গাছপালার প্রতি আমার দুর্নিবার আকর্ষণ সেই শৈশবকাল থেকে। বনবাদাড়ে পুঁয়ো কাঁঠাল কিংবা জামের চারার জন্য দাপিয়ে কত বেড়িয়েছি, তার ইয়ত্তা নেই। কার সারগর্তে পাঁচটা পুইশাক কিংবা পেপেঁর চারা গজিয়েছে তার সুলুক-সন্ধান করেছি। বন্ধুদের চোখ এড়িয়ে সেগুলো নিজেদের ওঠোনে কীভাবে পুঁততে হবে সে দক্ষতাও দেখিয়েছি প্রমাণ সহকারে। নাম জানা না জানা বুনো গাছ গাছালির ভালবেসে নিছক মূল্যহীন বুনো গুল্মলতা বাড়িতে এনে পুষেছি, খেলেছি সেসব নিয়ে ।
তাদের নিয়ে লিখতে গেলে পাতার পর পাতা ফুরিয়ে যাবে--তবু সে গল্প ফুরাবে না। আজ আমি গল্প করছি--একদিন নিজেও এভাবে গাছ-গাছালির গল্প শুনেছি নানি-দাদিদের কাছে। কিছু গল্প তো রূপকথাকেও হার মানায়। আমার অক্ষরজ্ঞানহীন দাদি-নানিরা পাথরকুচির গল্প শোনাতেন রূপকথার মত করে। আর লজ্জাবতী? এমন আশ্চর্য গাছ কোনদিন দেখতে পাব স্বপ্নেও ভাবিনি।
কিন্তু স্বপ্নকে বাস্তবে ধরিয়ে দিল আমার এক বন্ধু। অমুক মাঠের অমুক বাঁশঝাড়ের নীচে নাকি আছে আমার আরাধ্য লজ্জাবতী গাছ।
গেলাম, দেখলাম কিন্তু জয় করতে পারলাম না। লজ্জাবতী গাছের যে গল্প শুনেছি, তার যে রাজকীয় চেহারা মোহনীয় গুণের কথা শুনেছি এই লজ্জাবতী দেখার পর এক লহমায় তা উবে গেল। লজ্জাবতী গাছ বা লতা নাকি ১০/১২ ফুট লম্বা হয়, এ দেখি আধফুটি এক শীর্ণ চেহারার সামান্য এক গুল্ম--লতাও নয়।
তবুও পরখ করে করে দেখার জন্য চিরল পাতায় হাত ছোঁয়ালাম। অমনি আমাকে অবাক করে বাসর রাতের নব পরিণতার মত নিজেকে গুটিয়ে নিল সেই গুল্ম পল্লব। যাই হোক, ওটা ছিল লজ্জাবতীর ভিন্ন এক প্রজাতির ভিন্ন এক সংস্করণ। আসল লজ্জাবতী গাছ দেখতে আমাকে ২৬ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। বছর খানেক আগে সচলায়তনে এক নস্টালজিক উদ্ভিদ প্রেমিকের গল্প নামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম।
সেখানে লজ্জাবতীর যে ছবিটা ছিল ওটাই আমার দেখা প্রথম লজ্জাবতী লতা। আজ যে ছবিগুলো দেখাচ্ছি এগুলোও একই গাছের, তবে সময়ের ব্যবধানে তিন বছর।
লজ্জাবতী লতা জাতীয় উদ্ভিদ। জানা মতে বাংলাদেশের মাঠে-ঘাটে যত্রএত্র এদের বসবাস ছিল। কিন্তু আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে।
বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ। সাধারণত বর্ষাকালেই জন্মায়। তবে উপযুক্ত পরিবেশ পেলে যেকোনো ঋতুতেই জন্মাতে পারে। ছবির এই চারাগুলো জন্মিয়েছে আমার স্কুল পড়ুয়া দুই খালাতো ভাই। ওপরের ছবিটি ১৫ মার্চ তোলা।
লজ্জাবতী লতানো উদ্ভিদ তাই সঠিক উচ্চতা নিরূপণ করা কষ্ট। সত্যি বলতে পরিবেশের অনুকূল-প্রতিকূল অবস্থার ওপর নির্ভর করে লতা জাতীয় উদ্ভিদ তাদের অঙ্গ বিস্তার করে। লতানো উদ্ভিদের আলাদা করে কাণ্ড চিহ্নিত না করাই ভাল। লজ্জাবতী লতা সবুজ রঙের। লতার গায়ে দেড় থেকে দুই ইঞ্চি পর পর ছ্ট্টো বাঁকানো কাঁটা থাকে।
