অতিমাত্রায় সাধারণ
এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে। এ নিয়ে জনমনে বেশ অসন্তোষ দেখতে পাচ্ছি। কেহ কেহ বলছে বিম্পি সরকার তো এতবার বিদ্যুতের দাম বাড়ায়নি। আমি তাদের বলবো- বিম্পি কি বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে নাকি যে দাম বাড়াবে? টংগীতে যাও একটি ৩৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির কথা ছিলো সেটাও হয় নাই। বিদ্যুৎ খাতের সমস্ত টাকা দিয়া তারেক বন্ধুর খাম্বার ব্যবসা থেকে খাম্বা কিনে দেশ সয়লাব করে ফেলেছে।
ঘোড়া না কিনে জিন কিনেছে বড় গনতন্ত্র।
যাহোক, আসুন এক নজরে দেখে নেই দাম বৃদ্ধির সত্যিকার চিত্র...
* গ্রাহকশ্রেণী-নির্বিশেষে প্রতি ইউনিট (এক কিলোওয়াট ঘণ্টা) বিদ্যুতের দাম বেড়েছে গড়ে ৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ।
* কৃষিতে সেচের জন্য ব্যবহূত বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়নি।
* সবচেয়ে গরিব গ্রাহক, যাঁরা প্রতি মাসে ৫০ ইউনিট পর্যন্ত ব্যবহার করবেন, তাঁদের জন্য একটি নতুন ধাপ (স্লাব) তৈরি করে দাম অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
তবে যেসব গ্রাহক ৫০ ইউনিটের বেশি ব্যবহার করবেন, তাঁরা এই ধাপের সুবিধা পাবেন না।
অর্থাৎ ব্যবহার ৫১ ইউনিট হলেই সম্পূর্ণ বিদ্যুতের দাম বর্ধিত হারে দিতে হবে।
* দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে যত বেশি ব্যবহার, তত বেশি বিল— এ নীতির প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে। এতে সম্পন্ন বা ধনী আবাসিক গ্রাহকের ওপর মূল্যবৃদ্ধির হার বেশি বর্তাবে।
* দাম বাড়ানোর আদেশ ঘোষণার সময় সংবাদ ব্রিফিংয়ে বিইআরসির চেয়ারম্যান এ আর খান বলেন, এবারের দাম বাড়ানোর ফলে বিতরণ কোম্পানিগুলো ‘না লাভ, না ক্ষতি’ (ব্রক ইভেন) পর্যায়ে পৌঁছাবে।
* আসন্ন গরমে কেবল নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেয়ার স্বার্থে একটি বাদে বাদবাকী সারকারখানা বন্ধ রাখার নীতিগত সিদ্ধান্ত এর মধ্যেই নেয়া হয়ে গেছে।
নতুন দাম অনুযায়ী যে গ্রাহক-
সর্বোচ্চ ৭৫ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করবেন, তাঁর মাসিক বিল আগের চেয়ে বেশি হবে ১৫ টাকা।
সর্বোচ্চ ১০০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করবেন, তাঁর মাসিক বিল আগের চেয়ে বেশি হবে ২২ টাকা।
সর্বোচ্চ ১৫০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করবেন, তাঁর মাসিক বিল আগের চেয়ে বেশি হবে ৩৬ টাকা।
সর্বোচ্চ ২০০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করবেন, তাঁর মাসিক বিল আগের চেয়ে বেশি হবে ৫০ টাকা।
সর্বোচ্চ ২৫০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করবেন, তাঁর মাসিক বিল আগের চেয়ে বেশি হবে ৬৮ টাকা।
সর্বোচ্চ ৩০০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করবেন, তাঁর মাসিক বিল আগের চেয়ে বেশি হবে ৮৬ টাকা
সর্বোচ্চ ৩৫০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করবেন, তাঁর মাসিক বিল আগের চেয়ে বেশি হবে ১১১ টাকা।
সর্বোচ্চ ৪০০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করবেন, তাঁর মাসিক বিল আগের চেয়ে বেশি হবে ১৩৫ টাকা।
সর্বোচ্চ ১০০০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করবেন, তাঁর মাসিক বিল আগের চেয়ে বেশি হবে ৪৬১ টাকা।
এইভাবে পর্যায়ক্রমে যিনি যত বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করবেন, তাঁর বিলও তত বেশি বাড়বে। নিম্ন-মধ্যবিত্ত ৫/৬ জনের একটি পরিবারের সচরাচর সর্বোচ্চ ২৫০ ইউনিট এর বেশি কোনভাবেই ব্যবহার হওয়ার কথা নয়।
সেক্ষেত্রে তার বিদ্যুৎ বিল দৈনিক মাত্র ২ টাকা বাড়বে। এ পরিমাণটা নিশ্চয়ই অসহনীয় নয়...
