লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। এ কীসের লক্ষণ?
মোহাম্মদ ইসহাক খান
ডাক্তার সাহেব, আমার ছেলেকে নিয়ে বিরাট সমস্যায় পড়েছি।
ডিটেইলস বলুন।
কিছু বাদ দেবেন না। একেবারে আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত সব। ডাক্তার সাহেব অত্যন্ত গম্ভীর মুখে বললেন।
স্যার, এতদিন সবকিছু ভাল চলছিল। ছেলে আমার দিব্যি সুস্থ ছিল।
ভার্সিটিতে যেত, নিয়মিত ক্লাস করতো, হাসিখুশি একটা ছেলে। হঠাৎ দেখা দিলো গুরুতর সমস্যা।
একদিন ওর আচার-আচরণ বদলে গেল একেবারেই। যে ছেলে খুব দিলখোলা, মিশুক টাইপের ছিল, সে প্রবল চোরা স্বভাবের হয়ে গেল। কথাই বলতে চায় না, আমাকে আর ওর মা'কে এড়িয়ে চলে, সামনে পড়লে পালিয়ে যায়, কিছু জিজ্ঞেস করলে হ্যাঁ-হুঁ করে জবাব দেয়।
নিজের ঘরে সারাদিন বসে থাকে, আবার হঠাৎ হঠাৎ কার ফোন পেয়ে যেন হাওয়া হয়ে যায়। ফেরে অনেক রাতে।
কেমন যেন উদাস উদাস ভাব। চোখের দিকে তাকালে মনে হয় শুন্য দৃষ্টি। পড়তে বসে নিয়মিতই, কিন্তু দেখলেই বোঝা যায় পড়াশোনায় একটুও মন নেই।
মাঝে মাঝে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখভঙ্গি করে কী কী যেন বলে। একা একা কথা বলে, থেকে থেকে একা একাই হাসে।
বলেছিলাম যে কথাবার্তা বলতেই চায় না। আবার কখনো কখনো যেন মুখের লাগাম খুলে যায়, একটানা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে যেতে থাকে, উল্টোপাল্টা, অর্থহীন কথাবার্তা। সেদিন আমাকে বলল, বাবা, তোমাকে তো খুব সুন্দর লাগছে।
বলেই জিভ কেটে পালিয়ে গেল। আমি তো হতভম্ব।
প্রথমে ভেবেছিলাম, পড়াশোনার চাপে হয়তো মাথার স্ক্রু একটু ঢিলে হয়ে গেছে। আজকালকার ছেলেপুলেদের ওপর যা চাপ দেয়। কিন্তু কই, আর কারো তো এমন অবস্থা দেখি না।
জিজ্ঞেস করাতে নিজেও বলল যে পড়াশোনার চাপ তেমন নেই।
তারপর আমি বাবা হয়েও ভাবলাম যে ছেলে হয়তো নেশা-টেশা করা শুরু করেছে, আজেবাজে গুণ্ডাপাণ্ডাদের সাথে জুটেছে। অনেক ভাল ছেলেও তো বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে বিড়ি-সিগারেট ধরে। তাই হয়তো সে-ও ধরেছে। আমি কিন্তু ওর অগোচরে ওর সারা ঘর চষে ফেলেছি, কিন্তু সিগারেট, তামাক, হেরোইন, গাঁজা, গুল কিছুই পাই নি।
ছেলে খাওয়াদাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছে বলা যায়। কিছুই মুখে দিতে চায় না। ঘরে যতক্ষণ থাকে, বিছানায় শুয়ে ঘরের ছাদের দিকে চেয়ে থাকে। সারারাত ঘুমোয় না, চোখের নিচে কালই পড়ে গেছে। আমি গোপনে দেখেছি, সারারাত বারান্দায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
আর একটা কথা স্যার, ওর ভয়ানক কোষ্ঠকাঠিন্য। দু'তিন দিন ধরে বাথরুম করতে পারছে না। কি লজ্জার বিষয় বলুন তো।
এখন বলুন স্যার, এর কী ব্যাখ্যা করবেন? ছেলে আমার মরে-টরে যাবে না তো? ওর মা তো টেনশনে অস্থির। খালি কথায় কথায় মুখে আঁচল দিয়ে কান্নাকাটি করছে।
ডাক্তার সাহেব বললেন, সকল লক্ষণ বিবেচনা করে বোঝা যায়, এটা একটা রোগই হতে পারে।
কী, স্যার? ছেলের বাবা ব্যগ্র কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন।
আপনার ছেলে প্রেমে পড়েছে।
প্ প্ প্ ... ... প্রেম?
