রুই-কাতলাদের বাদ দিয়েই বহুল আলোচিত দেশের বৃহত্তম হলমার্কের অর্থ কেলেঙ্কারির ১১ মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করা হয়েছে। এতে হলমার্ক কেলেঙ্কারির মূল নায়ক প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তানভীর মাহমুদসহ ২৫ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের ১৩ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। বাকিরা হলমার্ক গ্রুপের।
ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে গতকাল বিকাল সাড়ে ৩টায় এ অভিযোগপত্র দাখিল করেন দুর্নীতি দমন কমিশনের উপ-পরিচালক মীর জয়নুল আবেদিন শিবলী। অভিযোগপত্রের সঙ্গে সোনালী ব্যাংক ও হলমার্ক থেকে জব্দ করা কয়েক হাজার নথিপত্রও জমা দেওয়া হয়েছে, যার ওজন প্রায় এক টন। প্রায় এক বছর ধরে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটির তদন্ত টিম দেড় টনের বেশি নথিপত্র জব্দ করে। সেগুলো থেকে যাচাই-বাছাই করে আদালতে উপস্থাপন করা নথিপত্রের ওজন হয়েছে প্রায় এক টন।
দুদকের তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এর আগে কোনো মামলার চার্জশিটে দুদক এ পরিমাণ নথিপত্র আদালতে পেশ করেনি। আজ অভিযোগপত্রটি আদালতে উপস্থাপন করা হবে। এর আগে রবিবার রাজধানীর রমনা মডেল থানা থেকে ১১ মামলার অভিযোগপত্রের নম্বর নেওয়া হয়। অভিযুক্ত আসামিদের মধ্যে সাতজন কারাগারে আটক রয়েছেন। জামিনে আছেন হলমার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম। বাকিরা পলাতক।
আদালতে দুদকের প্রসিকিউটিং বিভাগের কর্মকর্তা আবদুর রশিদ জানান, এসব মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে মোট ৮০ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। মহানগর হাকিম আতাউল হকের আদালতে এসব অভিযোগপত্র উপস্থাপন করা হবে বলে জানান তিনি।
১৫ সেপ্টেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশন এই ১১ মামলার তদন্ত প্রতিবেদনের অনুমোদন দেয়। প্রতিবেদনের আলোকে দুদকের সিনিয়র উপ-পরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলীর নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি বিশেষ টিম ২২ দিনে ১১ মামলার অভিযোগপত্র তৈরি করে।
একাধিক সূত্র জানায়, হলমার্ক কেলেঙ্কারি ফাঁসের পর অভিযুক্তদের কাছ থেকে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম বেরিয়ে এলেও অভিযোগপত্রে এদের কারও নাম নেই। দেশের বৃহত্তম এই অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনার সঙ্গে যাদের সম্পৃক্ততা ছিল বলে তদন্তে বেরিয়ে এসেছিল, অভিযোগপত্রে তাদের কারও নাম না থাকায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। চুনোপুঁটিদের আসামি করেই রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের সর্ববৃহৎ অর্থ কেলেঙ্কারি ঘটনার তদন্ত আপাতত শেষ করা হচ্ছে। সূত্র মতে, অভিযোগের অনুসন্ধান ও তদন্ত পর্যায়ে অর্থ কেলেঙ্কারিতে অনেক প্রভাবশালীর নাম উঠে এসেছিল। হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় সংসদ সদস্য তাজুল ইসলামের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের সংসদীয় সাব-কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে সরকারের একজন প্রভাবশালীর নামও জানা যায়।
ঋণ কেলেঙ্কারির মামলায় অভিযোগপত্রে আসামিরা হলেন হলমার্কের এমডি তানভীর মাহমুদ, তার স্ত্রী, গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম, তানভীরের ভায়রা, গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক তুষার আহমেদ। অন্যরা হলেন হলমার্ক গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান অ্যাপারেল এন্টারপ্রাইজের মালিক শহিদুল ইসলাম, স্টার স্পিনিং মিলসের মালিক জাহাঙ্গীর আলম, টি অ্যান্ড ব্রাদার্সের পরিচালক তসলিম হাসান, ম্যাঙ্ স্পিনিং মিলসের মালিক মীর জাকারিয়া, সেঞ্চুরি ইন্টারন্যাশনালের মালিক জিয়াউর রহমান, আনোয়ারা স্পিনিং