তৃতীয় দফা উপজেলা নির্বাচনে দলীয় কোন্দল, প্রভাবশালী মন্ত্রী-নেতা প্রভাবিত দুর্গ বলে খ্যাত এলাকায় এবারও হেরেছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা। জিতেছেন বিএনপি ও দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরা। অন্যদিকে 'কারচুপি'র পাশাপাশি বিদ্রোহী প্রার্থী ও জামায়াতের ২২ উপজেলায় পৃথক প্রার্থী হওয়ার কারণেই দল সমর্থিত প্রার্থীদের পরাজয় ঘটেছে বলে মনে করে বিএনপি। অন্তত আরও ১০টি উপজেলায় জামায়াতের কারণেই বিএনপির পরাজয় হয়েছে। দলের শীর্ষ নেতারা এমনটাই মনে করছেন।
এ নিয়ে জোটের শরিক জামায়াতের ওপর বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা অনেকটা ক্ষুব্ধ বলেও দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
গত শনিবার ৪১ জেলার ৮১ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ৭৯টির মধ্যে আওয়ামী লীগ বিদ্রোহীসহ ৪০টি, বিএনপি বিদ্রোহীসহ ২৮টিতে, জামায়াত ৮টিতে চেয়ারম্যান পদে জয়লাভ করেছে। প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় এগিয়ে থাকলেও তৃতীয় দফার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চেয়ে পিছিয়ে পড়ে বিএনপি। কারচুপি ছাড়াও দলীয় কোন্দলের সুযোগে বিদ্রোহী প্রার্থী ও জামায়াত অন্যতম বাধা ছিল বলে মনে করছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। তৃতীয় ধাপে উপজেলা নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, ৫ বছরে কার্যকর সংগঠন গড়ে তুলতে না পারা, তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের অবমূল্যায়নও পরাজয়ের অন্যতম কারণ। অধিকাংশ উপজেলায় ছিল বিদ্রোহী প্রার্থীর ছড়াছড়ি। অনেক উপজেলায় তৃণমূলের মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে ভুল প্রার্থী বাছাই করা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীদের হয়রানির নামে অনেক উপজেলায় সাধারণ নিরীহ মানুষও হয়রানির শিকার হন বলে অভিযোগ ছিল। এসব কারণে তিন দফা উপজেলা নির্বাচনে দল সমর্থিত প্রার্থীদের পরাজয় ঘটেছে বলে মনে করেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা।
ভবিষ্যতে এসব ব্যাপারে সতর্ক না হলে আওয়ামী লীগের একই ধরনের বিপর্যয়ে পড়ার আশঙ্কা করেন তারা। বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, জামায়াতের প্রার্থী দেওয়াকে কেন্দ্র করে তৃণমূলে বিএনপির সঙ্গে তাদের বিরোধ ছিল চরমে। কোথাও কোথাও জামায়াত তাদের ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীকে বিজয়ী করতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে 'অাঁতাত' করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলায় এমনটি ঘটেছে। বিএনপি নেতারা বলছেন, কারচুপি না হলে বিএনপি পঞ্চাশের অধিক উপজেলায় জয়ী হতো।
বিভিন্ন স্থানে আগের রাতেই আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী প্রশাসনের সহায়তায় কারচুপির সব আয়োজন সম্পন্ন করেছে বলে তাদের দাবি। বিএনপি বলছে, ভোটকেন্দ্র দখলসহ নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের নানা অনিয়মের কারণে আওয়ামী লীগ বা বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না, তা জনগণের কাছে আবারও স্পষ্ট হয়েছে। গত ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন বর্জন করার সিদ্ধান্তটি যে সঠিক ছিল, তাও প্রমাণিত হয়েছে। এতে করে ক্ষমতাসীনদের ওপর জনগণের ক্ষোভ আরও বাড়বে। জানা গেছে, অন্তঃকোন্দল এবং দুর্বল সাংগঠনিক অবস্থার কারণে কারচুপি প্রতিহত করতে পারেনি বেশির ভাগ উপজেলায়।
কেন্দ্রীয় এবং স্থানীয় পর্যায়ে প্রভাবশালী নেতাদের মধ্যে মতবিরোধের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা দলীয় এজেন্ট কেন্দ্র থেকে বের করে নির্বিঘ্নে সিল মারা, ভোট কারচুপি, বিএনপি সমর্থক প্রার্থীদের ওপর নির্যাতন করার অভিযোগ এনে বরিশালের মুলাদী, ফেনীর দাগনভূঞা, শরীয়তপুর সদর এবং বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলা, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম ও নাঙ্গলকোট, সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ, চাঁদপুর উপজেলায় দুপুরের মধ্যে ভোট বর্জন করে। এ ছাড়া ভোলা সদর, বরিশালের বাবুগঞ্জ কেন্দ্র থেকে আগেই এ বিষয়ে সতর্ক করা হলেও আওয়ামী লীগের অনিয়মের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি স্থানীয় বিএনপি। যার কারণেই পরাজয় ঘটেছে এসব এলাকার বিএনপি প্রার্থীদের।
আওয়ামী লীগ : তৃতীয় ধাপে উপজেলা নির্বাচনে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটেছে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজ নির্বাচনী এলাকা টুঙ্গিপাড়ায়।
