আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সরকার কি সত্যকে ভয় পায়? - সোহরাব হাসান

সম্প্রতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার যে কাজটি করে রাজ্যব্যাপী বিতর্কের সৃষ্টি করেছে, তাহলো পাঠাগারগুলো থেকে বহুল প্রচারিত বাংলা পত্রিকাগুলো উধাও করে দেওয়া। গত মে মাসে রাজ্য সরকারের গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, রাজ্যের পাঠাগারগুলোতে সংবাদ প্রতিদিন, সকাল বেলা, একদিন, দৈনিক স্টেটসম্যান এবং দুটি উর্দু ও একটি হিন্দি পত্রিকার বাইরে কোনো পত্রিকা কেনা যাবে না। বহুল প্রচারিত আনন্দবাজার পত্রিকা ও বর্তমান এই তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। বাদ দেওয়া হয়েছে ইংরেজি পত্রিকাও। প্রায় অনুরূপ তুঘলকি কাণ্ড ঘটিয়েছে বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন মহাজোট ওরফে আওয়ামী লীগ সরকার।

মেয়াদের তিন বছর ১১ মাসের মাথায় এসে সরকারি খরচে সরকারি অফিসে কেনার জন্য তিনটি বাংলা ও দুটি ইংরেজি পত্রিকা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে তারা। পত্রিকাগুলো হলো: জনকণ্ঠ, সংবাদ, ইত্তেফাক (বাংলা) এবং দ্য সান ও দি ইনডিপেনডেন্ট (ইংরেজি)। ৬ ডিসেম্বর তথ্য মন্ত্রণালয় সরকারের এ সিদ্ধান্ত সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থাকে অবহিত করেছে। (কালের কণ্ঠ, ১৯ ডিসেম্বর ২০১২)। খবরটি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক।

একটি গণতান্ত্রিক সরকার এমন অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে! স্বৈরাচার সরকারগুলো সামরিক ফরমান দিয়ে দেশ চালাত। তারা একেক সময় একেক সিদ্ধান্ত নিত। স্বৈরাচার এরশাদের আমলে একবার সেনানিবাসে দৈনিক সংবাদসহ কয়েকটি পত্রিকার প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এরশাদের ভয় ছিল, এসব পত্রিকায় যেসব খবর ও ভাষ্য ছাপা হয়, তা সেনানিবাসের মানুষগুলোকে জানানো যাবে না। জানালে সমস্যা হবে।

বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারকেও মনে হচ্ছে গণমাধ্যম-আতঙ্কে পেয়ে বসেছে। তারাও জনগণকে ভয় পাচ্ছে। সরকারের অডিট ব্যুরো অব সার্কুলেশনের (এবিসি) সর্বশেষ নিরীক্ষায় প্রচারসংখ্যায় শীর্ষে থাকা পত্রিকাগুলো হলো: প্রথম আলো, বাংলাদেশ প্রতিদিন, কালের কণ্ঠ ও যুগান্তর। এরপর ইত্তেফাক ও সমকাল। ইংরেজি পত্রিকার মধ্যে ডেইলি স্টার-এর প্রচারসংখ্যা সবচেয়ে বেশি।

কিন্তু সরকারি অফিসে কেনা পত্রিকার তালিকায় প্রথম আলো বা ডেইলি স্টার নেই। নেই জনপ্রিয় অন্যান্য দৈনিকও। প্রশ্ন হলো, সরকার কিসের ভিত্তিতে এই তালিকা তৈরি করেছে? এ ব্যাপারে কি কোনো কমিটি গঠন করা হয়েছিল? সেই কমিটিতে কারা ছিলেন? আর যদি কমিটি গঠন না হয়ে থাকে, তাহলে কে এই সিদ্ধান্ত নিলেন? তথ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে তথ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো ভূমিকা নেই। তারা শুধু সরকারের সিদ্ধান্তটি বিভিন্ন দপ্তরে জানিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ ডাকবাক্সের দায়িত্ব পালন করেছে।

এই হলো আমাদের গণমাধ্যমবান্ধব তথ্য মন্ত্রণালয়! সরকারি খরচে সরকারি অফিসে পত্রিকা কেনা হয় কারও ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য নয়। রাষ্ট্রের ও জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য। পত্রিকাগুলো সরকার কিনলেও মন্ত্রী বা আমলারা পকেট থেকে একটি পয়সাও দেন না। জনগণের করের পয়সায় পত্রিকা কেনা হয়। সে ক্ষেত্রে কোন পত্রিকা কার জন্য সরকার কিনছে, তা জানার অধিকার জনগণের আছে।

সরকারি অফিসে পত্রিকা কেন কেনা হয়? সরকারের নীতিনির্ধারকেরা, সরকারি কর্মকর্তারা যাতে দেশ ও জনগণের সঠিক খবরটি পেয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারেন, সে জন্য। উন্নয়নের হালনাগাদ খবরের পাশাপাশি বিভিন্ন দপ্তরের অনিয়ম ও দুর্নীতি-সম্পর্কিত তথ্য-উপাত্তও পত্রিকার মাধ্যমে তাঁরা জানতে পারেন। অনেক সময় পত্রিকায় প্রকাশিত একটি চিঠিও অনেক বড় সমস্যা সমাধানে সহায়ক হতে পারে। সরকার যে পাঁচটি পত্রিকা সরকারি অফিসে কেনার জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, সেগুলোই যে দেশ ও জনগণের সঠিক খবর পরিবেশন করে, সেই আজগুবি তথ্য মন্ত্রী-আমলারা কোথায় পেলেন? যেসব সংবাদপত্র বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে প্রচারসংখ্যার শীর্ষে রয়েছে, সরকার বেছে বেছে সেই সব সংবাদপত্র সরকারি ক্রয় তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে। এর একটিই কারণ থাকতে পারে।

