ডেমরার মাতুয়াইলে চাঁদা না পেয়ে একটি ভবনের নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয় সশস্ত্র চাঁদাবাজরা। কুপিয়ে আহত করে নির্মাণ ব্যবসায়ী সোলায়মান আহমেদকে (ছদ্মনাম)। থানায় মামলা করলে পুলিশ চিহ্নিত চাঁদাবাজ শ্যামলকে গ্রেফতার করে। কিন্তু কিছু দিন পরই শ্যামল জামিনে মুক্তি পায়। জামিনে মুক্তি পেয়েই সে দলবল নিয়ে এবার সোলায়মান আহমেদের বাসায় চড়াও হয়। ব্যবসায়ী সোলায়মানের সন্তানদের মেরে ফেলার হুমকি দেয়। সোলায়মান এবং তার সন্তানরা এখন ঘরবন্দী। শ্যামলের বিরুদ্ধে ডজনখানেক মামলাসহ জিডি রয়েছে অর্ধশতাধিক।
শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাতের নামে চাঁদা দাবি করা হয় মিরপুর-১০ নম্বর সেকশনের ৫ নম্বর রোডের এক বাড়ির মালিকের কাছে। এ ব্যাপারে পল্লবী থানায় একটি মামলা হয়। পরদিন বাড়ির মালিক তার ছেলেকে নিয়ে বাসা থেকে বের হওয়ার পরপরই তাদের পায়ের কাছে দুই রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে কে বা কারা। এর পরই তার মুঠোফোনে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি তাকে জানান, 'একটু আগে যে গুলি হয়েছে তা আমার লোকজনই করেছে। মারার জন্য নয়, ভয় দেখানোর জন্য। টাকা না পেলে এবার গুলি হবে বুকে।'
চাঁদাবাজির এমন ভয়ঙ্কর চিত্র এখন রাজধানীজুড়ে। প্রায় প্রতিটি এলাকায় চাঁদাবাজরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। চাঁদা না পেলেই তারা অ্যাকশনে যাচ্ছে। গুলি চালাচ্ছে। হামলা করছে। এমনকি পরিবারের সদস্যদেরও তারা টার্গেট করছে। আবার চাঁদার দাবিতে হুমকিস্বরূপ মিষ্টির বাঙ্ েকরে বাসায় পাঠানো হচ্ছে কাফনের কাপড়, ককটেল ও হাতবোমা। গত কয়েক দিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজদের হাতে অন্তত ১৫ জন গুরুতর জখম হয়। চাঁদা না পাওয়ায় দুর্বৃত্তরা গুলি করে আর ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে আহত করেছে তাদের। জানা গেছে, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, সাংস্কৃতিক কর্মী, রাজনৈতিক নেতাদের টার্গেট করে চাঁদা দাবি করা হচ্ছে। এ ছাড়া খেটে খাওয়া মানুষও চাঁদাবাজদের হুমকি-ধমকিতে আতঙ্কিত। ডিএমপির কোনো না কোনো থানায় প্রায় প্রতিদিনই এ সংক্রান্ত জিডি হচ্ছে। সব মিলিয়ে চাঁদাবাজদের ভয়ে চরম অস্থিরতার মধ্যে রয়েছেন সর্বস্তরের মানুষ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জেল থেকে জামিনে ছাড়া পাচ্ছে দাগি অপরাধীরা। তারাই এখন প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি করছে। অস্ত্র নিয়ে হাজির হচ্ছে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান কিংবা বাসাবাড়িতে। এ ছাড়া কারাগারে আটক ও বাইরে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামেও চলছে ভয়ানক চাঁদাবাজি। পুলিশ ও র্যাব সূত্র জানায়, রাজধানীর বিভিন্ন থানায় বিগত তিন মাসে চাঁদা দাবির অভিযোগে আড়াই শতাধিক সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছে। ব্যবসায়ী, সরকারি ও বেসরকারি চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ এসব ডায়েরি করেছেন। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ ও র্যাব শতাধিক চাঁদাবাজকে গ্রেফতারও করেছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পুলিশ ব্যস্ত ছিল রাজপথে। যে কারণে চাঁদাবাজি, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ এ ধরনের অপরাধ রোধে পুলিশ খুব একটা কাজ করতে পারছিল না। রাজনৈতিক অস্থিরতা এখন না থাকলেও পুলিশ এখনো ওই অবস্থা থেকে বের হতে পারছে না। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ এস এম শাহজাহান বলেন, চাঁদাবাজির ১০০টি ঘটনা ঘটলেও সব ঘটনায় মামলা হয় না। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ ঝামেলা এড়াতে কোনো কোনোটি আবার জিডি হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। আবার মামলা হলেও ভুক্তভোগীরা ভয়ে অনেক সময় সাক্ষ্য দিতে যান না। এসব কারণে আসামিরা ছাড়া পেয়ে যায়। তিনি বলেন, এসব দমনে দরকার দক্ষ বাহিনী। তা ছাড়া রাজনৈতিক ব্যক্তিদের প্রশ্রয় বন্ধ না হলে এ অপরাধ কমবে না। