রাজধানী ঢাকা ঘিরে আছে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদ-নদী। এগুলো ক্রমাগত দূষিত হচ্ছে শিল্পবর্জ্যে। পরিবেশ সংগঠনগুলোর গবেষণা বলছে, মাত্রাতিরিক্ত দূষণের কারণে নদীগুলোর মাছসহ অন্যান্য জীবের অস্তিত্ব হারাতে বসেছে প্রায়। দূষণের কারণে নদীর পানি ব্যবহারে হুমকিতে পড়ছে জনস্বাস্থ্য। অন্যদিকে পরিবেশ অধিদফতরের হিসাবে, খোদ অধিদফতরের মাধ্যমে পরীক্ষিত ১৩টি নদীর মধ্যে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও বালুর পানির মান খুবই খারাপ।
একসময়ের স্বচ্ছ নদীগুলো দূষণের কারণে আজ নোংরা ও দূষিত। পরিবেশবাদীরা বলছেন, সরকারের উদাসীনতা আর দায়িত্বহীনতার কারণেই নদীগুলোর দূষণ রোধ সম্ভব হচ্ছে না। অতিরিক্ত শিল্পবর্জ্যের কারণে নদীর পানি পরিশোধনের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। বাড়ছে পানিবাহিত রোগবালাই। একই কারণে তৈরি হচ্ছে পানের পানির সংকট।
জানা যায়, ঢাকায় পয়োবর্জ্যের পরিমাণ প্রায় ১৩ লাখ ঘন মিটার। এসব বর্জ্য পরিশোধনের জন্য ১ লাখ ২০ হাজার ঘন মিটার পরিশোধন ক্ষমতাসম্পন্ন ওয়াসার পরিশোধনাগার রয়েছে পাগলায়। অথচ সেখানে বর্জ্য পরিশোধন করা হচ্ছে মাত্র ৫০ হাজার ঘন মিটার। বাকি ১২ লাখ ৫০ হাজার ঘন মিটার বর্জ্য অপরিশোধিত অবস্থায় সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। এতে নদীর পানি তার গুণ হারাচ্ছে।
জলজ প্রাণীর ক্ষতি হচ্ছে। অন্যদিকে হাজারীবাগে অবস্থিত ট্যানারিগুলো থেকে প্রতিদিন যে পরিমাণ অপরিশোধিত বর্জ্য বুড়িগঙ্গা নদীতে পড়ছে, তাতে ক্রোমিয়াম, সিসা, সালফিউরিক এসিড ইত্যাদি থাকায় দূষিত হচ্ছে মারাত্দকভাবে। বহু আগেই এ ট্যানারিগুলো সাভার ও কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। এর বাইরে প্রতিদিন নদীগুলো ঘেঁষে থাকা বিভিন্ন শিল্প-কারখানা থেকে যে পরিমাণ বর্জ্য নদীতে পড়ছে, কারখানাগুলোর বর্জ্য পরিশোধনাগার না থাকায় তা নদীর পানির দূষণ ঘটাচ্ছে।
বুড়িগঙ্গার দূষণচিত্র : বুড়িগঙ্গার সেই নির্মল বাতাস এখন আর অনুভব করতে পারে না ঢাকাবাসী।
নেই সুস্বাদু মাছ আর জলজ প্রাণী। নেই ভ্রমণপিয়াসীদের নৌবিহারের সেই আগ্রহ। কারণ আগের সেই বুড়িগঙ্গা হারিয়েছে তার রূপ। নদীর পাড়ের শিল্প-কারখানা, ঢাকা সিটি করপোরেশন ও ওয়াসার পয়োবর্জ্যে বুড়িগঙ্গা এখন মৃত্যুপথযাত্রী। নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ, ডায়িং ও অন্যান্য শিল্প-কারখানার বর্জ্য নিঃসরণে বুড়িগঙ্গা ভয়াবহ দূষণের শিকার।
পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় দেখা যায় যে, নদীটির দূষণের জন্য শিল্পপতিরা ৬০ শতাংশ দায়ী। এসব নদী ঘিরে অবস্থান হাজার হাজার কারখানার। আর এর অধিকাংশে ইটিপি না থাকায় কারখানার উৎপন্ন বর্জ্য প্রকাশ্যে বা মাটির নিচ দিয়ে সরাসরি পড়ছে নদীতে। কিন্তু শিল্প মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগই নিচ্ছে না। অন্যদিকে ঢাকা ওয়াসা ও সিটি করপোরেশন পয়োসহ নানা রকম বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলছে।
সে হিসাবে এ সরকারি সংস্থাগুলো নদীদূষণের জন্য ৩০ শতাংশ দায়ী। বাকি ১০ শতাংশ দূষণ হচ্ছে মানুষের মাধ্যমে। পরিবেশ অধিদফতরের মতে, নদীটির পানিতে দ্রবীভূত অঙ্েিজনের পরিমাণ এতই কম যে এগুলোতে কোনো জলজ প্রাণী বা মাছ নেই। সরেজমিন দেখা যায়, নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা লালবাগ, হাজারীবাগ, কোতোয়ালি ও কামরাঙ্গীরচরের ঘরবাড়িগুলোর পয়োনিষ্কাশনের একমাত্র জায়গা এই বুড়িগঙ্গা। বেড়িবাঁধ-সংলগ্ন কামালবাগে নদী ছুঁয়ে শুকাতে দেওয়া হয়েছে প্লাস্টিক কারখানার কাঁচামাল।
এর পাশেই গৃহস্থালি বর্জ্যের বিশাল বেশ কয়েকটি স্তূপ। ঢাকার নবাবগঞ্জ এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা কাদের বলেন, 'এক যুগ আগে বুড়িগঙ্গায় গোসল করতাম। মাছ ধরতাম। বিকালে নদীর পাশে বসে গল্প করতাম। কিন্তু আজ বুড়িগঙ্গা মৃতপ্রায়।
পানি হয়ে পড়েছে বিষাক্ত। দুর্গন্ধযুক্ত এই পানির কারণে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এলাকার বাসিন্দারা। নদীপাড়ের আরেকটি এলাকা হাজারীবাগ। এখানে রয়েছে আড়াই শ'র বেশি ট্যানারি। এসব কারখানার কেমিক্যাল ও দূষিত বর্জ্য সরাসরি ফেলা হয় বুড়িগঙ্গায়।
এসব কারখানা ঘেঁষে নদীর পানি কোথাও ঘন কালো, কোথাও কালচে সবুজ বা হলুদ। বুড়িগঙ্গার পাশে ব্যস্ততম স্থান সদরঘাটে গিয়ে দেখা যায়, বড় বড় লঞ্চ ও স্টিমার থেকে নিঃসরিত হচ্ছে তেল; পানির ওপর ভাসছে এগুলোর বর্জ্য। পাশেই ফরাশগঞ্জ তরকারির আড়ত। তরিতরকারির উচ্ছিষ্ট ফেলা হচ্ছে বুড়িগঙ্গায়। এ বিষয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান জানান, সরকার নদীর পানি পরিষ্কার করার ওপর জোর দিচ্ছে।
কিন্তু সরকারকে নদীদূষণের মূল উৎস কল-কারখানাগুলো চিহ্নিত করে বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) মহাসচিব ড. মো. আবদুল মতিন এ বিষয়ে বলেন, বুড়িগঙ্গার দূষণের কারণে ঝুঁকির মুখে নদীর দুই পারে বসবাসরত মানুষের স্বাস্থ্য। নদীটির নিচে ৯ থেকে ১২ ফুট পলিথিনের স্তর জমেছে। আর এর দূষণ রোধে সরকার যে টাস্কফোর্স গঠন করেছে, তা যথেষ্ট নয়। এ ছাড়া ২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ বুড়িগঙ্গায় পরীক্ষামূলক দু-তিনটি বাঁধ নির্মাণ করেই দূষণ রোধ সম্ভব নয়।
বুড়িগঙ্গা বাঁচাতে সরকারকে আরও আন্তরিক হতে হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।