মানুষ স্বভাবতই বৈচিত্র পিয়াসী এবং নতুনত্বের স্বাদ আস্বাদনে উদগ্রীব। পৃথিবীর নানাপ্রান্তে যত প্রাণী, জড় ও বিচিত্র পরিবেশ বিদ্যমান রয়েছে সেসব জানার জন্য মানুষের রয়েছে অদম্য আগ্রহ। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের লোকালয় ও বনাঞ্চলে বিচরণকারী জন্তু জানোয়ার সচক্ষে দেখার স্বাদ আস্বাদন এক মজার পরিতৃপ্তি ও অভিজ্ঞতা। পৃথিবীর সর্ব প্রথম চিড়িয়াখানা প্রতিষ্ঠিত হয় লন্ডনে ১৮২৮ সালে। এখনতো পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই রয়েছে চিড়িয়াখানা।
গভীর বনের হিংস্র এবং অন্যান্ন নানান প্রাণী এসব চিড়িয়াখানায় খাঁচার ভেতরে রেখে প্রদর্শন করে জনগনের চিত্তবিনোদন এর উদ্দেশ্য।
মিরপুরে অবস্থিত ঢাকা চিড়িয়াখানা বাংলাদেশের সর্ববৃহত চিড়িয়াখানা। ১৮৬ একর জায়গার উপর প্রতিষ্ঠিত এই চিড়িয়াখানায় বর্তমানে ১৩৪ প্রজাতির দুই সহস্রাধিক প্রাণী রয়েছে। এতে উল্লেখযোগ্য প্রাণী সমূহের মধ্যে রয়েছে চিতা, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, বেবুন, জিরাফ, হাতি, হরিণ, শিম্পাঞ্জি ইত্যাদি। মানুষের প্রত্যাশা স্বভাবতই বেড়ে চলে।
ছোট পরিসরে এসব প্রাণীকে বন্দী অবস্থায় দেখে দেখে মানুষের আগ্রহ ও শিহরণের চাহিদা পূরণ হচ্ছিল না। নতুনত্বের সন্ধানে এরপর প্রচলন হয় সাফারী পার্কের। ১৯৬৩ সালে জাপানের টোকিওতে পৃথিবীর প্রথম সাফারী পার্কের পত্তন হয়। সাফারী পার্কের বৈশিষ্ট চিড়িয়াখানার বিপরীত। এতে প্রাণীকূল উন্মূক্ত প্রাকৃতিক পরিবেশে বিচরণ করে।
দর্শনার্থীরা নিরাপদে বাসে চড়ে, নিকটবর্তী পর্যবেক্ষণের স্থান থেকে মুক্ত বিচরণশীল হিংস্র প্রাণী দেখে আনন্দিত ও রোমাঞ্চিত হয়।
বাংলাদেশে সর্বপ্রথম সাফারী পার্ক কক্সবাজার জেলার চকোরিয়া উপজিলার ডুলাহাজারায় চালু হয়। কক্সবাজার থেকে এর দূরত্ব ৫৭ কিলোমিটার। এতে উম্নূক্ত বিচরনশীল হাতি, বাঘ, সিংহ, বানর, কুমির, ভাল্লুক সহ নানা প্রাণী ও বিভিন্ন পাখীর সমাহার হয়েছে। এর আয়তন প্রায় ২২০০ একর।
এতে রয়েছে ১৬৫ প্রজাতির প্রায় ৪০০০ প্রাণী । এটি দেশের একটি আকর্ষনীয় ট্যুরিস্ট স্পট।
তবে এশিয়ার বৃহত্তম সাফারী পার্কটি স্থাপিত হয়েছে ঢাকার সন্নিকটে গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজিলার বাঘের বাজারে। ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কের অনতিদূরে মনোরম বনজ পরিবেশে এটি প্রায় ৪০০০ একর জমির উপর স্থাপিত হয়েছে। সরকারী সিদ্ধান্তের আলোকে ৬৫ কোটি টাকায় এই প্রকল্পটি গৃহিত হয় এবং ২০১০ সাল থেকে এর বাস্তব কাজ শুরু হয়।
এতে বর্তমানে বিভিন্ন অবকাঠামোর মাঝে রয়েছে তথ্য ও শিক্ষা কেন্দ্র, নেচার হিস্ট্রি মিউজিয়াম, পার্ক অফিস, রেস্ট রুম, ডরমিটরী, ওয়াইল্ড লাইফ হসপিটাল, ক্রোকোডাইল পার্ক, লিজার্ড পার্ক, ফেঞ্চি ডাক গার্ডেন, বাটারফ্লাই গার্ডেন, মনিটরিং টাওয়ার ইত্যাদি।
সাফারী পার্কে উন্মূক্ত প্রাকৃতিক পরিবেশে চলাফেরাকারী প্রানী সমূহ দর্শনার্থীরা নিজস্ব বা সাফারী পার্ক কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত বাহনে চরে তাদেরকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পায়। মূলতঃ জনবিনোদনের সুযোগ তৈরী এবং বানিজ্যিক উদ্দেশ্যে এসব সাফারী পার্ক পরিচালিত হয়ে থাকে। এসব পার্কের প্রধান আকর্ষন হল আফ্রিকা সহ পৃথিবীর বিভিন্ন বিভিন্ন বনাঞ্চলের সিংহ, বাঘ, জিরাফ, ক্যাঙ্গারু, হাতি, জেব্রা, কুমির ইত্যাদি। সাফারী পার্ক আকারে চিড়িয়াখানার চেয়ে বড় হয়।
উদাহরন সরূপ কানাডার আফ্রিকান লায়ন সাফারীর আয়তন সাতশত পঞ্চাশ একর বা তিন বর্গ কিলোমিটার। কেনিয়ার লেক নাকারু সাফারীর আয়তন ১৬৮ বর্গ কিলোমিটার। ষাটের দশকে সারা পৃথিবীতে সাফারী পার্ক প্রতিষ্ঠার হিড়িক শুরু হয়। অধিকাংশ সাফারী পার্ক গুলোই ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশে সর্বশেষ সংযোজন গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলাধীন বাঘের বাজার সন্নিকটস্থ বংবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সাফারী পার্ক।