হ্যাঁ, প্রেম। ভালোবাসা।
মহব্বত। ইশক। নিতান্ত গোবরগণেশ ছেলেরাও প্রেমে পড়লে এসব অস্বাভাবিক আচরণ করে থাকে। উদাস উদাস মন, চোরস্বভাব, রাত জাগা, পড়াশোনায় অমনোযোগিতা, খাবারে অরুচি, সবকিছুই পয়েন্টে পয়েন্টে মিলে যায় প্রেমে পড়ার লক্ষণগুলোর সাথে। প্রেমাস্পদকে একদিন না দেখলে জীবন অর্থহীন এবং শুন্য মনে হয়।
মিথ্যে বলার প্রবণতা বেড়ে যায়। মোবাইল ফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলা এবং ফেসবুকে অস্বাভাবিক দীর্ঘ সময় বসা অভ্যেসে দাঁড়িয়ে যায়। আকাশের চাঁদ এবং তারা দেখা বাতিকের রূপ নেয়। রোগের প্রবল অবস্থায় প্রেমাস্পদের বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, প্রেমিকার কুকুরকে জড়িয়ে ধরে আদর করা, খালি পায়ে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটা, কাব্য রচনা, নিজেকে মজনু এবং প্রেমিকাকে লাইলি কল্পনা করা ইত্যাদি দেখা দেয়। আপনার ছেলে এখন রোগের "সেকেন্ডারি" পর্যায়ে আছে, অর্থাৎ মাঝামাঝি।
কয়েক মাসের মধ্যেই পরের স্টেজের লক্ষণগুলো দেখা দেবে। আপনার কোন সন্দেহ থাকলে ছেলের মোবাইল ফোনের কললিস্ট চেক করে দেখতে পারেন। সেই মেয়ের ডাকেই যখন-তখন আপনার ছেলে বাইরে চলে যাচ্ছে। অদৃশ্য দড়িতে বাঁধা পড়েছে সে, এখন সে নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই। ঐ মেয়ে তাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছে।
একটু থেমে ডাক্তার বললেন, অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে আজকাল মহামারী আকারে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। সব লক্ষণ শুনেও আমার মধ্যে একটু খটকা ছিল, কিন্তু কোষ্ঠকাঠিন্যের ব্যাপারটা শুনে আমি নিশ্চিত, সে প্রেমে পড়েছে। প্রচণ্ড মানসিক চাপের কারণে প্রথমেই পরিপাকতন্ত্রে ঝামেলা দেখা দেয়। তাই সকল প্রেমিক পুরুষই গুরুতর কোষ্ঠকাঠিন্যের রোগী। সারাদিন টয়লেটে বসে থাকলেও বাথরুম হয় না।
হা হা হা, মজার ব্যাপার না? মেয়েদের ক্ষেত্রে সমস্যাগুলো একটু অন্যরকম, তবুও অনেক মিল পাওয়া যায়। আপনার কি কোন মেয়ে আছে? থাকলে আগে থেকেই লক্ষণগুলো বলে দিতে পারি, সাবধান হতে পারবেন।
ভদ্রলোক মাথা নেড়ে বললেন, না স্যার, মেয়ে নেই। কিন্তু এখন উপায় কী, ডাক্তার সাহেব? এই রোগের কোন দাওয়াই নেই? তিনি নিজেও হাসছেন, কিন্তু হাসিটা অত্যন্ত শুকনো। হাসিতে প্রাণ আসছে না।
আছে। যত মুশকিল তত আসান। রোগ থাকলে ওষুধও থাকবে, এটাই নিয়ম। উপায় আছে দুটো। অস্থায়ী সমাধান এবং স্থায়ী সমাধান।
সেটা আবার কেমন?
অস্থায়ী সমাধান হল - প্রহার।
প্রহার?
