অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে বিপর্যস্থ ইউক্রেনে ২৫ মে ইউক্রেনের নির্বাচনের পূর্বেই ক্রিমিয়া সঙ্কট সারা বিশ্বকে ভাবিয়ে তুলেছে। ক্রিমিয়াকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক টানাপোড়নে পড়েছে রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ সম্পর্ক। ক্রিমিয়ার যখন এমন সংকট তখন অক্টোবরে স্কটল্যান্ড নিজেদেরকে স্বাধীন ঘোষণা করবে কিনা? সে সংকান্ত একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হবে।
১৮ শতকে রাশিয়ার সম্রাটের অধীনে আসার পূর্বে গ্রীক, রোমান, অটোমান, তুর্কি, তাতার এবং মঙ্গলরা ক্রিমিয়ানদের শাসন করেছে। ১৯২১ সালে ক্রিমিয়া সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের অধীন হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের কাছে হস্তান্তর করে সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯১ সালে স্বাধীন ইউক্রেনের অংশ হয় ক্রিমিয়া। এর এক বছর পর ক্রিমিয়া ইউক্রেনের অধীন স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্র হয়।
ইউক্রেনে গত বছরের শেষ দিকে রাশিয়াপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচ ইউরোপীয় ইউনিয়নের চুক্তিতে স্বাক্ষর না করার বিনিময়ে রাশিয়া ইউক্রেনের ১৫ বিলিয়ন ডলার বন্ড ক্রয় এবং গ্যাসের দাম এক-তৃতীয়াংশ কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তখনই ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষের আন্দোলনকারীরা আন্দোলন করে প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচকে উৎখাত করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওলেকসান্দার তারচিনভ ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আরসেনি ইয়াতসেনিয়ুককে নির্বাচিত করে ।
এ বছর ২৪ ও ২৫ ফেব্রুয়ারী ক্রিমিয়ার রাজধানী সিমফারপোলে রাশিয়াপন্থী ক্রিমিয়ানরা নিজেদের স্বায়ত্তশাসনের দাবীতে বিক্ষোভ করে। ২৬ ফেব্রুয়ারী রাশিয়াপন্থী ক্রিমিয়ানদের সাথে ইউক্রেনপন্থী ক্রিমিয়ানদের ব্যাপক সংঘর্ষে প্রায় শতাধিক ক্রিমিয়ান মারা যায়। এর পরদিনই ভারী অস্ত্রে সজ্জিত প্রায় ৬০ জন রাশিয়াপন্থী বিপ্লবী ক্রিমিয়ার পার্লামেন্ট দখল করে। ১লা মার্চে ক্রিমিয়ার প্রধানমন্ত্রী সারজেই একসিয়নভ সরাসরি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কাছে শান্তির জন্য সাহায্য চায়।
১৬ মার্চ ক্রিমিয়ায় গণভোটে রাশিয়ায় যোগ দেয়ার পক্ষে ৯৭ শতাংশ ভোট পড়ে।
ক্রিমিয়ার জনসংখ্যার ৫৪ ভাগ রাশিয়ান গণভোটের পক্ষে ও ২৪ ভাগ বিপক্ষে ভোট দিলেও ১২ ভাগ তাতার জনগোষ্ঠী ভোট বর্জন করে। ১৭ মার্চ ক্রিমিয়ার পার্লামেন্ট ক্রিমিয়াকে ইউক্রেন থেকে আলাদা হিসেবে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করে। তবে রাশিয়া বাদে আর কোন রাষ্ট্রই স্বীকৃতি দেয়নি ক্রিমিয়াকে। শুধু তাই নয় রাশিয়া স্বীকৃতি দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা রাশিয়াকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার কথা বলেন। এরই প্রেক্ষিতে রাশিয়ার উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক মহল।
ইতিমধ্যে বেশ কিছু রুশ নেতার বিরুদ্ধে ভ্রমনে নিষেধাজ্ঞা ও সম্পদ জব্দের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্র।
তবে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা কতটুকু কার্যকর হবে তা বিবেচ্য বিষয়। ইইউ এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের তথ্য মতে, রাশিয়ার জ্বালানী তেলের ৮৪ শতাংশ ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ৭৬ শতাংশ কেনে ইউরোপ। রাশিয়া থেকে তেল ও গ্যাস আমদানি বন্ধ করে দিলে এত তেল ও গ্যাসের যোগান আসবে কোথা থেকে? অন্যদিকে রাশিয়ার বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রায় ৬৫ হাজার কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্র। এসব ঋণ তুলতে না পারলে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে দেশগুলো।
