ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর লাগামহীন টিউশন ফি ও স্বেচ্ছাচারিতা দিন দিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। একেক স্কুলে একেক রকম বেতন। সেই সঙ্গে ভর্তি ফি, বার্ষিক ফিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করা হচ্ছে। প্রথম সারির ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের প্লে গ্রুপের একটি শিশুকে ভর্তি করতে হলে ২ লাখ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা লাগে। সেই সঙ্গে লাগাম ছাড়া মাসিক বেতন ও শিক্ষার নামে টাকা কামানোর সুযোগ কাজে লাগিয়ে অলিগলিতে গজিয়ে উঠেছে বিভিন্ন নামের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। এসব স্কুলের কারিকুলামে সমন্বয় নেই। স্কুলগুলোয় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করলেও শিক্ষকদের বেতন যৎসামান্য। কোনো কোনো স্কুলে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা শিক্ষকদের বেতন দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। অথচ এ প্রতিষ্ঠানগুলো মনিটরিং করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি শাখা থাকলেও সংশ্লিষ্টরা এ ব্যাপারে উদাসীন। স্কুলগুলোর অনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে অভিযোগের পাহাড় থাকলেও কোনো খোঁজখবর এবং এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। তবে এর কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশে অবস্থিত প্রথম সারির ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর পরিচালক এবং মালিকরা ক্ষমতাবান ব্যক্তি ও প্রভাবশালী। বিষয়টি নিয়ে কেউ নাড়াচাড়া করলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরই চাপে পড়তে হবে। সে কারণে যে-যার মতো করে চালাচ্ছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে 'বেসরকারি বিদ্যালয় নিবন্ধন বিধিমালা, ২০০৭'-এর নিয়ম অনুসারে পরিচালিত হয়। বিধিমালায় বলা আছে_ এসব প্রতিষ্ঠানের ভর্তি ফি এবং মাসিক বেতন বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি অথবা মালিক নির্ধারণ করবে। অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান আর্থিক বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। তবে এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা সংশ্লিষ্ট প্রশাসন পরামর্শ প্রদান করতে পারবে। আরও জানা গেছে, ব্রিটিশ কিংবা এডেঙ্েেলর সিলেবাস অনুসরণ করে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করে ব্রিটিশ কাউন্সিলের মাধ্যমে পরীক্ষা দিলেও কতজন কী পরীক্ষা দিল, কত টাকা আদায় করা হলো সেসব বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কোনো তথ্য নেই।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ২০১২ সালের শেষের দিকে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের নেতৃত্বে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কয়েকটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে সভাগুলোয় ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, অধ্যাপক ফকরুল আলম, ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ ও রাশেদা কে চৌধুরী, সংসদবিষয়ক সচিব, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক এবং ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানও অংশ নিয়েছিলেন। তা ছাড়া বিভিন্ন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের স্বত্বাধিকারীরাও সভায় উপস্থিত ছিলেন। এ সময়ে নীতিমালাটি পর্যালোচনা করে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি নতুন নীতিমালা করার উদ্যোগ নিলে তা না করতে প্রতিষ্ঠান মালিকরা নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করেন এবং আগের নীতিমালার বিষয়টি উপস্থাপন করেন। ফলে নতুন নীতিমালা তৈরির কাজ সেখানেই থেমে যায়। আর এ সুযোগে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের কর্মকাণ্ড। এ প্রসঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এ এস মাহমুদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ২০০৭-এর নীতিমালায় বলা আছে_ অর্থ নির্ধারণ করবে ম্যানেজিং কমিটি। তার পরেও কয়েকবার সভা হয়েছিল ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে। কিন্তু পরে কাজ আর এগিয়ে যায়নি। জানা গেছে, রাজধানীর মিরপুর-১৩-তে অবস্থিত স্কলাস্টিকা স্কুলের প্লে গ্রুপে ভর্তি ফি দিতে হচ্ছে দেড় লাখ টাকা। বেতন দিতে হচ্ছে প্লে গ্রুপে ১১ হাজার, ক্লাস ওয়ানে ১০ হাজার ১০০, ক্লাস টুতে ১০ হাজার ৩০০, ক্লাস ফাইভে ১০ হাজার ৭০০ টাকা। প্রতি বছর এ টাকার অঙ্ক ধারাবাহিকভাবে বেড়েই চলছে। এ প্রতিষ্ঠানটির উত্তরা, গুলশান, ধানমন্ডিতে ছয়টি শাখা ক্যাম্পাসও রয়েছে।
ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার ২৭ নম্বরের অঙ্ফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে প্লে গ্রুপে ভর্তি ফি দিতে হয় ৬০ হাজার টাকা। আর প্রতি তিন মাসে বেতন গুনতে হচ্ছে ২৫ হাজার টাকা। প্রতিষ্ঠানটির গুলশান, উত্তরা ও বনশ্রীতে আলাদা শাখাও রয়েছে। উত্তরা মডেল টাউনের ৯ নম্বর সড়কের ৪ নম্বর সেক্টরে রয়েছে আগা খান স্কুল। প্রতিষ্ঠানটিতে কে জি ওয়ানে ভর্তি ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। মাসিক বেতন ১০ হাজার টাকা। বারিধারার আমেরিকান অ্যাম্বাসি রোডের আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে প্লে গ্রুপে ভর্তি ফি ২৭ হাজার ৩৫০ ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় ২১ লাখ ৮৮ হাজার। প্রতি ছয় মাসে সেশন ফি দিতে হয় ১৭ হাজার ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় ১৩ লাখ ৬০ হাজার। উত্তরায় ৬ নম্বর সেক্টরের ১৩ নম্বর সড়কের ৪ নম্বর প্লটে দিলি্ল পাবলিক (ডিপিএস এসটিএস স্কুল) স্কুলে গ্রেড ওয়ানে ভর্তি ফি নেওয়া হয় ৩ লাখ টাকা। আর মাসিক বেতন ৬ হাজার টাকা। ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার ৭ নম্বর রোডের ৩৪ নম্বর বাড়ির সানিডেল স্কুলে প্লে গ্রুপে ভর্তি ফি নেওয়া হয় ৬০ হাজার টাকা। মাসিক বেতন দিতে হয় ৩ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকা। ধানমন্ডিতেই এ প্রতিষ্ঠানটির তিনটি সেকশন রয়েছে। তা ছাড়াও হার্ডকো ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ঢাকা (আইএসডি), মাস্টার মাইন্ড, মেপ্যাল লিফ, ইন্টারন্যাশনাল টার্কিশ হোম স্কুল, হিড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল, আরব মিশন পাবলিক স্কুলসহ প্রায় ১৮ হাজার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানেও শিক্ষার্থী ভর্তিতে নেওয়া হয় লাখ লাখ টাকা। ইংরেজি মাধ্যমধারী এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ কিংবা এডেঙ্লে কারিকুলাম পড়ানোর কথা বলে একাধিক শাখা ক্যাম্পাস ব্যবহার এবং ভর্তি আর বেতনে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কিছু বলে না এবং করে না।
এসব বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বরাবরের মতোই বলে আসছেন স্কুলগুলোর ব্যাপারে নীতিমালা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এগুলোকে নীতিমালার আওতায় আনার চেষ্টা করছি। সেখানে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্থ নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি নিয়মও বেঁধে দেওয়া হবে।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।