হ্যাঁ। প্রহার। উত্তম-মধ্যম। ধোলাই।
"বানানো"। শক্ত মার। পিটুনি। "ডলা"। পিটুনি দিতে লাঠি, জুতো, গাছের ডাল ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে।
এত বড় ছেলেকে ধরে গরুর মতো পেটাবো? ছেলের বাবা মিনমিন করে বললেন।
এত দমে গেলেন কেন? বৃহত্তর স্বার্থে এটা করা যেতে পারে। You have to be cruel only to be kind. আপনি ছেলের বাবা, আপনি তো ওর সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল কামনায় একটু-আধটু মারধোর করতেই পারেন, পারেন না? বয়স আবার কী? পিতামাতার কাছে সব ছেলেমেয়েই "বাচ্চা"।
ছেলের বাবা হাত কচলে বললেন, তা তো বটেই স্যার, তা তো বটেই।
ডাক্তার বললেন, তবে এই অস্থায়ী পদ্ধতিতে একটু সমস্যা আছে।
কী সমস্যা, স্যার?
সবার ক্ষেত্রে এটা ভাল কাজ করে না। অনেকে দু'তিন দফা "ডলা" খেয়েই সিধে হয়ে যায়, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। কিন্তু অনেকে একেবারেই কন্ট্রোলের বাইরে চলে যায়, মাথা বিগড়ে যায়। তখন আর তাকে সারানোর কোন উপায় থাকে না।
স্থায়ী পদ্ধতিটি কী?
বিয়ে।
বিয়ে?
হ্যাঁ। বিয়ে। যাকে সে পছন্দ করে, তার সাথে বিয়ে। বিবাহ। নিকাহ।
শুভদৃষ্টি। পরিণয়। এসব সম্পর্কে শেষ পর্যন্ত যেতে পারলেই ছেলেমেয়েরা শান্ত হয়। কারণ বিয়ের পরপরই তারা আবিষ্কার করে, যাকে না দেখলে এবং কথা না বললে জীবন অন্ধকার ঠেকে, তার মধ্যে আসলে আকর্ষণীয় কিছুই নেই, নিতান্তই একজন সাধারণ মানুষ, যার মধ্যে পছন্দের জিনিসের চেয়ে অপছন্দনীয় জিনিসগুলোই বেশি, হা হা হা। এই কথাটা আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, কাজেই সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
এতে কাজ হয়? বিয়ে দিলেই সমস্যা খতম?
কাজ তো হবেই। পশ্চিমা দেশগুলোতে অবশ্য বিয়ে কোন সমাধান নয়। তারা ঘরে বউ রেখেও বাইরে এক বা একাধিক, ক্ষেত্রবিশেষে দুই অংকের ওপরে প্রেম করে বেড়ায়। আমাদের দেশে এখনো এই দুঃসময় ততটা প্রকটভাবে আসে নি। তবে শীঘ্রই চলে আসবে।
হিন্দী সিরিয়াল এবং পারস্পারিক অবিশ্বাসের কল্যাণে পরকীয়াও এপিডেমিক আকার নিচ্ছে। দিনকাল খুব খারাপ পড়েছে, বুঝলেন, আপনার-আমার মতো বুড়ো হাবড়ারাও এই সমস্যার বাইরে নয়, ছেলেপুলের কথা তো বাদই দিলাম। কিছু মনে করবেন না, বুড়ো হাবড়া বলে ফেললাম।
ভদ্রলোক বললেন, না না স্যার, মনে করার কী আছে? ঠিকই বলেছেন। যথার্থ বলেছেন।
অবশেষে ডাক্তার সাহেব বললেন, আমার কথা শেষ। এখন ঠিক করুন, আপনি ছেলেকে কোন ট্রিটমেন্ট দেবেন।
ভেবে দেখি, স্যার। আজ যাই তাহলে। বড় উপকার করলেন।
আমি তো ভাবলাম কী না কী। ছেলের বাবা উঠে পড়েন।
ফলাফল জানাবেন কিন্তু।
অবশ্যই, স্যার, অবশ্যই। আপনি দাওয়াই বাতলে দিলেন, আর আপনাকে জানাবো না, তা কী করে হয়?
ছেলের বাবা বেরিয়ে গেলেন।
ডাক্তার লক্ষ করলেন, তাঁর মুখে ফুটেছে একটা অদ্ভুত হাসি। হাসিটা বড় সুবিধার নয়।
ডাক্তার সাহেব কিঞ্চিৎ চিন্তিত হয়ে পড়লেন।
(১২ ডিসেম্বর, ২০১২)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।