কাল সোমবার উপজেলা পরিষদের পঞ্চম দফা নির্বাচন। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীরা অনেক এলাকায় বেপরোয়া হয়ে ওঠায় এ পর্বে আরও বেশি সহিংসতা, কেন্দ্র দখল ও কারচুপির আশঙ্কা করা হচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধেও উঠেছে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ।
এর আগের বিভিন্ন পর্বের নির্বাচনে দেখা গেছে, কেন্দ্র দখল ও ভোট জালিয়াতি রোধে নির্বাচন কমিশনসহ নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী পুরো প্রশাসনই ছিল কার্যত নিষ্ক্রিয়। এ কারণে এই ধাপে পরিস্থিতি আগের চেয়ে খারাপ হতে পারে—প্রার্থী-সমর্থক-ভোটাররা এমন আশঙ্কা করছেন বলে বিভিন্ন জেলা থেকে প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন।
এর মধ্যে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ। সেখানে কথিত গডফাদার ও পৌর মেয়র আবু তাহেরের ছেলে সালাহ উদ্দিন (টিপু) আওয়ামী লীগ-সমর্থিত চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী। দুই দিন ধরে লক্ষ্মীপুর শহরসহ বিভিন্ন এলাকায় তাঁর লোকজন মোটরসাইকেলযোগে সশস্ত্র মহড়া দিয়েছেন।
ফেনীর একসময়ের সন্ত্রাসের গডফাদার জয়নাল হাজারীর কথিত স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য মেসবাউল হায়দার চৌধুরী (সোহেল) ছাগলনাইয়া উপজেলায় আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী। তাঁর দাপটে ইতিমধ্যে এলাকায় আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে।
জামালপুরের মাদারগঞ্জ ও টাঙ্গাইলের গোপালপুরে সহিংসতার আশঙ্কা করছেন স্থানীয় ব্যক্তিরা।
এবার যে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে, এমন পূর্বাভাস নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তারা পেয়েছেন বলেও সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার (ভারপ্রাপ্ত সিইসি) আবদুল মোবারক গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, এ ধাপে সহিংসতা বেশি হবে, না কম হবে, তা নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। তারা সহিংসতা করতে বললে হবে, নিষেধ করলে হবে না। তাঁর মতে, গত বছরের ৫ মে থেকে এ বছরের ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত যে সহিংসতা হয়েছে, এখন তা দেখছেন না।
কারণ, ওই দলগুলো সহিংসতা করছে না।
তাহলে কি এখন সরকারি দল সহিংসতা করছে—এ প্রশ্নের জবাবে আবদুল মোবারক বলেন, ‘সরকার-বেসরকার দুই দলই করছে। এক হাতে তো তালি বাজে না। যে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার হতে পারবে না, সে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে দাঁড়িয়েছে। এখন নির্বাচন নিয়ে তারাই বেশি আহাজারি করছে।
’
দেশে মোট ৪৮৭টি উপজেলার মধ্যে এর আগে চার দফায় ৩৮৬টি উপজেলায় নির্বাচন হয়েছে। আগামীকাল ৩৫ জেলার ৭৩টি উপজেলায় ভোট গ্রহণ করা হবে। আদালতের নিষেধাজ্ঞাসহ বিভিন্ন কারণে বাকিগুলোর নির্বাচন স্থগিত আছে।
প্রথম দফায় নির্বাচন মোটামুটি শান্তিপূর্ণ হলেও পরবর্তী তিন দফায় ক্রমান্বয়ে সহিংসতা ও কেন্দ্র দখল বাড়তে থাকে। পরের তিন দফায় সহিংসতায় আটজন নিহত এবং কয়েক শ জন আহত হন।
এর মধ্যে দ্বিতীয় ধাপে একজন, তৃতীয় ধাপে তিনজন এবং সর্বশেষ গত ২৩ মার্চ চতুর্থ ধাপে চারজন নিহত হন।
চতুর্থ দফার নির্বাচন অনেকটা বিনা বাধায় ভোটকেন্দ্র দখল করে ব্যালট পেপারে সিল মারার ‘উৎসব’-এ পরিণত হয়। ব্যালট বাক্স ছিনতাই, হানাহানি, কেন্দ্র দখলসহ নানা অনিয়মের ঘটনা ঘটে পুলিশ ও নির্বাচনী কর্মকর্তাদের সামনেই। কিন্তু এসব ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও কমিশন শক্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নির্বাচন কমিশনার বলেন, উপজেলা নির্বাচনের সময় মাঠপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসন অনেক ক্ষেত্রেই কমিশনের কথা শুনছে না।