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এ কে এম হাবিবুর রহমান বলেন, চাঁদাবাজি রোধে র্যাব নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে। চাঁদাবাজদের সংবাদ পাওয়া মাত্র র্যাব অভিযান চালাচ্ছে। অস্ত্রসহ অসংখ্য চাঁদাবাজকে র্যাব ইতোমধ্যে গ্রেফতার করতে সমর্থ হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের তথ্যমতে, রাজধানীতে তিন শতাধিক চাঁদাবাজ গ্রেফতার এড়িয়ে অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে। পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, চাঁদাবাজদের ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে। তালিকা ধরে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে। পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্র মতে, রাজধানীর মিরপুর, শাহআলী, দারুস সালাম, পল্লবী, কাফরুল, মোহাম্মদপুর, ধানমণ্ডি, গুলশান, রমনা, উত্তরা, বাড্ডা, কোতোয়ালি, সূত্রাপুর, যাত্রাবাড়ী, জুরাইনসহ আরও অনেক এলাকায় সাম্প্রতিক সময়ে চাঁদাবাজির ঘটনা বেড়েছে।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, পুলিশকে চাঁদাবাজদের খবর জানালেও কোনো লাভ হচ্ছে না। উল্টো চাঁদাবাজরা আরও বেপরোয়া হয়ে পড়ে। বাসাবাড়িতে চড়াও হয়ে পরিবারের সদস্যদের প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে। তারা বলেন, চাঁদার জন্য নানা কৌশল নিচ্ছে সন্ত্রাসীরা। পরিবারের লোকজনের চলাফেরা অনুসরণ করে ফোনে বর্ণনা দেয় চাঁদাবাজরা। ফোনে তারা বলে, 'আপনার ছেলে/মেয়ে এখন অমুক জায়গা থেকে বের হয়েছে। ইচ্ছা করলেই গুলি করতে পারি। টাকা না পেলে এর পর আর ফোন নয়, গুলি করব।' এ ধরনের ফোন পাওয়ার পর অনেকেই ভয়ে চাঁদার টাকা দিয়ে দেন।
চাঁদাবাজির শিকার ডেমরার সোলায়মান জানান, তিনি এখন শ্যামল ও তার দলবলের ভয়ে বাসা থেকে বের হতে পারছেন না। সন্তানরাও স্কুলে যেতে পারছে না। শ্যামল হুমকি দিয়ে বলেছে, রাস্তায় তার সন্তানকে মেরে ফেলা হবে। জামিনে ছাড়া পেয়ে শ্যামল আরও বেপরোয়া হয়ে পড়েছে। শ্যামল চাঁদার দাবিতে এর আগে তাকে প্রকাশ্যে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করেছে। এবার সে বলেছে, আমাকে হত্যা করা হবে। আমি এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। একই এলাকার ঠিকাদার সেন্টু জানান, শ্যামলের কারণে ওই এলাকায় কেউ ব্যবসা পরিচালনা করতে পারছেন না। তিনিও শ্যামলের বিরুদ্ধে ১২ মার্চ জিডি করেছেন।
চাঁদাবাজদের হাতে খুন : গত মাসে ২০ লাখ টাকা চাঁদা না দেওয়ায় মগবাজার এলাকার একটি সিএনজি স্টেশনের মালিক মোস্তাফিজুল হক মিলনকে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। একই কারণে আশকোনায় বাড়ি নির্মাণের সময় চাঁদাবাজরা বাড়ির মালিকসহ তিনজনকে গুলি করে আহত করে। বাড্ডায় জয়নাল আবেদীন নামে এক দোকান ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে হত্যা করে চাঁদাবাজরা। মিরপুর-১ নম্বর সেকশনের কো-অপারেটিভ মার্কেটের এক কাপড় ব্যবসায়ীর কাছে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে ওই রাতেই মলি্লকা হাউজিং এলাকায় তার বাসায় মিষ্টির প্যাকেটে কাফনের কাপড়, ককটেল ও হাতবোমা পাঠিয়ে হুমকি দেওয়া হয়। ওই ব্যবসায়ী এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট থানায় জিডি করেন। মিরপুর শাহআলী মার্কেটের এক ওষুধ ব্যবসায়ী জানান, 'শাহাদাত বাহিনীর' সদস্য পরিচয়ে তার কাছে এক লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়েছে। টাকা না দিলে তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেয় সন্ত্রাসীরা। তিনি থানায় জিডি করেছেন। পুলিশ কর্মকর্তারা স্বীকার করেন, চাঁদাবাজির অনেক ঘটনা সাধারণ ডায়েরি হিসেবে থানায় লিপিবদ্ধ হওয়ার কারণে আসামি গ্রেফতার হয় কম। ভুক্তভোগীরা জানান, আগে থানায় মামলা করা সহজ হলেও এখন পুলিশ সহজে মামলা নিতে চান না। এতে চাঁদাবাজির মামলা কম হয়।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।