওষুধটা গলায় ঢেলে কাশীনাথ যখন অপত্য স্নেহে গেদুকে ছেঁড়া কম্বলের মাঝেই টেনে আনলো তখন রাস্তার শেষ মাথায় আগুন পোহানো পরিবারের সেই অল্পবয়ষ্কা নারী আরেকটি গান ধরতে আরম্ভ করেছে ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।