লজ্জাবতীর বহুপত্রক উদ্ভিদ। পাতা চিরল-বিরল। পাতার বোটা তিন স্তরে সাজানো। প্রাথমিক স্তরে ৩/৪ ইঞ্চি লম্বা একটা বোঁটা থাকে। প্রতিটা প্রাথমিক বোঁটার আগা থেকে আবার দ্বিতীয় স্তরের বোঁটা বা চিকন শিরা থাকে।
দ্বিতীয় স্তরের বোঁটার দুই পাশে চিরলভাবে ১৫-২০ জোড়া পাতা সাজানো থাকে।
পাতা উপবৃত্তকার, ছোট ছোট। অনেকটা তেঁতুল পাতার মত দেখতে। পাতার রঙ ও সবুজ। পাতা সর্বোচ্চ এক সেন্টিমিটার লম্বা হতে পারে।
লজ্জাবতীর ফুল অসাধারণ সুন্দর। বেগুনী রংয়ের; গোল গোল ফুলগুলো দেখতে মেয়েদের নাকফুলের মত। বাবলা ফুলের সাথেও মিল আছে। ফুল এক পুষ্পক। সরাসরি শান্ত থেকে পুষ্পমঞ্জরি বের হয়।
ফুলের বোঁটা ১/১৫ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়। লজ্জাবতীর ফুলের পাপড়ি থাকে না। বরং ছোট্ট সবুজ বলের গায়ে অসংখ্য কিশোর পরপর সজ্জিত হয়ে ভীষণ সুন্দর এই ফুলটিকে পূর্ণাকৃতি দান করে। লজ্জাবতীর ফল দেখতে অনেকটা মাষকলইয়ের ফুলের মত। তবে আকারে অর্ধেক।
কাঁচা ফুলের রং সবুজ। পাকা ফলের রং কালচে বাদামি। একটা মাত্র বোঁটায় একটা ফুল ফুটলেও ফল হয় অনেকগুলো। এক গুচ্ছ আরকী। আসলে ফুলে তো পাপড়ি নেই।
আছে অসংখ্য কিশোর। প্রতিটা স্ত্রী কিশোর থেকেই একটা করে ফল বের হয়ে এক গুচ্ছ ফল গুচ্ছ তৈরি করে। লজ্জাবতীর কাঁচা ফল আমি দেখিনি এবার গ্রামে গিয়ে ফুল আর এক গুচ্ছ শুকনো ফলের দেখা পেলাম। ফুল যেহেতু ফাল্গুন মাসেই দেখলাম তাই ধরে নেযা যায়, লজ্জাবতী বাসন্তি ফুলের উদ্ভিদ বছরের অন্য সময় একটা কিনা জানা নেই। সেই ছবিগুলোও নিবেদন করলাম আপনাদের সামনে।
তাই অসম্পূর্ণ পোস্টের ক্রুটি-বিচ্যুতি মার্জনার চোখে দেখবেন।
লজ্জাবতীর ফলের ভেতর চার পাঁচটা ছোট্ট ছোট্ট দ্বিবীজপত্রি বীজ থাকে। বিজ দেখতে বেগুন কিংবা মরিচের বীজের মত।
লজ্জাবতীর বৈজ্ঞানিক নাম Mimosa pudica.
লজ্জাবতী গাছ আজ বিলুপ্তির পথে। এর পেছনে তিনটে কারণ মোটা দাগে চিহ্নিত করা যায়।
প্রথমত, জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বনজঙ্গল উজাড় করে বাসস্থান ও ফসলক্ষেত তৈরি।
দ্বিতীয়, জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও আরও অনেক বুনো উদ্ভিদ বহাল তরিয়তে বেঁচে-বর্তে আছে, কিন্তু লজ্জাবতীর প্রধান শত্রু বাংলাদেশের কোবরেজ সম্প্রদায়। এর কিছু ঔষধি গুণ আছে, সেগুলো আর উল্লেখ করতে চাই না। সেই ঔষধি গুণের লোভে কোবরেজরা মাঠকে মাঠ লজ্জাবতী গাছ উজাড় করেছেন, কিন্তু নিজের বাড়ির আঙিনায় বা বাগানে একটা লাগানোর প্রয়োজন মনে করেননি।
তৃতীয় কারণ, লজ্জাবতীর কাঁটা।
যাহায় রক্ষক, তাহায় মৃত্যুর কারণ। তৃণভোজী পশুদের বিপক্ষে এই কাঁটা অব্যার্থ অস্ত্র, কিন্তু চাষির বিপক্ষে তা মোটেও কার্যকর নয়। লজ্জাবতী যেখানে আস্তানা গাড়ে, দ্রুত ডালাপালা বিস্তার করে চাষির ফসলের ক্ষেত দখল করে নেয়। ফলে বিরক্ত চাষি তাদের ওপর ধারালো দা ব্যবহার করতে কুণ্ঠাবোধ করেন না।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।