সেখানে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী সোলাইমান বিশ্বাস প্রায় ২০ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছেন দলের বিদ্রোহী প্রার্থী গাজী গোলাম মোস্তফার কাছে। একইভাবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের নির্বাচনী এলাকা কিশোরগঞ্জ সদরও এখন বিএনপির দখলে। সেখানে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী অ্যাডভোকেট সৈয়দ আশফাকুল ইসলাম টিটু পরাজিত হয়েছেন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী অ্যাডভোকেট শরীফুল ইসলাম শরীফের কাছে। আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ফরিদপুরেও এবার বিএনপি ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর বিজয় হয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহর নিজ নির্বাচনী এলাকা ভাঙ্গায় পরাজিত হয়েছে আওয়ামী লীগ।
সেখানে জয়ী হয়েছেন দলের বিদ্রোহী প্রার্থী সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শাহাদাৎ হোসেন। তিনি স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান নিঙ্ন চৌধুরীর সমর্থক ছিলেন। চরভদ্রাসন উপজেলায়ও হেরেছে আওয়ামী লীগ। জিতেছে বিএনপি। সেখানে জাফর উল্লাহর প্রার্থী হেরেছে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী বাদল আমীনের কাছে।
এর আগে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর নিজ নির্বাচনী এলাকা নগরকান্দা ও সালতায় বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর জয় হয়েছে। ফরিদপুরে আরও বিপর্যয় ঘটেছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা আবদুর রহমান এমপির নিজ সংসদীয় এলাকা মধুখালীতে। সেখানে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী আজিজুর রহমান মোল্লা বিজয়ী হয়েছেন। সেখানে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন। দলীয় কোন্দলের কারণেই সেখানে আওয়ামী লীগের পরাজয় বলে স্থানীয় নেতা-কর্মীরা মনে করেন।
খুলনায় আওয়ামী লীগের এমপি অধ্যাপক নূরুল হকের নির্বাচনী এলাকা পাইকগাছায় হেরেছে আওয়ামী লীগ। সেখানে জিতেছেন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মুক্তিযোদ্ধা স ম বাবর আলী। হেরেছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আবদুর রশীদ।
বিএনপি : দিনাজপুর সদরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ফরিদুল বিজয়ী হয়েছেন। সেখানে বিএনপির প্রার্থী মোকাররম হোসেন ছিলেন নিটকতম প্রতিদ্বন্দ্বী।
মাত্র ১০ হাজার ভোটে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর কাছে হারেন তিনি। সেখানে জামায়াত প্রার্থী মাওলানা মজিবুর রহমান পেয়েছেন প্রায় ৩০ হাজার ভোট। অবশ্য এখানে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থীও ছিলেন। সেখানে জোটের একক প্রার্থী হলে বিএনপির জয় নিশ্চিত হতো। নবাবগঞ্জে জামায়াতের প্রার্থী মাওলানা নুরে আলম সিদ্দিকী জয়ী হয়েছেন।
তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের আতাউর রহমান। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী তরিকুল ইসলাম তৃতীয় হন। অবশ্য সেখানে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থীও ছিলেন। রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলায় বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী পরাজয়ের মূল কারণ হচ্ছে দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব। এখানে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী ছিলেন গোলাম সাকলায়েন।
যিনি জেলা সভাপতি নাদিম মোস্তফার প্রার্থী হিসেবে পরিচিত। এখানে বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন মোল্লা আবদুল ওয়াহেদ। তিনি মহানগর বিএনপির সভাপতি মিজানুর রহমান মিনু সমর্থিত বলে পরিচিত। মূলত মিনু-নাদিমের দ্বন্দ্বের কারণেই এখানে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর পরাজয় হয়েছে। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলায় বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী ছিলেন ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান।
সেখানে তার বিপক্ষে একই দলের আবদুর রহিম শামীম প্রার্থী হন। এ কারণে কুড়িগ্রাম সদর হারাতে হয়েছে বিএনপিকে। সিলেটে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে বিরোধ থাকার কারণেই এখানে ভরাডুবি হয়েছে। সিলেটের সুরমা উপজেলায় জামায়াতের প্রার্থী লোকমান আহমেদকে সমর্থন দেয় বিএনপি। এতে ক্ষুব্ধ হয় স্থানীয় বিএনপি।
যার কারণে ইলিয়াস আলীর অনুসারী জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আলী আহমদ বিদ্রোহী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন। এখানে দলের সিদ্ধান্ত সঠিক না হওয়ার কারণে বিএনপি প্রার্থীর পরাজয় হয়েছে। অবশ্য এ জন্য দলের ভাইস চেয়াম্যান শমসের মবিনকে দায়ী করেছে সিলেটের স্থানীয় বিএনপি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।