শিক্ষার গুণগত মান বিষয়ে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা বলেছেন, নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে বাংলাদেশে শিক্ষার অগ্রগতি হলেও তা টেকসই নয়। তাঁরা বলছেন, কারও সহায়তা বা সমর্থনের দিকে তাকিয়ে না থেকে নিজেদের মেধা, সম্পদ ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শিক্ষার মান উন্নয়নের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
‘উর্বর মাঠে বীজ বোনা: যে শিক্ষা বাংলাদেশের কাজে লাগবে’ শীর্ষক ওই বৈঠক আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। এর আয়োজন করে প্রথম আলো এবং শিক্ষা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠনগুলোর মোর্চা গণসাক্ষরতা অভিযান। এ সময় বক্তারা শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে সরকার, দাতা সংস্থা, বেসরকারি সংস্থা, শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান।
বৈঠকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘দেশে-বিদেশে সবাই বলছে বাংলাদেশ শিক্ষায় এগিয়ে গেছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) অর্জন করছে। তার পরও বলব, সব সক্ষমতা নিয়েই আমাদের এগোতে হবে। আমরা যেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে না এগোই। ’
প্রাথমিক ও গণশিক্ষাবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, প্রাথমিক শিক্ষার মান মাধ্যমিককেও নিয়ন্ত্রণ করে এবং এই দুই স্তরের শিক্ষায় দুর্বলতা উচ্চশিক্ষায় প্রভাব ফেলে।
তিনি বলেন, ‘এখন উপাচার্যরা বলেন, জিপিএ-৫ পেয়েও ভর্তি-ইচ্ছুদের অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারছে না। শিক্ষার মানের অবস্থা বোঝার জন্য এটি একটি বড় একটি দৃষ্টান্ত। ’
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শ্যামল কান্তি ঘোষ বলেন, শিক্ষার মূল জায়গা শ্রেণীকক্ষ, শিক্ষকরা হলেন শ্রেণীকক্ষের প্রাণ। তাই শ্রেণীকক্ষে লেখাপড়া নিশ্চিত করতে পারলে এবং শিক্ষককে শক্তিশালী করা গেলে গুণগত মান আরও বাড়বে। তিনি আরও বলেন, প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার সমালোচনা করেন কেউ কেউ।
কিন্তু এর ফলে শিক্ষার্থীর মান চেনা ও জানা সম্ভব হচ্ছে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা মনজুর আহমেদ বলেন, প্রাথমিকে এখন প্রায় চার লাখ শিক্ষক, এক কোটি ১৭ লাখ শিক্ষার্থী। ছেলেমেয়েদের ঠিকভাবে পড়াতে চাইলে এবং শ্রেণীকক্ষে পড়াশোনার পরিবেশ বজায় রাখতে হলে এই মুহূর্তে আরও দুই লাখ শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। তিনি জাতীয় শিক্ষানীতি সুশৃঙ্খলভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলেও অভিযোগ তোলেন।
ভিড়ে ঠাসা শ্রেণীকক্ষে কীভাবে শিক্ষা দেওয়া যায়, সেই চেষ্টা করা এবং উপায় বের করার ওপর গুরুত্ব দেন সরকারের যুগ্ম সচিব এবং দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক চৌধুরী মুফাদ আহমেদ।
তাঁর মতে, শিক্ষার্থীরা সিলেবাস শেষ করল কি না, সেটি এখন শিক্ষক ও অভিভাবকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তারা কী শিখল, সেটি গুরুত্ব পাচ্ছে না। এর ফলে বর্ণমালা না শিখেই অনেকে তৃতীয় শ্রেণীতে উঠেছে। পঞ্চম শ্রেণীতে গিয়ে মাত্র এক-চতুর্থাংশ শিক্ষার্থী বাংলায় এবং এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী গণিতে দক্ষতা অর্জন করছে।
গণসাহায্য সংস্থার শিক্ষা কর্মসূচির প্রধান সামসে আরা হাসান বলেন, শ্রেণীকক্ষে প্রথম দুই বেঞ্চের শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে এখন শিক্ষা দেওয়া হয়।
আর শিক্ষকের লক্ষ্য থাকে বইটি শেষ করা। তিনি আরও বলেন, শিক্ষক সব বাচ্চার পড়া শোনেন না। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ছাড়া শিক্ষার গুণ ও মান নিশ্চিত হবে না বলে মত দেন তিনি।
অ্যাকশন এইডের এ-দেশীয় পরিচালক ফারাহ কবির প্রশ্ন রাখেন, সুস্থ ও সচেতন মনমানসিকতা তৈরির জন্য শিক্ষা, না চাকরি বা সম্পদ অর্জনের জন্য শিক্ষা—এ বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। তিনি বলেন, গুণ ও মানের বদলে এখন কত ভাগ পাস করল, কতজন জিপিএ-৫ পেল, তা নিয়ে দৌড়ঝাঁপ চলে।
