৫ জানুয়ারি নির্বাচনের ক্ষত না শুকাতেই আরেকটি কলঙ্কিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। কেউ দাবি করবেন না যে নির্বাচনী কারচুপি ও সহিংসতার ব্যাপকতা দেখে যথেষ্ট বিস্মিত হয়েছেন। তবে বিএনপি আত্মতৃপ্তি পেতে চাইছে যে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন যে অবাধ হতে পারে না, সেটা আবারও প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু যেটা দেখার বিষয় সেটা হলো, দেশে তারা কেবল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে চাইছে।
একটা সময় দুই প্রধান দলই ক্ষীণ স্বরে হলেও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনটাও সেরে ফেলা উচিত বলে মত দিয়েছিল।
কিন্তু তারা কোনো পক্ষ থেকে এর সুনির্দিষ্ট রূপরেখা দেয়নি বা দিতে পারেনি। তার কারণ, এটা খুব বাস্তবসম্মত নয়।
স্থানীয় সরকার বা জাতীয় নির্বাচন যখন ব্যক্তি বা কোনো গোষ্ঠীর ব্যক্তিগত মর্যাদা লড়াইয়ের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয় এবং বিদ্যমান আইন তাকে তা করতে সমর্থন করে, তখন তাতে জনসাধারণের কার্যকর অংশগ্রহণের আকাঙ্ক্ষা অবদমিত ও অকার্যকর থাকতে বাধ্য। তারা দর্শক হতে বাধ্য। কোনো সন্দেহ নেই, সারা দেশে খণ্ডিতভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে কেলেঙ্কারির যে নতুন উপাখ্যান রচিত হয়েছে, তাতে কেবল প্রথাগতভাবে কোনো একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর কাঁধে শতভাগ দায় চাপানো যাবে না।
বিষয়টি এভাবে ভাবতে পারলে খুশি হতাম যে এটা কেবলই ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতিজনিত সমস্যা। খতিয়ে দেখতে হবে যে ক্ষমতাসীন দল কেন ও কীভাবে উপজেলা নির্বাচনটা বহু ক্ষেত্রে হাইজ্যাক করে নিতে সক্ষম হয়েছে। কেন কোথাও মানুষ রাস্তায় নামল না? তার চেয়েও বড় কথা, কেন বিরোধী দল স্থানীয়ভাবেও একটি হরতাল সফল করতে পারল না? শুধুই ভয়ে? এ প্রশ্নের উত্তর সম্ভাবনাময় প্রার্থীরা মূলগতভাবে জনবিচ্ছিন্ন। সেটা এই অর্থে প্রবল যে শাসনে ভোটারদের শ্বাস ফেলারও সুযোগ নেই।
একটি প্রশ্নের উত্তর সহজ যে ক্ষমতাসীন দল এতটাই ক্ষমতান্ধ হয়ে পড়েছে যে তারা আর জনমতের তোয়াক্কা করছে না।
৫ জানুয়ারি ‘অভাবনীয় সাফল্যের’ পরে তারা আরও আত্ম-অহংকারী হয়ে উঠেছে যে আগামী পাঁচ বছরে তারা যেকোনো ধরনের মিস অ্যাডভান্সার করে পার পেতে পারে। মুরব্বিরা যে যেথায় আছেন, তাঁরা বেজার হবেন না।
উপজেলা নির্বাচনটা অনেক ক্ষেত্রে হাইজ্যাক করাটার মূল ভরসা হলো জনগণকে এই নির্বাচনী-প্রক্রিয়ায় পদ্ধতিগতভাবে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছে। সুতরাং তাদের পিঠ একান্ত দেয়ালে না ঠেকলে তারা কি স্থানীয় আর কি জাতীয়, তারা প্রতিবাদী হবে না, রাস্তায় নামবে না। সাধারণভাবে দুই দলের গণবিরোধী কাণ্ড-কীর্তির জন্য দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া দীর্ঘকাল ধরে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে আছে।
এখন কেবল ভোট কারচুপি ও সহিংসতাজনিত কারণে জনগণ ফুঁসে উঠবে না। মানুষ মানে ভোটাররা, তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের হাজারো ঝকমারি সামলে নিচ্ছে। সামাজিক সন্ত্রাস ও নানাবিধ ঝুঁকি মোকাবিলা করে তারা ঠিকই ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সমষ্টিগত জীবনের চাকা এগিয়ে নিচ্ছে। অর্থনীতি ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নানা ধরনের অনিয়ম, কারচুপি ও সহিংসতার মুখোমুখি হচ্ছে। কিন্তু সে জন্য তারা কেউ হাত গুটিয়ে বসে নেই।
তারা কিন্তু অধিকার আদায় করেই পথচলা বজায় রাখছে। কিন্তু নির্বাচনের মতো একটি রাজনৈতিক অধিকার প্রয়োগের প্রশ্নে তাদের ঔদাসীন্য ও নিরাসক্ত মনোভাব লক্ষণীয় বিষয়। এবারের নির্বাচনের আরও একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর যেসব স্থান শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত, সেসব স্থানের মিথ ভেঙে গেছে। গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগ, রংপুরে জাতীয় পার্টি, সাতক্ষীরায় জামায়াতে ইসলামী এবং ফেনীতে বিএনপির প্রার্থীদের ভরাডুবি আমাদের স্বস্তি দিচ্ছে। কারণ, এটা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে বাংলাদেশ ব্যক্তির ক্যারিশমানির্ভর কাল্ট সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার প্রবণতা দেখাচ্ছে।
কিন্তু কোথাও অন্যায়ভাবে পরাজিত প্রার্থী কিংবা নির্বাচনের আগে যেসব স্থানে ফলাফলের ভাগ্য নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল, সেখানে কোনো কার্যকর ও অর্থপূর্ণ প্রতিবাদ দেখা যায়নি। দক্ষিণাঞ্চলীয় একটি জেলায় একজন উপজেলা নির্বাচন পদপ্রার্থী এমন একজন প্রার্থীকে মোকাবিলা করেন, যিনি যোগ্য প্রার্থী কিন্তু এলাকার সঙ্গে তাঁর কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। তিনি একেবারেই অতিথি প্রার্থী ছিলেন। এখানে কার্যকর নির্বাচন হয়নি। মেরেকুটে বাক্স ভরার বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ রয়েছে।
কিন্তু সেখানেও ওই পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির প্রার্থী কোনো প্রতিবাদ করতে পারেননি। না একটি মিছিল, না একটি প্রতিবাদ সভা। তাহলে গণতন্ত্র কোথায় রইল। শুনলাম নির্বাচনের আগে তাঁর কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা কয়েকটি হয়রানিমূলক মামলা তাঁকে কোনো কর্মসূচি দিতে নিরুৎসাহিত করেছে। এখন প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ এই ভয়ভীতির শাসন থেকে কবে কত মেয়াদে মুক্তি পাবে?