এবার গড়ে দাম বাড়ানো হয়েছে ৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ। এর মধ্যে-
পিডিবির গ্রাহকদের ক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধির গড় হার ৭ দশমিক ১৭ শতাংশ।
ডিপিডিসির গ্রাহকদের ক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধির গড় হার ৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
ডেসকোর গ্রাহকদের ক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধির গড় হার ৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
পল্লী বিদ্যুত গ্রাহকদের ক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধির গড় হার ৫ দশমিক ৪১ শতাংশ।
ওজোপাডিকো গ্রাহকদের ক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধির গড় হার ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ।
বর্তমান সরকারের আমলে এই প্রথম বিদ্যুতের গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়ানো হলো। এর আগে
২০০৮ সালের ১ অক্টোবর পাইকারি পর্যায়ে ১৬ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়।
২০১০ সালের ১ মার্চ গ্রাহক পর্যায়ে ৫ শতাংশ দাম বাড়ানো হয় ।
২০১১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পাইকারি পর্যায়ে ১১ ও গ্রাহক পর্যায়ে ৫ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়।
২০১১ সালের ১ আগস্ট পাইকারি পর্যায়ে ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়।
২০১১ সালের ১ ডিসেম্বর পাইকারি পর্যায়ে ১৬ দশমিক ৭৯ ও গ্রাহক পর্যায়ে ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়।
২০১২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পাইকারি পর্যায়ে ১৪ দশমিক ৩৭ ও গ্রাহক পর্যায়ে ৭ দশমিক ০৯ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়।
২০১২ সালের ১ সেপ্টেম্বর পাইকারি পর্যায়ে ১৬ দশমিক ৯২ ও খুচরা পর্যায়ে ১৫ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়।
২০১৪ সালের ১৩ মার্চ (আজ) গ্রাহক পর্যায়ে ৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ দাম বাড়ানো হয় ।
এখন আসুন একটা গড় হিসাব করি। ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত-
গ্রাহক পর্যায়ে ৬ টি ধাপে মোট (৫ + ৫ + ১৩.২৫ + ৭.০৯ + ১৫ + ৬.৯৬) % = ৫২.৩০ % এবং
পাইকারী পর্যায়ে ৬ টি ধাপে মোট (১৬ + ১১ + ৬.৬৬ + ১৬.৭৯ + ১৪.৩৭ + ১৬.৯২) % = ৮১.৭৪ % মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে।
অর্থাৎ পাইকারী পর্যায়ে গ্রাহক পর্যায়ের চাইতে ২৯.৪৪ % মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। আর এটি করা হয়েছে মূলত গ্রাহকদের স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখে।
কারণ দিন শেষে এসব ভোটের বাজারে প্রভাব ফেলে। তারপরও যদি বলেন সরকার জনগণের মাথার বোঝার উপর শাকের আটিঁ চাপিয়ে দিচ্ছে তাহলে আপনাকে আমি স্রেফ অকৃতজ্ঞ বলবো।