তাঁর মতে, এজন্য শিক্ষার্থীরা নয়, নীতিনির্ধারক, শিক্ষক, শিক্ষা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই দায়ী।
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় যে বিনিয়োগ শুরু হয়েছে, তা যৌক্তিক এবং এর সুফল ভবিষ্যতে পাওয়া যাবে বলে মনে করেন সেভ দ্য চিলড্রেনের শিক্ষা উপদেষ্টা ম. হাবিবুর রহমান। তবে তাঁর মতে, প্রাক-প্রাথমিকের শিক্ষা সফল করতে হলে সরকার, দাতা ও বেসরকারি সংস্থাকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
বৈঠকে বাংলাদেশে শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের ওপর কয়েকজন বক্তা আলোচনা করেন। বিশ্বব্যাংকের শিক্ষাবিষয়ক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সুব্রত শংকর ধর বলেন, গবেষণায় পাওয়া তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যাচ্ছে, শিক্ষার মানের সঙ্গে ভৌগোলিক অঞ্চল, শিক্ষকের বয়স এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মানসহ বিভিন্ন বিষয় জড়িত।
এসব তথ্যের ভিত্তিতে নীতি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের প্রস্তাব করেন তিনি।
জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) শিক্ষা-ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মোহসিন বলেন, প্রাথমিক শিক্ষার তত্ত্বাবধান খুবই দুর্বল। চিকিত্সক ভুল করলে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা যায়। কিন্তু শিক্ষকের কারণে একটি শিশু পঙ্গু হয়ে বেড়ে উঠলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে কমিউনিটি লার্নিং সিস্টেম গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।
প্রায় চার দশক ধরে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনের আঞ্চলিক শিক্ষা উপদেষ্টা জেমস জেনিংস। তিনি এ দেশে শিক্ষকতা করেছেন। তাঁর মতে, একসময় বাংলাদেশে স্লোগান ছিল আপনার সন্তানকে স্কুলে পাঠান। এখন সেই প্রচারের তেমন প্রয়োজন নেই। এর কারণ গত ৪০ বছরে সরকার, দাতা ও বেসরকারি সংস্থার চেষ্টায় এবং সমাজ সচেতন হওয়ায় প্রায় সবাই স্কুলে যাচ্ছে।
তাঁর মতে, দারিদ্র্য এ দেশের শিশুদের ঝরে পড়ার মূল কারণ।
শিক্ষকের মান নিয়ে প্রশ্ন: এডুকেশন কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স ফাউন্ডেশনের সভাপতি ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এম শমশের আলী বলেন, একজন ভালো শিক্ষক বটতলায় দাঁড়িয়ে ক্লাস নিলেও তা শিক্ষার্থীদের মধ্যে আকর্ষণ সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসেও কম যোগ্য শিক্ষকের ক্লাস আকর্ষণ তৈরি করবে না। তিনি আরও বলেন, কম যোগ্যতার যেসব শিক্ষক আছেন, তাঁদের বাদ দেওয়া সম্ভব নয়। এঁদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যোগ্য করতে হবে।
সেখানে প্রশ্ন শিক্ষকের সংখ্যা নিয়ে। তাঁর মতে, দূরশিক্ষণের মাধ্যমে এই প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য কাজী সালেহ আহমেদ বলেন, গুণগত শিক্ষা চাইলে মানসম্মত শিক্ষক দরকার, যা খুবই কম। তিনি বলেন, ‘শ্রেণীকক্ষে লেখাপড়া নেই। গরিব পরিবারের সন্তান প্রাইভেট পড়তে পারে না, গাইড পড়তে পারে না।
তাহলে শিক্ষার মান আসবে কোথা থেকে?’
প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ূম বলেন, শিশুরা যাতে বিদ্যালয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ হয়, সেই চেষ্টা করতে হবে। বিদ্যালয়ে শিশুদের যেকোনো শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার থাকার অনুরোধ জানান তিনি।
বৈঠকে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানবসম্পদ উন্নয়ন বিভাগের প্রধান লিবুসে সুকুপোভা, গণসাক্ষরতা অভিযানের পরিচালক তাসনিম আতাহার, উপপরিচালক কে এম এনামুল হক ও উপকার্যক্রম ব্যবস্থাপক কামরুন্নাহার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন গণাসক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী ও আব্দুল কাইয়ূম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।