এ পরিস্থিতিতে আগামীকালের নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে কমিশনের প্রস্তুতি কেমন, তা জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোবারক হোসেন বলেন, ‘প্রস্তুতি আর কী, কমিশনের তো নিজস্ব কোনো বাহিনী নেই। তাই সরকারি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর আমরা নির্ভরশীল। ’
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, মূলত প্রথম দফার নির্বাচনে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে বিরোধী দল-সমর্থিত প্রার্থীরা বেশিসংখ্যক উপজেলায় বিজয়ী হওয়ায় বিষয়টি সরকার ও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এরপর তাঁরা প্রশাসনের সহায়তা নেওয়ার পাশাপাশি দলীয় নেতা-কর্মীদেরও মাঠে নামান।
দেখা গেছে, সহিংসতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চেয়ারম্যান পদে জয়ী ক্ষমতাসীন দলের সমর্থিত প্রার্থীর সংখ্যাও বেড়ে গেছে।
প্রথম ধাপের নির্বাচনে ৯৮ উপজেলার মধ্যে ৪১টিতে বিএনপি, ১২টিতে জামায়াত ও ৩৫টিতে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীরা নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় দফায় ১১৫টি উপজেলার মধ্যে বিএনপি ৫১, আওয়ামী লীগ ৪৬টি ও জামায়াতের প্রার্থীরা আটটিতে জিতেছেন। তৃতীয় দফায় এসে আওয়ামী লীগ বিএনপির চেয়ে এগিয়ে যায়। এ দফায় ৮১টি উপজেলার মধ্যে ৩৯টিতে আওয়ামী লীগ, ২৭টিতে বিএনপি ও আটটিতে জামায়াত জেতে। সর্বশেষ চতুর্থ দফায় ৮৮ উপজেলার মধ্যে ৫২টিতে আওয়ামী লীগ, ২২টিতে বিএনপি ও পাঁচটিতে জামায়াতের প্রার্থী জিতেছেন।
চার পর্বে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মাত্র তিনটি উপজেলায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দলের একটি প্রভাবশালী মহল উপজেলায় দলীয় লোকদের বিজয়ী করার জন্য নানা পরিকল্পনা নেয়। কেন্দ্রীয় নেতারা দলীয় কার্যালয়ে বৈঠক করে মাঠপর্যায়কে সক্রিয় করার উদ্যোগ নেন। কয়েকজন মন্ত্রী ও জ্যেষ্ঠ নেতা প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রীর দুজন উপদেষ্টা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমন্বয় ও যোগাযোগ রক্ষা করেন।
এ ছাড়া সরকারের একাধিক সংস্থাকেও এ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করা হয়।
অবশ্য ভোটে কারচুপির অভিযোগ মানতে রাজি নন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ভোট কারচুপি করলে বিএনপি এত অধিকসংখ্যক উপজেলায় বিজয়ী হতো না। এমনকি জামায়াতে ইসলামী ৩২ উপজেলায় এবং এ দলের নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে জিততে পারত না। ’ যোগাযোগমন্ত্রী দাবি করেন, উপজেলা নির্বাচন নিয়ে যেভাবে বলা হচ্ছে, তা ঠিক নয়।
মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন হয়েছে। তুলনামূলকভাবে অন্য নির্বাচনের চেয়ে ভালো নির্বাচন হয়েছে। বিএনপি ও জামায়াত যেসব এলাকায় শক্তিশালী, সেসব স্থানেও সহিংসতা হয়েছে।
অপরদিকে আগামীকালের নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও উপজেলা নির্বাচনে দলের সমন্বয় কমিটির সদস্য মো. শাহজাহান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনের আগেই সরকার দল-সমর্থিত প্রার্থীরা যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন, তাতে মনে হচ্ছে, ৭৩টির মধ্যে ৭২টিই তাঁরা দখল করে নিতে চান।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।