আমাদের এই প্রশ্নের জবাব পেতে হবে যে অবিলম্বে একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে আগামী উপজেলা নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও কারচুপিমুক্ত হওয়ার গ্যারান্টি দেবে কি না।
এর উত্তর যদি না হয় তাহলেও প্রশ্ন উঠবে, সেটা দেবে না বলে ক্ষমতাসীন দল বিরোধী দলের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে অনির্দিষ্ট মেয়াদে প্রত্যাখ্যান করে চলতে পারবে কি না? আরও কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর পাওয়া দরকার। দেশ কীভাবে ও কাদের দ্বারা পরিচালিত হবে, তা বাংলাদেশের মানুষের মুঠোবন্দী কি না? এর উত্তরও যদি না হয়, যদি উত্তর হয় এটা বিদেশি বা অদৃশ্য শক্তির ওপর অনেকটা নির্ভর করে, তাহলে নজর রাখতে হবে সেই বিষয়গুলো নিকট ভবিষ্যতে যথেষ্ট বদলে যাচ্ছে কি না? বদলে গেলেও সরকারকে তা ত্রস্ত ও উদ্বিগ্ন করবে কি না?
যেসব স্থানে সত্যি কারচুপি হয়েছে, বিশেষ করে যেসব উপজেলায় ‘ভোট গ্রহণ শুরুর আগেই সিল মারা ব্যালট বাক্সে ভরে রাখা হয় প্রশাসনের সহায়তায়’, সেখানে বিএনপিকে অবিলম্বে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ নিশ্চিত করতে হবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদেরও এগিয়ে আসতে হবে সেসব স্থানে প্রতিবাদ সমাবেশ করতে, যেখানে ‘প্রতিপক্ষ এমনকি দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থীকেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে কোণঠাসা, এলাকাছাড়া করার অনেক ঘটনা ঘটেছে। ’
এটা হলো সাময়িক দাওয়াই। আর স্থায়ী কথাটি হলো, বিএনপি নির্দিষ্ট সুপারিশ আনতে পারে যে তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনগুলো একই ব্যালটে সম্পন্ন করা।
তবে তার চেয়েও স্থায়ী হলো নির্বাচনব্যবস্থাকে তছনছ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হাতে যে সর্বময় ক্ষমতা, তার অঙ্গুলি হেলনে যে এই রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালিত হয়, তা পাল্টাতে সাংবিধানিক ও নির্বাচনব্যবস্থায় ব্যাপকভিত্তিক পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করা। সেটা আগামী সাধারণ নির্বাচনকালেই করতে হবে, তা হয়তো নয়। কেবল বিএনপি নয়, সচেতন সব মহল থেকে বর্তমান নির্বাচন ও দলীয় রাজনৈতিক পদ্ধতি বদলানোর কথাটা জোরেশোরে তুলতে হবে।
আসলে জনগণের স্বার্থ নির্বাচন-প্রক্রিয়ার সঙ্গে যথেষ্ট রকম যুক্ত করতে না পারলে সুষ্ঠু নির্বাচন করা যাবে না। তার দৈনন্দিন জীবন বয়ে নিতে উপজেলা চেয়ারম্যানের ভূমিকা গৌণ থাকলে, তার নির্বাচনে কী হলো আর না হলো তাতে তার কী? উপজেলা চেয়ারম্যানের স্থলে ইউএনওকেও যদি নির্বাচিত হতে হতো, তাহলে কারচুপি করা হয়তো এত সহজ হতো না।
একটা শিক্ষা হলো, ভাগ করে নির্বাচন করা কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন সুষ্ঠু নির্বাচনের শক্তিশালী রক্ষাকবচ নয়। কারণ, এই রাষ্ট্রব্যবস্থা এক ব্যক্তির অঙ্গুলি হেলনে ওঠাবসা করে। এরশাদীয় ভোট ডাকাতি ফিরে এসেছে বলে হায় হায় করা প্রতিকার নয়। আয়নায় মুখ দেখতে হবে যে আমরা এরশাদকে সরিয়েছিলাম, পদ্ধতিকে নয়।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।