এসব পত্রিকা সরকারের ভালো কাজের প্রশংসার পাশাপাশি মন্দ কাজের সমালোচনাও করে। কিন্তু সরকার সমালোচনা শুনতে চায় না। সত্যকে ভয় পায় এবং সরকারি কর্মকর্তাদেরও সত্য জানতে দিতে চায় না। সরকারের অবগতির জন্য জানাচ্ছি, বর্তমানে প্রথম আলো ছাপা হচ্ছে পাঁচ লাখ ৩০ হাজারের বেশি। অনলাইনে এর নিয়মিত পাঠক ১৪ লাখ এবং ১৯০টি দেশ থেকে বাঙালি প্রথম আলো পড়েন।

প্রতিদিন ৬০ লাখের বেশি বাঙালি প্রথম আলো পড়েন। কিন্তু সেই পত্রিকাটিকে সরকারি অফিসে কেনা পত্রিকার তালিকা থেকে বাদ দিয়ে সরকার দেশবাসীকে কী বার্তা দিতে চায়? সরকারি অফিসে প্রথম আলোসহ বহুল প্রচারিত পত্রিকাগুলো না কিনলেই কি দেশের সমস্যা আড়াল করা যাবে? সরকারের দুর্বলতা ও দীনতা ঢাকা যাবে? এ প্রসঙ্গে সরকারের নীতিনির্ধারকদের আরও একটি তথ্য জানানো প্রয়োজন, হল-মার্ক কেলেঙ্কারি, ডেসটিনির অনিয়ম- দুর্নীতি, পদ্মা সেতু প্রকল্প ইত্যাদি সম্পর্কে সঠিক খবরই প্রথম আলো প্রকাশ করে আসছে। আগে সরকারের সমালোচনা করে এমন পত্রিকা বিমানে বা সরকারি পরিবহনে রাখা হতো না। এখন পুরো প্রশাসনকেই সেই ‘নিষেধাজ্ঞার’ আওতায় এনে সরকার কী ফায়দা পেতে চায়? সরকারি অফিসে পত্রিকা কেনা হয় জনগণের অর্থে, তাঁদের করের পয়সায়। অতএব সেই পত্রিকা কেনার বিষয়েও সরকারের জবাবদিহি থাকতে হবে।

সরকার কিসের ভিত্তিতে পাঁচটি পত্রিকার বাইরে আর সব পত্রিকা সরকারি অফিসের জন্য ‘নিষিদ্ধ’ করে দিল? তালিকাভুক্ত এই পাঁচটি পত্রিকার বাইরে সব পত্রিকাকে কি সরকার ‘দেশদ্রোহী’ মনে করে? না হলে দেশের সর্বাধিক প্রচারিত পত্রিকাটি সরকারি অফিসে পত্রিকা ক্রয়ের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার কী কারণ থাকতে পারে? এত দিন বিভিন্ন সরকারি দপ্তর ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা নিজেদের বুদ্ধিবিবেচনামতো পত্রিকা কিনতেন। সে ক্ষেত্রে ঘুরেফিরে বহুল প্রচারিত পত্রিকাগুলো কোনো না কোনো অফিসে কেনা হতো এবং সেই সব পত্রিকার তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে তাঁরা প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতেন। এখন আর সেই সুযোগ রইল না। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের আওয়াজ তুলে ক্ষমতায় আসা সরকার এখন সবকিছু ‘ওপর’ থেকে চাপিয়ে দিচ্ছে। কাকে ধরা হবে, সেটি ‘ওপর’ থেকে সিদ্ধান্ত হয়।

কাকে ছাড়া হবে, সেই সিদ্ধান্তও আসে ‘ওপর’ থেকে। সবশেষে সরকারি অফিসে কোন পত্রিকা কেনা হবে, সেই সিদ্ধান্তও এল ‘ওপর’ থেকে (তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী)। এরপর হয়তো সরকারি কর্মকর্তারা বাসায় কী পত্রিকা রাখবেন কিংবা কোন টিভি চ্যানেল দেখবেন, সেই নির্দেশনাও আসবে ‘ওপর’ থেকে! কিন্তু সব ওপরের ‘ওপরে’ যে জনগণ আছে, সে কথা কি একবারও নীতিনির্ধারকেরা মনে রাখেন না। পশ্চিমবঙ্গে মমতা সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রাজ্যজুড়ে প্রতিবাদ হয়েছে। জনস্বার্থে একজন কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেছেন।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো জেদি মুখ্যমন্ত্রীও জনমতের কাছে নতি স্বীকার করে তালিকা পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হয়েছেন। বাংলাদেশে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী মহাজোট সরকার কী করবে? সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক। দৃষ্টি আকর্ষণ: আজকের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত অন্যান্য সকল কলাম একসাথে দেখতে এখানে ক্লিক করতে পারেন  ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.