২০১৩ সালের ৩১ অক্টোবর শুভ উদ্বোধনের এর পর এটি দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেয়া হয়। এই পার্কটি নিঃসন্দেহে দেশের অন্যতম প্রধান ট্যুরিস্ট স্পট। মাত্র অল্প কমাস বয়সের পার্কটির ভবিষ্যত জৌলুস কল্পনা করে মনে আশার সঞ্চার হয়। যথাযথ পরিচর্যা বজায় থাকলে এটি নিকট ভবিষ্যতে ঢাকা নগরবাসী ও সমগ্র দেশবাসীর কাছে প্রধান দর্শনীয় স্থানে পরিনত হবে। বিশেষতঃ ঢাকার কাছাকাছি হওয়ায় এর বিপুল জনগোষ্ঠীর চিত্তবিনোদন ও অবসর সময় কাটানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
শিক্ষিত ও আধুনিক জাতি গড়ার জন্য এধরনের সুযোগ তৈরির প্রয়োজন রয়েছে। শুধু দেশের জনগন নয়, একই সাথে এটি আকর্ষন করবে বহু বিদেশী পর্যটক। রাজধানীর অনতিদূরে বিশাল এলাকা জুড়ে এই সাফারী পার্কটি আমাদের প্রত্যাশা ও স্বপ্ন এবং তা বাস্তবায়নে দৃঢতা ও সাফল্যের একটি উজ্জ্বল স্মারক। সুজলা সুফলা সবুজ এদেশটি প্রকৃতির অবারিত দানে ধন্য। এর সাথে আধুনিকায়ন ও বৈশ্বিক উন্নয়নের সাথে তাল মেলানোর এ ধারা চলমান থাকলে নিঃসন্দেহে তা দেশের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করবে।
দেশের অপার সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্পের বিকাশে এসব প্রয়াস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
একসময় মানুষ ছবিতে এবং চিড়িয়াখানায় জন্তু জানোয়ার দেখেই সন্তুষ্ট থাকত। এরপর বিগত কয়েক দশক ধরে টিভির বিভিন্ন চ্যানেলে ধারনকৃত জীব জানোয়ারের বিচরণ ও বাস্তব জীবনের ভিডিও দেখে রোমাঞ্চিত হত। ডিসকভারি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, এনিম্যাল প্ল্যানেট ইত্যাদি চ্যানেল সর্বাধিক জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল গুলোর মধ্যে অন্যতম। বর্তমানে সাফারী পার্কগুলো মানুষকে জীব জন্তুর আরো কাছাকাছি নিয়ে এসেছে।
এতে মানুষের জীবনে যেমন বৈচিত্র এসেছে, এসেছে বিনোদনের সহজ ও নির্দোষ সুযোগ।
গাজীপুরস্থ বঙ্গবন্ধু সাফারী পার্কে বর্তমানে দেশী বিদেশী ৩১ প্রজাতির প্রাণী রয়েছে। হিংস্র বাঘ ও সিংহ দেখার জন্য এদের বিচরণ এলাকার প্রান্তে রয়েছে বাঘ ও সিংহ রেস্তোঁরা। কাঁচের বেস্টনীর পাশে দাঁড়িয়ে খুবই নিকট থেকে বাঘ ও সিংহ দেখার সুযোগ রয়েছে। এসব রেস্তোঁরা গুলো সুনির্মিত গোলাকার, এসবে রয়েছে নানান পানীয় ও খাদ্য সামগ্রী।
পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা রয়েছে। পার্কের মূল ফটক দিয়ে ঢোকার পর বিশাল এলাকায় রয়েছে ফোয়ারা, নানান ভাস্কর্য ও লেক। সুপরিকল্পিত ভাবে বিভিন্ন ফুলের ও অন্যান্ন গাছ রোপন করা হয়েছে। এসব গাছ গাছালী পরিপক্ব হয়ে উঠলে এতে সৃষ্টি হবে এক নয়নাভিরাম পরিবেশ। এই পার্কটি বন অধিদপ্তরের আওতাধীন সরকারী সম্পত্তি।
বর্তমানে এটি পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণে দর্শনার্থীদের ব্যয়ও অতি সামান্য। পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের প্রবেশ মূল্য লাগেনা, বাকীদের জন্য পঞ্চাশ টাকা। জনপ্রতি পঞ্চাশ টাকায় মিনিবাস অথবা পিকআপে চড়ে এলাকার ভেতর দিয়ে ঘুরে বন্য জন্তুগুলোর কাছ থেকে তাদের দেখার সুযোগ রয়েছে। রেস্টুরেন্টগুলোয় জনপ্রতি ১৬০ টাকায় দুপুরের খাবার ব্যবস্থা রয়েছে। উন্নয়ন কাজ এখনো অব্যহত রয়েছে।
তবে অভ্যন্তরীণ উন্নয়নের সাথে সাথে বাঘবাজার থেকে পার্ক পর্যন্ত রাস্তাটি আরো প্রশস্ত করা দরকার। আশা করা যায় আর কবছর পর অনুপম এক স্বপ্নপুরী হয়ে উঠবে এই সাফারী পার্কটি। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।