আবার রাশিয়া জাতিসংঘের ভেটো প্রদানের ক্ষমতা রাখে। তাই জাতিসংঘ রাশিয়ার বিরুদ্ধে কোন অবরোধ আরোপ করতে গেলে তা বাতিল করে দিবে রাশিয়া।
রাশিয়ার নৌ-ঘাটির অবাধ চলাচলের জন্য ক্রিমিয়া প্রয়োজন। রাশিয়ার প্রিন্স পতেমকিন ১৭৮৩ সালে লোহিত সাগরের পেনিনসুলায় এই নৌ-ঘাটি তৈরি করেন। ২০০৮ সালে এই ঘাটির বদৌলতে জর্জিয়াকে পরাজিত করে রাশিয়া।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর উপর নিয়ন্ত্রনের জন্যও এই ঘাটির গুরুত্ব আছে। এদিকে ১৯ মার্চ ক্রিমিয়া থেকে ইউক্রেনের ২৫০০০ সৈন্য ফিরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ইউক্রেন।
স্কটল্যান্ড ১৭০৭ সালে যুক্তরাজ্যের সাথে একীভূত হয়। এর প্রায় ৩০৫ বছর পর ১৫ অক্টোবর ২০১২ ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ও স্কটল্যান্ড ন্যাশনাল পার্টির নেতা এলেক্স সেমণ্ড “এডিনবারগ চুক্তি” করে। এর ফলে স্কটল্যান্ড; ইংল্যান্ড থেকে পৃথক হওয়ার জন্য গণভোট আয়োজন করার ক্ষমতা অর্জন করে।
সাম্প্রতিক জরীপে দেখা যায়, স্কটিশরা মনে করে স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা প্রয়োজন। আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত ভোটেই নির্ধারিত হবে স্কটল্যান্ডের ভবিষ্যৎ। এই গণভোটে প্রশ্ন থাকবে, স্কটল্যান্ড কি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে? এর উত্তরে ভোটাররা “হ্যাঁ” বা “না” তে তার ভোট প্রদান করবে। গণভোটে ১৬ ও ১৭ বছর বয়সী নাগরিকরাও ভোট প্রদান করতে পারবে।
প্রফেসর রবার্ট হেজেল সিএনএন কে দেওয়া সাক্ষাতকারে বলেন, “অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন ও কম ট্যাক্স প্রদানের জন্যই মূলত আলাদা হতে চায় স্কটল্যান্ড।
“ স্কটল্যান্ড ইংল্যান্ডকে উচ্চহারে ট্যাক্স দিলেও সে তুলনায় তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়নি। এছাড়া স্কটল্যান্ড চায় রাজনৈতিকভাবেও তারা নিজেরা নিজেদের শাসন করুক।
তবে ক্রিমিয়ার বর্তমান অবস্থার সাথে স্কটল্যান্ডের কোনভাবেই তুলনা করা যায়না। স্কটল্যান্ডে স্কটিশ সরকার ক্ষমতায় থেকে ইংল্যান্ডের সাথে চুক্তির মাধ্যমে গণভোটের আয়োজন করছে সেখানে ক্রিমিয়া অস্ত্র দিয়ে ক্ষমতা নিজেদের কুক্ষিগত করে গণভোট আয়োজন ও নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করেছে। রাশিয়া ক্রিমিয়াকে সৈন্য ও অস্ত্র সহায়তা করেছে।
এই পুরো বিষয়টাই হয়েছে রাশিয়ার দেখানো পথে। গার্ডিয়ান পত্রিকার কলাম লেখক সিমন টিসদাল মনে করেন ইইউ দেশগুলোর উপর প্রভাব বিস্তারের জন্যই রাশিয়া একাজ করে থাকতে পারে।
গত ১৬ মার্চ ভ্লাদিমির পুতিন ক্রিমিয়ার বর্তমান পরিস্থিতিকে কসোভোর সাথে তুলনা করে টেলিফোনে ওবামাকে বলেন, “কসোভো সার্বিয়ার ভূখণ্ড থাকা সত্তেও ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্র দেশগুলো কসোভোকে স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিয়েছিল; এখন তবে ক্রিমিয়ার বিপক্ষে যাচ্ছেন তারা”। এরই প্রেক্ষিতে ওবামা বলেন, “২০০৮ সালে কসোভোতে সার্বিয়ারা যে সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে মানুষ খুন ও গণধর্ষণ করেছে; সে ধরনের কোন আগ্রাসন চালায়নি ইউক্রেন”। সেক্ষেত্রে দুটি বিষয় আলাদা চোখে দেখছে তারা।
এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ বিরোধিতা করলেও নিশ্চুপ রয়েছে চীন। চীনের সিদ্ধান্তের উপরেও এ অঞ্চলের ভবিষ্যৎ রাজনীতি নির্ধারিত হবে বলে মনে করে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক। এদিকে ভারত ঘোষণা দিয়েছে তারা রাশিয়ার উপর কোন অবরোধ আরোপ করবেনা। রাশিয়ার সাথে সাম্প্রতিক ভালো সম্পর্কই এর মূল কারন। তবে সময়ই বলে দিবে ক্রিমিয়ার সংকট আরো কোন সংকটকে উস্কে দিবে কিনা?
সুত্রঃ সিএনএন, নিউইয়র্ক টাইমস, বিবিসি, ওয়াশিংটন পোষ্ট।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।