২০০৮ সালেও গ্রাহক পর্যায়ে ও পাইকারী পর্যায়ে ইউনিট প্রতি মূল্যের ব্যবধান যথেষ্ট ছিল। ফলে কোম্পানিগুলোকে সিস্টেম লস, কর্মচারী-কর্মকর্তার বেতন, স্থাপনা ও বৈদ্যুতিক সামগ্রী রক্ষণাবেক্ষণ কার্যে যে খরচ দিতে হতো তার জন্য সরকারকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খুব বেশি ভর্তুকি দিতে হতো না (দুয়েকটি কোম্পানিকে একেবারেই দিতে হতো না)। ধীরে ধীরে সরকার যখন পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে অসামঞ্জস্য হারে মূল্য বৃদ্ধি করতে লাগলো তখন ভর্তুকির পরিমাণ গেল বেড়ে।
সে কারণেই সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমন্বয়ে গ্রাহক সেবা বৃদ্ধির সাথে সাথে কোম্পানিগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সার্ভিস লাইন বৃদ্ধি করে সিস্টেম লসের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমাতে সম্ভব হলো। এছাড়াও বিদ্যুৎ সেক্টরে "ওয়ান পয়েন্ট" (এক অবস্থানে সেবা) নামক অসাধারণ অথচ বিনামূল্যে সেবা প্রদান ব্যবস্থা চালু করায় গ্রাহকসেবার মান অনেকাংশে বেড়েছে, কমেছে ভোগান্তির পরিমাণ। আর সর্বশেষ সংস্করণ ই-সেবা তো গ্রাহকের কাজকে আরো সহজ করে দিয়েছে।
যাহোক, আসুন আবারো প্রথম দিকে বলা একটা পয়েন্ট লক্ষ্য করি।
দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে যত বেশি ব্যবহার, তত বেশি বিল— এ নীতির প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে।
এতে সম্পন্ন বা ধনী আবাসিক গ্রাহকের ওপর মূল্যবৃদ্ধির হার বেশি বর্তাবে।
এর পরেও মানুষ সরকার বা কোম্পানিকে গালি দেয় ক্যানো সেটাই আমার বুঝে আসেনা। যে লোক মাসে কয়েক হাজার ইউনিট ব্যবহার করবে তার অবশ্যই সেটার মূল্য পরিশোধ করার ক্ষমতা আছে।
এখন আসুন আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ইন্ডিয়ার সাথে আমাদের বিদ্যুৎ বিলের একটা তুলনা দেখি-
২০১০ সালের হিসেব অনুযায়ী প্রতি ১০০ ইউনিট বিদ্যুৎ এর জন্য
ইন্ডিয়ান গ্রাহকদের খরচ হয় ৩৬৬ টাকা
বাংলাদেশী গ্রাহকদের খরচ হয় ২৬০ টাকা
২০১০ সালের পর বাংলাদেশে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৪৭.৩০% (৫ + ১৩.২৫ + ৭.০৯ + ১৫ + ৬.৯৬) %
সে হিসেবে ৪ বছর পর ২০১৪ সালে আমাদের গ্রাহকদের খরচ হবে অতিরিক্ত ১২৩ টাকা। তাহলে সর্বসাকুল্যে খরচ হবে (২৬০ + ১২৩) = ৩৮৩ টাকা।
অপরদিকে সমপরিমাণ বিদ্যুতের ক্ষেত্রে ভারতীয় গ্রাহকের খরচ পড়ে ৫৫০-৬৫০ টাকা (প্রদেশভেদে আরো বেশী হতে পারে)।
তথ্যসূত্রঃ উইকি
সব শেষে আমি একটা কথাই বলবো এ সরকারের আমলে প্রবৃদ্ধির উর্ধ্বগতির পেছনে "নিরবিচ্ছিন্ন" বিদ্যুতের অনেকটা অবদান ছিলো। আপনার আশপাশে কোন শিল্পপতি থাকলে আমার কথার সত্যতা তার নিকট থেকেই জানতে পারবেন। ৬ ঘন্টা বিদ্যুৎ আর ৬ ঘন্টা জেনারেটর চালালে লাভের গুড় পিঁপড়ায় খাওয়ার দশা হয়...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।