মিলসের মালিক জাহাঙ্গীর আলম, প্যারাগন গ্রুপের এমডি সাইফুল ইসলাম রাজা, নকশী নিটের এমডি আবদুল মালেক ও সাভারের হেমায়েতপুরের তেঁতুলঝোড়া ইউপি চেয়ারম্যান মো. জামাল উদ্দিন সরকার। নাম রয়েছে সোনালী ব্যাংক রূপসী বাংলা (আগে হোটেল শেরাটন) শাখার সাময়িক বরখাস্ত হওয়া ব্যবস্থাপক এ কে এম আজিজুর রহমান, সহকারী উপ-মহাব্যবস্থাপক সাইফুল হাসান, নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল মতিন ও সোনালী ব্যাংক ধানমন্ডি শাখার বর্তমান জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুন্নেসা মেরির। এ ছাড়া প্রধান কার্যালয়ের জিএম অফিসের দুই জিএম ননী গোপাল নাথ ও মীর মহিদুর রহমান (দুজনই ওএসডি), প্রধান কার্যালয়ের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন কবির, ডিএমডি মাইনুল হক ও আতিকুর রহমান (দুজনই ওএসডি), দুই উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) শেখ আলতাফ হোসেন (সাময়িক বরখাস্ত) ও সফিজউদ্দিন আহমেদ (সাময়িক বরখাস্ত), দুই এজিএম কামরুল হোসেন খান (সাময়িক বরখাস্ত) ও এজাজ আহম্মেদেরও নাম রয়েছে অভিযোগপত্রে।
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনায় গত বছরের ৪ অক্টোবর ২৭ জনকে আসামি করে রাজধানীর রমনা থানায় ১১টি মামলা করে দুদক। সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা হোটেল শাখা থেকে (সাবেক শেরাটন) আত্দসাৎকৃত ২ হাজার ৬৮৬ কোটি টাকার মধ্য থেকে ফান্ডেড অংশের ১ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা আত্দসাতের অভিযোগে এই ১১ মামলা করা হয়। প্রতারণা, জালিয়াতি, অর্থ আত্দসাৎ, পরস্পরের যোগসাজশ, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অর্থের অপব্যবহার এবং মুদ্রা পাচারের অভিযোগ আনা হয় আসামিদের বিরুদ্ধে। হলমার্ক কর্তৃক আত্দসাৎকৃত নন-ফান্ডেড আরও ১ হাজার কোটি টাকা আত্দসাতের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করা হয়েছে।
দুদকের সিনিয়র উপ-পরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলীর নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি বিশেষ টিম জাল-জালিয়াতি করে সোনালী ব্যাংক থেকে অর্থ লুটে নেওয়ার অভিযোগে দায়ের করা ১১ মামলার অভিযোগ তদন্ত করে। টিমের অন্য সদস্যরা হলেন উপ-পরিচালক এস এম এম আখতার হামিদ ভূঞা, সহকারী পরিচালক মো. নাজমুচ্ছায়াদাত, মশিউর রহমান, উপ-সহকারী পরিচালক মুজিবুর রহমান, মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীন ও সেলিনা আখতার মণি।
হেমায়েতপুরে হলমার্ক গ্রুপে উচ্ছেদ অভিযান : সাভার সংবাদদাতা জানান, সাভারের হেমায়েতপুরের তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়নের নন্দখালী মৌজায় হলমার্ক গ্রুপের দখল করা সরকারি খাস জমি উদ্ধারে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হয়েছে। গতকাল বেলা ১১টায় ঢাকা জেলা পরিষদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আসাদুজ্জামানের নেতৃত্বে সাভার উপজেলা সহকারী কমিশনার লিয়াকত হোসেনসহ স্থানীয় ভূমি অফিসের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে এ অভিযান পরিচালনা করা হয়। দেশের আলোচিত হলমার্ক গ্রুপের অবৈধ দখলে থাকা জমি পুনরুদ্ধারে এ অভিযান পরিচালনা করা হয় বলে জানিয়েছেন ঢাকা জেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। উপজেলা ভূমি কর্মকর্তা লিয়াকত হোসেন জানান, উচ্ছেদ অভিযানে প্রায় ৫.২৪ একর খাস জমি ও রাস্তা উদ্ধার করা হয়েছে।
সাভার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল জানান, হলমার্ক গ্রুপের দখলে থাকা সরকারি জায়গা পুনরুদ্ধারে হেমায়েতপুরের তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়নের নন্দখালী মৌজায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুরো এলাকায় বিপুল সংখ্যক আনসার ও পুলিশ মোতায়েন রাখা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।